দেশের বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ জুলাই ২০১৯, ৩:১২:৩১ অপরাহ্ন
বর্তমানে দেশের যোগাযোগের তিনটি প্রধান পদ্ধতিতেই যাচ্ছেতাই অবস্থা বিরাজ করছে। সড়কপথ, রেলপথ ও বিমানে বিশৃংখলা সীমাহীন। সড়ক পথে শৃংখলা ফিরিয়ে আনার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ চেষ্টা চলছে। এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিন সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করছে দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়া। অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনার দুর্দমনীয় মিছিল চলছেই অপ্রতিহত গতিতে। ট্রাফিক ব্যবস্থায় বিশৃংখলা ও সড়ক ব্যবস্থার ত্রুটিপূর্ণ জরাজীর্ণ দশা এজন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী। দেখা যাচ্ছে, শুধু সড়কই যে সংকীর্ণ ও জরাজীর্ণ তা নয় বরং বিভিন্ন রাস্তায় বিদ্যমান অধিকাংশ সেতুও জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ।
সম্প্রতি গোয়াইনঘাটের সারিঘাট সড়কে স্টিলের ব্রীজ ভেঙ্গে একটি ট্রাক খাদে পড়ে যায়। একই ব্রীজে ২ বছর আগে আরেকটি ট্রাক দুর্ঘটনা কবলিত হয়। সঠিকভাবে মেরামত না করায় আবারো ঘটে দুর্ঘটনা। এটা একটি উদাহরণ মাত্র। সিলেটসহ দেশজুড়ে এমনি অবস্থা বিদ্যমান। গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকে ‘রেলে সব আছে, শৃংখলা নেই’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গত ১১ বছরে রেলের উন্নয়নে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় এবং ১৩ হাজারের মতো লোকবল নিয়োগ সত্বেও রেলে দুর্ঘটনা কমছে না।
গত ২৩ জুন রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের ৬টি বগি লাইনচ্যুতির ঘটনায় ৫ জন যাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। আহত হন শতাধিক যাত্রী। এ ঘটনার ২ দিন আগে গাজীপুরে রংপুর ট্রেনের একটি চাকা লাইনচ্যুত হলে ৪ ঘন্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। রেলের হিসাব মতে, ২০১৪ সাল থেকে গত জুন পর্যন্ত সাড়ে ৫ বছরে ৮৬৮ টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ১১১ জন। আহত হন ২৯৮ জন। গতকাল দৈনিক জালালাবাদে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট-আখাউড়া রেল লাইন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। রেলপথ থেকে অব্যাহতভাবে চুরি হচ্ছে ক্লিপ-হুক। রেললাইনের সংযুক্ত ক্লিপ-হুক চুরির ফলে দুর্বল হয়ে পড়ছে রেললাইন। এই সেকশনের ভানুগাছ থেকে শমসের নগর পর্যন্ত রেলপথে ১০ হাজারেরও বেশী ক্লিপহুক গায়েব হয়ে গেছে। বৃটিশ আমলের তৈরী সেকশনের রেলসেতু ও কালভার্টসমূহের ওপর জীর্ণশীর্ণ কাঠের স্লিপারের সাথে পেরেক দিয়ে বাঁশের ফালি স্থাপন করা হয়েছে। ফলে ট্রেন চলাচলের সময় যে কোন মুহূর্তে দুর্ঘটনার আশংকা রয়েছে। একই অবস্থা বিমানের ক্ষেত্রেও। প্রতি বছর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স শত শত কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে। এর এয়ারক্রাফটগুলো যান্ত্রিক ত্রুটিও অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনার শিকার হতে দেখা যাচ্ছে।
নিকট অতীতে কাঠমন্ডুর ত্রিভূবন বিমান বন্দরের দুর্ঘটনা ছিলো সবচেয়ে ভয়াবহ। এছাড়া ফ্লাইট শিডিউলে বিপর্যয় তো নিত্যনৈমিত্তিক। সেবার মানেরও তেমন কোন উন্নতি হয়নি বিগত সময়ে। অনেকের অভিযোগ, বিমান বর্তমানে অর্থলুটপাটের একটি লোভনীয় ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। উপর থেকে নীচ পর্যন্ত দুর্নীতির চেইন বিস্তৃত। দুর্নীতিবাজদের জেনে বুঝেই এখানে নিয়োগ দেয়া হয়। এভাবে চলে স্বার্থের ভাগাভাগি।
এশিয়ার বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ যখন যোগাযোগের ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি সাধন করছে, তখন বাংলাদেশ পড়ে আছে মান্দাতা আমলের প্রযুক্তি তথা ব্যবস্থা নিয়ে। বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশে যখন অসংখ্য মাল্টিলেভেল অর্থাৎ বহুস্তর রাস্তা, ফ্লাইওভার ও টানেল তৈরী হচ্ছে তখন বাংলাদেশের বিদ্যমান রাস্তাগুলোর সংস্কার পর্যন্ত হচ্ছে না যথাযথভাবে। এসব দেশে যখন বুলেটট্রেনসহ হাইস্পীড ট্রেন চালু হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের রেলপথে বাঁশ দিয়ে জোড়াতালি দেয়া হচ্ছে। আর এশিয়ার বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইন্সগুলো যখন হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করছে তখন বিমানের ঘাটতি প্রতিমাসে ৫ শতাধিক কোটি টাকা।
সর্বোপরি একটি দেশের উন্নয়নে সেদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু এই যোগাযোগ ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য ও মধ্যপ্রাচ্য দূরে থাক, ভারতসহ অনেক প্রতিবেশী দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। ফলে পর্যটনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মার খাচ্ছে বাংলাদেশ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রফতানী কার্যক্রম। বাড়ছে না দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ। দেশকে ডিজিটালাইজড করার দাবি করা হলেও যোগাযোগের প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার প্রতি প্রদর্শন করা হচ্ছে সীমাহীন অবজ্ঞা ও অবহেলা। চলছে অবাধ লুটপাট, দুর্নীতি। ফলে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা যে-ই তিমিরে ছিলো, সেই তিমিরেই থেকে যাচ্ছে। আমরা এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখানে কিঞ্চিত আলোকপাত করলাম মাত্র। এক্ষেত্রে সরকারী পর্যায়ে বিস্তারিত মূল্যায়ন এবং স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়ন আবশ্যক। আমরা এদিকে যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের ক্ষমতাশালী ও দক্ষ মন্ত্রী তথা সরকারের উর্ধতনমহলের সুদৃষ্টি কামনা করছি।