ইতিহাসে নদী ও সমুদ্রে
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ জুলাই ২০১৯, ১২:০১:৫৩ অপরাহ্ন
ইতিহাসে নদী ও সমুদ্রে
।। সারওয়ার চৌধুরী ।।
প্রিন্সেস হায়া’র পলায়ন
রূপকথার অধিক বিস্ময়
মার্ক টোয়েন বলেছিলেন “ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন”। সত্য ঘটনা কেন ফিকশনের চেয়ে বিস্ময়কর হয় এবং এর ‘ননজিরো ভ্যালিউ’ কেন থাকে তা ব্যাখ্যাও করেছিলেন মার্ক টোয়েন। ননজিরো ভ্যালিউ মানে, যে ঘটনার ইতিবাচক ও নেতিবাচক মান থাকে।
প্রিন্সেস হায়া-র পলায়ন একটি ‘স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন’ ঘটনা। দুনিয়াজুড়ে খবর, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরালÍ দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রাশিদ আল মাকতুমের স্ত্রী প্রিন্সেস হায়া ৩৯ মিলিয়ন ডলার নিয়ে পালিয়েছেন গত মে মাসে। বর্তমানে ৪৫ বছর বয়সের হায়া জর্ডানের বর্তমান বাদশাহ আবদুল্লাহর সৎবোন। তিনি শেখ মোহাম্মদের ষষ্ট বউ হয়ে এসেছিলেন ২০০৪ সালে। তাদের দুটি সন্তান। ছেলে শেখ জায়েদ (২০১২-তে জন্ম), মেয়ে শেয়খা জালিলা (জন্ম ২০০৭-এ)। শেখ মোহাম্মদের বয়স এখন ৬৯। তার মোট ছয় স্ত্রী ও ২৩ জন ছেলে মেয়ে আছে। তিনি নিজের কথা বলেন এভাবে “আমি জানি না আমি ভাল নেতা কীনা, তবে আমি নেতা, আমার ভিশন আছে, আমি ২০/৩০ বছর ভবিষ্যতে নজর রাখি”।
উল্লেখ্য, দুবাই প্রদেশের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রাশিদ আল মাকতুম সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করছেন। জানা যায়, বার্লিন কর্তৃপক্ষের কাছে শেখ মোহাম্মদ তার স্ত্রীকে ফেরত দিতে বলেছিলেন। ৭ বছরের পুত্র জায়েদ ও ১১ বছরের মেয়ে জালিলাকেও ফেরত চেয়েছিলেন। কিন্তু এ আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। প্রিন্সেস হায়া ও তার সন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছিল জার্মান সরকার। তবে ইতোমধ্যে বৃটেনের প্রথম সারির পত্রিকাগুলো জানিয়েছে, লন্ডনের কেনসিংটন প্রাসাদের কাছে প্রিন্সেস হায়ার কেনা বাড়িতে কড়া নিরাপত্তায় সন্তানদের নিয়ে আছেন। ঐ এলাকাটিতে বিদেশিদের দূতাবাস রয়েছে। হায়া এ বাড়িটি ২০১৭ সালে বিলিয়নিয়ার লক্ষী মিত্তেলের কাছ থেকে কিনেছিলেন ৮৫ মিলিয়ন পাউ- দিয়ে।
প্রিন্সেস হায়া এখন শেখ মোহাম্মদের বিরুদ্ধে মাল্টি মিলিয়ন তালাক মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জানা যায়। তার পলায়নের কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেন, “শেখ মোহাম্মদ তার বড় মেয়ে লতিফাকে বন্দী রাখা ও কারাগারে নির্যাতনের ব্যাপারে মিথ্যা বলেছেন। তাই তার সংসারে থাকা নিরাপদ না।” প্রিন্সেস লতিফা গত বছর তার বন্ধুকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে গোয়া থেকে আমিরাতের কমা-োরা ভারত সরকারের সহযোগিতায় ফেরত নিয়ে আসে। দুবাইয়ের এ কোটিপতি আমিরের ছয় শ কোটি টাকার সম্পদ আছে। তার আরেক মেয়ে প্রিন্সেস শামসা নিখোঁজ রয়েছে বলে মিডিয়ায় খবর এসেছে। ওদিকে শেখ মোহাম্মদ বলেছেন, “প্রিন্সেস হায়া বিশ্বাসঘাতক। তার অন্তরে যে চক্রান্তের ছল ছিল তা প্রকাশ হল।”
সংবাদপত্রের জগতে একটি কথা চালু আছে। বলা হয়, “হেডলাইন্স হ্যাভ এ্যা ওয়ে অফ কামিং ব্যাক টু হন্ট ইউ”। দুই বছর আগে প্রিন্সেস হায়া শেখ মোহাম্মদের প্রশংসা করে ‘সোসাইটি’ ম্যাগাজিনে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যে নারী পুরুষের অধিকারের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন তার বর দুবাইয়ের আমির শেখ মোহাম্মদ বিন রাশিদ আল মাকতুম। এখন সেই বরকে নারীর প্রতি অত্যাচারী সাব্যস্ত করে দুবাই ছেড়ে যান প্রিন্সেস হায়া। ছেড়ে যাওয়ার কারণ, এ স্বামীর কাছে থাকা নিরাপদ না।
উল্লেখ্য, প্রিন্সেস হায়া বিনতে হোসেন একজন অক্সফোর্ড গ্রাজুয়েট। তিনিই প্রথম আরব নারী, যাকে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের এ্যাম্বেসেডর করা হয় (২০০৫-২০০৭)।
কথা প্রসঙ্গে একজন আরব বললেন, “প্রিন্সেস হায়া পশ্চিমের মুক্ত পরিবেশে বড় হওয়া নারী। তিনি শেখ মোহাম্মদকে বিয়ে করাটাই ভুল হয়েছে। কারণ, শাসক হিসাবে লিবারাল দেখা গেলেও, তার রয়েল প্যালেসের ভিতর পারিবারিক নিয়ম কানুন কঠোর রক্ষণশীল। এমন কঠোরতার মাঝে প্রিন্সেস হায়া স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করা সম্ভব না। তাছাড়া, শেখ মোহাম্মদ বিয়ে কেবল ছয়টি করেননি, অনেক বিয়ে করেছেন।”
এই আরব লোকটি একজন বড় ব্যবসায়ী। তিনি মনে করেন, শেখ মোহাম্মদের বড় মেয়ে প্রিন্সেস লতিফাকে মেরে ফেলা হয়েছে গোপনে এবং রয়েল প্যালেসের কেউ তার খোঁজ পাচ্ছে না। শেখ মোহাম্মদ প্রিন্সেস লতিফা সম্পর্কে অসত্য বলায় প্রিন্সেস হায়া নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। লতিফাকে গত বছর ভারতের গোয়া থেকে আমিরাতের কমান্ডোরা ফেরত এনেছিল।
উল্লেখ্য, বৃটেনের রাজ পরিবারের সাথে শেখ মোহাম্মদ ও রাজকন্যা হায়া দুজনেরই ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। কিন্তু হায়া পলায়নের ঘটনায় জার্মানি ও বৃটেনের সাথে দুবাই রয়েল প্রাসাদের সম্পর্কে চিড় ধরেছে। চলতি মাসের শেষে রাজকন্যা হায়া কর্তৃক দায়ের করা মামলায় শেখ মোহাম্মদকে লন্ডনের আদালতে হাজিরা দিতে হতে পারে।
তাছাড়া, ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি জোটের অন্যতম প্রভাবশালী শরীক আরব আমিরাতে বৃটেনের অস্ত্র বিক্রি অবৈধ বলে রায় দিয়েছে বৃটেনের আপিল কোর্ট গত মাসে। এরিমধ্যে স্কটল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম উপকূলের কাইল অব লচালশের ইনভেরিনেইটে শেখ মোহাম্মদের বাড়ি বানানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে।
রাজকন্যা হায়া পালিয়ে যাওয়ায়, এখানের বিভিন্ন দেশের আরব কমিউনিটি, ইরানি ও বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তানের লোকজন, বিভিন্ন আভ্যন্তরীণ সূত্র মোতাবেক কেউ শেখ মোহাম্মদের পক্ষে, কেউ রাজকন্যা হায়ার পক্ষে কথা বলছেন। এদের কারো স্বজন দুবাই রয়েল প্রাসাদে বাবুর্চি বা সিকিউরিটির কাজ করেন। কেউ বলেন, প্রিন্সেস হায়া প্রিন্সেস লতিফা সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে পারায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন, তাই পালিয়ে গেছেন। কেউ বলছেন হায়ার দেহরক্ষী বৃটিশ লোকটির সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণেই পালিয়েছেন।
(চলবে)
সারওয়ার চৌধুরী, আবুধাবি থেকে।