পরনিন্দাঃ একটি ভয়ংকর মহামারী
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জুলাই ২০১৯, ১২:৪০:১৯ অপরাহ্ন
লুকমান হাকিম ::
মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিকতা ছাড়া একাকী বাঁচা মানুষের পক্ষে চিন্তা করাও অনেক কঠিন। এটা কেউ কামনাও করে না যে- সে একা থাকবে। একা বাঁচাবে। সামাজিকতা ছাড়া একজন মানুষের জীবন আছে বলে বিশ^াস করাও কঠিন। সম্ভব হলেও জীবনটা তখন নিরস থাকতে হয়। সামাজিক জীবনে নিরস জীবন আর মৃত জীবনে কোনো পার্থক্য নেই। মানুষের জীবন নিয়ে চিন্তা করলেই সমাজ ও সামাজিকতার চিন্তা এমনিতেই চলে আসে। মানুষ সব সময় সুখ ও শান্তি চায়। শান্তি মানুষের একটি পরম সখের বিষয়। কিন্তু এই প্রত্যাশিত সুখ-শান্তি নির্ভর করে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর। ব্যক্তিগতভাবে মানুষ সুখি হতে পারলে শুরু হয় সামাজিকভাবে সুখি হওয়ার পালা। সামাজিকতাকে সবাই গুরুত্ব দেন। সামাজিকতার তাৎপর্য অনেক।
ইসলাম সামাজিকতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। এদিকে যে সকল উপাদানে সামাজিকতা বৃদ্ধি পায়, পরস্পরে সম্প্রীতি তৈরি হয় ইসলাম সেগুলোর প্রতি অনেক গুরুত্ব দিয়েছে। যেমন: সালাম, মুসাফাহা, মুআনাকা, সমাজসেবা, বিপদে পাশে দাাঁড়ানো, অসুস্থের সেবা করা, প্রতিবেশিকে সহযোগিতা করা, অসহায় প্রতিবেশিকে দেখাশোনা করা-ইত্যাদি। এর পাশাপাশি সামাজিকতা বিঘিœত হয়, পরস্পরে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয় এরকম আশঙ্কাজনক সবকিছু থেকে শতহাত দূরে থাকতে ইসলাম আমাদেরকে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। বক্ষমান নিবন্ধে এরকম একটি ব্যাধি নিয়ে আজকের আলোচনা। এর নাম পরনিন্দা বা সমালোচনা। এই বিষয়টিকে আল্লাহপাক কুরআনে কারীমে বিভিন্ন শব্দ দিয়ে বিভিন্ন স্থানে চিত্রিত করেছেন। আল্লাহপাকের বিবরণ শৈলি তো তাঁর শান মুতাবিক উচ্চমার্গীয় এবং সুকৌশলি। পরনিন্দা বিষয়ক কুরআনি বিবরণভঙ্গি শুনলে এমনিতেই এর ঘৃণার সৃষ্টি হয়। এই পরনিন্দা অনেক মারাত্মক। ব্যক্তিজীবনে এর ভয়াবহতা অনেক ক্ষতিকর। সামাজিক জীবনের এর কুফলতা চরম পর্যায়ের ভয়ঙ্কর। এই পরনিন্দা বিষিয়ে তুলতে পারে রঙীন একটি জীবন। জ¦ালিয়ে দিতে পারে স্বপ্নের সোনালি ভবিষ্যৎ। পরস্পরে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে বসবাস অনুপযোগী করতে পারে আলোকিত একটি সামাজিক সংসার।
পরনিন্দাকে কুরআনের ভাষায় গীবত, নামীমাহ, হুমাযাহ বা লুমাযাহ হিসেবে বিবরণ দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটির পরস্পরে পার্থক্য থাকলেও পরনিন্দার অর্থে সবকটিই পাশাপাশি। সমাজকে বিশৃঙ্খল করার ক্ষেত্রে প্রত্যেকটির ভয়াবহতা কাছাকাছি। এ কারণে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। ইহকাল ও পরকাল বিপর্যস্ত হয়।
গীবতের শাব্দিক অর্থ হল পরনিন্দা বা সমালোচনা, ‘গীবত’-এর পরিচয় প্রসঙ্গে নবী সা. সাহাবীগণকে লক্ষ্য করে বলেছেন,-‘তোমরা কি জানো ‘গীবত’ কী? তাঁরা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল অধিক জ্ঞাত। তিনি বললেন, তোমার ভাই যে কথা অপসন্দ করে তার সম্পর্কে সে কথা বলার নাম গীবত। জিজ্ঞেস করা হল, আমি যা বলছি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে? রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, তুমি যা বলছ তা যদি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে তবে তুমি তার ‘গীবত’ করলে আর যদি না থাকে তাহলে তুমি তাকে অপবাদ দিলে’। (মুসলিম; মিশকাত হা/৪৮২৮)
সুতরাং কথায় বা ইশারা-ইঙ্গিতে অথবা অন্য কোনো উপায়ে অন্যের অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে এমন কোনো আলোচনা করা যা শুনলে সে মনে ব্যথা পেতে পারে, যদি তা সত্য হয়- তাহলে এর নাম গীবত আর মিথ্যা হলে তার বুহতান, তোহমদ বা অপবাদ। যা শরিয়তের দৃষ্টিতে গীবতের চেয়েও জঘন্য।
চাই তা শরীর সংক্রান্ত হোক কিংবা দ্বীন ও চরিত্র বিষয়ক হোক কিংবা আকার-আকৃতি বিষয়ক।
আমরা অনেকে মনে করি স্বভাব চরিত্রের দোষ বর্ণনা করাই গীবত, আসলে বিষয়টি এমন নয়; বরং একজন মানুষের পারিপাশির্^ক যত বিষয়ে তাকে কটাক্ষ করা যায় তা সবই গীবতের অর্ন্তভুক্ত। যেমন- তার দৈহিক আকার আকৃতি, জ্ঞান-বুদ্ধি, পোষাক-পরিচ্ছেদ, বংশ পরিক্রমা ইত্যাদি। এগুলোর কোনো একটি নিয়ে আলোচনা করা। যেমন একবার হযরত আয়েশা রা. প্রিয় নবী সা. এর সামনে রাসুলের অপর এক স্ত্রী হযরত সাফিয়া রা. এর সম্পর্কে, যিনি একটু খাটো ছিলেন আলোচনা করতে গিয়ে নিজের হাত দ্বারা ইশারাহ করে দেখালেন যে, ইয়া রাসুলাল্লাহ! সাফিয়া তো ইয়ে, অর্থাৎ বুঝাতে চাইলেন তিনি খাটো। এভাবে ইশারাহ করার দ্বারাই গীবত হয়ে গেল। তাই তখন নবী সা. বললেন যে, “হে আয়েশা! আজ তুমি এমন একটা কাজ করলে, যদি এই আমলের দুর্গন্ধ এবং তার বিষ সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে গোটা সমুদ্রের পানি দুর্গন্ধযুক্ত এবং বিষাক্ত হয়ে যাবে। (আবু দাউদ-২/৬৬৮)
সুতরাং এ থেকে বুঝা গেল যে, ইশারা-ইঙ্গিত ও অঙ্গ ভঙ্গির মাধ্যমে কারো দোষ প্রকাশ করাও গীবত এবং গুনাহের অর্ন্তভুক্ত। এ হাদিসে গীবতের গুনাহর ভয়াবহতা সমুদ্রের পানির রং পরিবর্তন করে দিতে পারে এমন জঘন্য ও দুর্গন্ধময় বিষের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, গীবত কত নিকৃষ্টতম গুনাহ।
গীবতের প্রকার
১. কারো দৈহিক দোষের কথা আলোচনা করা। যেমন: ল্যাংড়া, কুশ্রী, বেটে-খাটো ইত্যাদি।
২. কারো পোশাক-পরিচ্ছদের দোষ সম্পর্কে আলোচনা করা। যেমন: কারো ব্যাপারে বলা যে, অমুককে এই পোশাকে একটুও মানাচ্ছে না। বা তার পোশাকটা সুন্নতি নয়।
৩. নিজের মর্যাদা বাড়িয়ে বলে অপর কারো মর্যাদাকে ক্ষুণœ করে কথা বলা বা কারো বংশ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা।
৪. অভ্যাস ও চালচলন সম্পর্কীয় দোষ নিয়ে কথা বলা। যেমন-এভাবে বলা, সে খাওয়ার সময় আওয়াজ করে খায়। বা ঘুমিয়ে বিকট আওয়াজে নাক ডাকে।
৫. গোনাহ সম্পর্কে পরসমালোচনা করা। যেমন-কারো সম্পর্কে বলা, সে মিথ্যুক, সুদখোর, ঘুষখোর।
গীবতের ভয়াবহ পরিণাম ও কুরআন
গীবত করতে আল্লাহ তা‘আলা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। মানুষ যাতে গীবতকে ঘৃণা করে এবং তাতে নিরুৎসাহিত হয় সেজন্য আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যাদেশ করেছেন এবং গীবতকে এমন ঘৃণ্যভাবে চিত্রিত করেছেন, যেকোনো মনই তার প্রতি বিতৃষ্ণ হবে। তিনি বলেছেন- ১. ‘তোমরা একে অপরের যেন গীবত না কর। তোমাদের কেউ কি স্বীয় মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ পসন্দ করে? অনন্তর তোমরা তা অপসন্দ কর’ (হুজুরাত: ১২)।
২. ধ্বংস তাদের জন্য, যারা অগ্র-পশ্চাতে দোষ বলে বেড়ায়। (হুমাজাহ: ১)
৩. হে নবি! যে বেশি বেশি মিথ্যা শপথ করে, অপদস্থ, হাঁটে আর সমালোনা করে- আপনি তার অনুসরণ করবেন না। সমালোচনা ঘৃণ্য একটি বিষয় হওয়ার কারণে ২য় আয়াতে বলা হয়েছে যারা আগ্রপশ্চাতে দোষ বলে বেড়ায়- তাদের জন্য ধ্বংস এবং ৩য় আয়াতে দোষত্রুটির ভ্রম্যমান বাহককে অনুসরণ করতে আল্লাহপাক তাঁর রাসুলকে নিষেধ দিচ্ছেন। দোষত্রুটি প্রচারকারীদের জঘন্যতা এবং এর ভয়াবহতা বুঝানোর জন্য তিনটি আয়াতই যথেষ্ট। প্রথম আয়াতে গীভত করা বিষয়টিকে আপন মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করার সাথে তুলনা করা হয়েছে। সরাসরি না বলে সুকৌশলে গীবতের প্রতি ঘৃণা জন্মানোর চেষ্টা করা হয়েছে। যা সরাসরি নিষেধ দেওয়ার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ।
গীবতের ভয়াবহ পরিণাম ও আহাদীস
১. অন্যের দোষ প্রকাশ তো দূরের কথা; বরং তা তালাশ করার থেকে বিরত থাকার প্রতি রাসুল সা. গুরুত্বারোপ করেছেন। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, হে মানব সকল! যারা শুধুমাত্র মুখে ঈমান এনেছো, ঈমান যাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি, তোমরা মুসলমানদের গীবত করো না এবং তাদের দোষ অনুসন্ধান করো না। কেননা, যে ব্যক্তি মুসলমানদের দোষ অনুসন্ধান করে, আল্লাহপাক তার দোষ অনুসন্ধান করেন। আল্লাহপাক যার দোষ অনুসন্ধান করেন, তাকে স্বগৃহেও লাঞ্ছিত করেন। (আবু দাউদ- ২/৬৬৯)
২. জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাযি. বলেন, আমরা রাসুল সা. এর সাথে এমন দু’টি কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম, যে দু’টি কবরবাসীকে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। রাসুল সা. বললেন, এদেরকে বড় কোনো গুনাহের কারণে আযাব দেয়া হচ্ছে না। তাদেরকে আযাব দেয়া হচ্ছে, তাদের একজন মানুষ গীবত করতো এবং অপরজন পেশাব থেকে পরহেজ করতো না। (আদাবুল মুফরাদ-১/২৫৬)
৩. জাবের ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘আমরা রাসুল সা. এর সাথে ছিলাম। হঠাৎ করে, দুর্গন্ধময় মৃত ব্যক্তির ঘ্রাণ ছড়ালো। রাসুল সা. বললেন, তোমরা কি জানো এটি কিসের দুর্গন্ধ? রাসুল সা. বললেন, এটি ওই সমস্ত ব্যক্তির দুর্গন্ধ, যারা দুনিয়াতে মানুষের গীবত করতো।’ (মুসনাদে আহমদ- ৩/৩৫১)
৪. হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যখন আমাকে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, সেখানে আমি এমন কিছু মানুষের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখ ছিলো তামার। তারা তাদের চেহারা এবং বক্ষকে আঁচড়াতে ছিলো। আমি জিবরাঈল আ. কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? জিবরাঈল আ. বললেন, এরা ওই সমস্ত ব্যক্তি, যারা দুনিয়াতে মানুষের গোশতো ভক্ষণ করতো, অর্থাৎ, তারা মানুষের গীবত করতো এবং তাদের ইজ্জতহানি করতো।’ (আবু দাঊদ-২/৬৬৭)
৫. গীবত এতো নিকৃষ্ট যে, গীবতের কারণে নামাজ-রোজার সওয়াব পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে অনেক সময় কেউ অন্যের গীবত করে থাকলে, তাদের নামাজ-রোজা পুনরায় আদায় করার জন্যে রাসুলল্লাহ সা. আদেশ দিতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত। একবার দু’জন ব্যক্তি যোহর অথবা আসরের নামাজ আদায় করলো। তারা উভয়ই ছিলো রোজাদার। রাসুল সা. নামাজ সমাপ্ত করে উক্ত দু’জন ব্যক্তিকে সম্বোধন করে বললেন, তোমরা উভয়ই পুনরায় ওজু করো এবং নামাজ আদায় করো। (আজকের ) রোজা পূর্ণ করে অন্য কোনো দিন এর কাযা করো। তারা জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ সা. কেনো? রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, তোমরা অমুক ব্যক্তির গীবত করেছো। (শু‘য়াবুল ঈমান-৫/৩০৩)
৬. গীবতের সম্পৃক্ততা বান্দার হকের সাথে এবং দুনিয়াতে এর কোনো শাস্তির বিধান নেই। বান্দা মাফ না করলে কখনো গীবতের গুনাহ মুছবে হবে না। তাই হাদিস শরীফে গীবতের গুনাহকে অন্যান্য গুনাহর থেকে জঘন্য আখ্যা দেয়া হয়েছে। যেমন- হযরত আবু সাঈদ ও জাবের রাযি. থেকে বর্ণিত। তারা উভয়ে বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, ‘গীবত যিনা বা অবৈধ যৌনাচারের চেয়েও ঘৃণ্য ও জঘন্য গুনাহ।’ (মিশকাত, বায়হাকি: শুআবুল ঈমান-৫/৩০৬)। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ সা. কিভাবে গীবত যিনা ব্যাভিচার থেকেও জঘন্য? রাসুল সা. বললেন, কোনো ব্যক্তি যিনা করে, অতঃপর সে তওবা করে, ফলে আল্লাহপাক তাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু গীবতকারীকে আল্লাহপাক ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত যার গীবত করা হয়েছে, সে ক্ষমা না করে। হযরত আনাস রাযি.-এর বর্ণনায় আছে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যিনাকারী তওবা করে, কিন্তু গীবতকারীর তওবা নেই। (শুআবুল ঈমান-৫/৩০৬)
৭. গীবতের গুনাহ যেমন বড় তেমনি এর পরিণতিও খুবই ভয়াবহ। এটা বুঝানোর জন্য রাসুল সা. গীবতকারীদের পরকালীন শাস্তি সম্পর্কে ইরশাদ করেন, মেরাজের সময় যখন আমাকে আসমানে তুলে নেওয়া হয় তখন আমি এমন একদল লোকের কাছ দিয়ে অতিক্রম করি, যাদের নখ ছিল তামার। তারা নিজেদের নখ দিয়ে নিজেদের চেহারা ও সিনার উপর খামছে খামছে ছিড় ছিল। আমি হযরত জিবরাঈল আ. কে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? তিনি উত্তরে বললেন, এরা ঐ সকল লোক যারা মানুষের গোশত খেত। অর্থাৎ, মানুষের গীবত করত এবং মানুষের ইজ্জতের উপর হামলা করত।” [আবু দাউদ, কিতাবুল আদব]
৮. যার গীবত করা হয় তার আমলনামায় গীবতকারীর সওয়াব চলে যায় এবং গীবতকারীর আমলনামায় যার গীবত করা হয় তার গুনাহ চলে আসে। হযরত হাসান বসরি রহ. এর সম্পর্কে প্রশিদ্ধ আছে যে, তিনি যখন শুনতে পেতেন তার সম্পর্কে কেউ গীবত করেছে, তখন তিনি সেই ব্যক্তির জন্য অনেক ফল-ফ্রুট ও বিভিন্ন মিষ্টান্ন দ্রব্যাদি হাদিয়া পাঠিয়ে দিতেন এবং বলতেন যে, “মাশাআল্লাহ তিনি আমার অনেক উপকার করেছেন। এত কষ্ট করে সওয়াব অর্জন করে তিনি আমাকে সেই সওয়াব দিয়ে দিয়েছেন তার জন্য সামান্য কিছু হাদিয়া পাঠানো আমার অবশ্যই কর্তব্য হয়ে পড়েছে।”
৯. বিদায় হজের ভাষণে মহানবী সা. ইরশাদ করেন, তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের ইজ্জত, তোমাদের উপর হারাম যেমন তোমাদের এই শহরে এই মাসের এই দিনটি হারাম। (মুসলিম:১২১৮)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা মুসলমানদের গীবত করো না। তাদের দোষ অন্বেষণ করো না। কেননা, যে তার ভাইয়ের দোষ অন্বেষণ করে বেড়ায় আল্লাহও তার দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করেন না। আর আল্লাহ তা’আলা যার দোষ মার্জনা না করেন, তাকে তিনি ঘরের ভিতর রেখেও লাঞ্ছিত করতে পারেন।
(ইবনে কাছীর, হুজুরাত: ১২)
মানুষ গীবত করে কেনো?
মানুষ সবসময় নিজেকে বড় করে দেখে। এর নাম আমিত্ব। এই আমিত্বের আরেক নাম আত্মপূজা। এটা শুরু হয়ে গেলে আত্মপ্রীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তখন তার আত্মত্যাগের মতো মহৎ বৈশিষ্ট্য দূরিভূত হতে থাকে। ফলে এ স্থানে দানা বাঁধে হিংসা-বিদ্বেষ। আবার হিংসা-বিদ্বেষ থেকেই অপরের প্রতি কুধারণার সৃষ্টি হবে, যা মানুষকে গীবত করতে বাধ্য করে। সুতরাং আত্মপূজা, আত্মপ্রীতি, হিংসা-বিদ্বেষ, কুধারণাই হচ্ছে, গীবতের প্রধানতম কারণ।
গীবত থেকে মুক্তির পথ
১. গীবত থেকে বেঁচে থাকা অত্যন্ত জরুরি। এ থেকে বাঁচার প্রথম উপায় হচ্ছে অপরের কল্যাণ কামনা করা। কেননা, রাসুল সা. বলেছেন, ‘দীন হচ্ছে কল্যাণ কামনা করা।’ [বুখারি ও মুসলিম]
২. আত্মত্যাগ অর্থাৎ যেকোনো প্রয়োজনে অপর ভাইকে অগ্রাধিকার দেয়া। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন-‘তারা নিজের ওপর অন্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তারা অনটনের মধ্যে থাকে।’ (হাশর: ৯)
৩. অপরের অপরাধকে ক্ষমা করা।
৪. মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী বেশি বেশি করে অধ্যয়ন করা।
৫. সবসময় আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা। তিনি যেন অনুগ্রহ করে গীবতের মতো জঘন্য এ ব্যাধিতে আমাদের নিমজ্জিত হতে না দেন। এ ক্ষেত্রে জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সর্বাগ্রে। কেননা, রাসুল সা. বলেছেন, ‘বান্দা যখন ভোরে নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয় তখন শরীরের সব অঙ্গ জিহ্বার কাছে আরজ করে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহর নাফরমাণী কাজে পরিচালিত করো না। কেননা, তুমি যদি ঠিক থাক, তবে আমরা সঠিক পথে থাকব। কিন্তু যদি তুমি বাঁকা পথে চলো, তবে আমরাও বাঁকা হয়ে যাবো। (তিরমিযী)
রাসুল সা. অন্যত্র বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার জন্য তার জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের জিম্মাদার হবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হবো।’ (বুখারি) অসমাপ্ত।