সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশংকা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জুলাই ২০১৯, ৩:০৮:২৮ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট::
সিলেট ও সুনামগঞ্জের অধিকাংশ নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং ভারত থেকে আসা পাহাড়ী ঢলের কারণে সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। কমপক্ষে ৫ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বন্ধ রয়েছে শত শত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যা কবলিত কিছু জায়গায় ত্রাণ সামগ্রী দেয়া হয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৩/৪ দিন ভারী বর্ষণের আশংকা থাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
সিলেট অঞ্চলের শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বন্ধ রয়েছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণের ফলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকলে সিলেট অঞ্চলের ইতোমধ্যে প্লাবিত এলাকাগুলোর বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশংকা দেখা দিয়েছে।
গতকাল শুক্রবার দিনভর বৃষ্টির কারণে নতুন করে সিলেট ও সুনামগঞ্জের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন রয়েছে এই দুই জেলার বিভিন্ন সড়ক যোগাযোগ। এতে করে ভোগান্তিতে পড়ছেন লাখো মানুষ। বন্যাদুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার কথা জানানো হয়েছে। পাশাপশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভোলাগঞ্জ, ধলাই, বিছনাকান্দি ও জাফলংয়ের কোয়ারীগুলোতে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন।
সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জসিম উদ্দিন জানান, সুনামগঞ্জে সুরমার পানি কিছুটা কমলেও হাওরে পানি বাড়ছে। গত ৫ দিনের টানা বর্ষণে বিচ্ছিন্ন হওয়া তিন উপজেলার সড়ক যোগাযোগ এখনও স্বাভাবিক হয়নি। ৬ উপজেলায় প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও বন্যার্তদের জন্য খুবই অপ্রতুল বলে দাবি করছেন দুর্গতরা। বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দী লোকজনের সামনে নৌকা ভিড়ালে ত্রাণ মনে করে দৌড়ে আসে বন্যার্তরা। এমন হাহাকার ও বিপর্যস্ত জীবন নিয়ে কাটছে হাওরবাসীর। সুরমা নদীর পানি গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২ টায় বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, দোয়ারাবাজার ও ধর্মপাশা উপজেলার নি¤œাঞ্চলের কয়েক শতাধিক গ্রাম। এসব উপজেলা বেশির ভাগ সড়ক পানিতে ডুবে গেছে। নীচু এলাকার ঘরবাড়িতে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে।
এদিকে সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর উপজেলার সাথে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক সড়কের রহমতবাগ এলাকা ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে দু’এক দিনের মধ্যে গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। জেলার ২৩৮ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি প্রবেশ করায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। সাধারন ছুটি ঘোষণা করেছে প্রশাসন। গ্রামীণ সড়কগুলো এখনো ডুবে থাকায় যোগাযোগ করতে পারছে না দুর্গতরা। রান্নাবান্নার করতে অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। হাওরের মাটঘাট ডুবে যাওয়ায় কৃষকরা গোবাদি পশু নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। জেলার প্রায় অসংখ্য পুকুরের মাছ বানের পানিতে ভেসে গেছে। সদর উপজেলার মোহনপুর, সুরমা ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসমিন নাহার রুমা জানান, উপজেলার ১০ স্কুলে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যার্তদের ত্রাণ দেওয়া অব্যাহত আছে। ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম জানান, সরকারীভাবে ১০টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ৬ উপজেলায় নগদ ৩ লক্ষ টাকা, ৩০০ মে:টন চাল ও ২৫ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। আরও ১০ লক্ষ টাকা ৫০০ মে:টন চাল ও ৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার দিতে লিখিত আবেদন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মো: আব্দুল আহাদ জানান, ৬ টি উপজেলার ১২ হাজার ৮০০ ঘরবাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এতে ৬৬ হাজার লোক পানি বন্দি অবস্থায় রয়েছেন। বন্যার্তদের প্রশাসন ৩ লক্ষ টাকা, ৩ শ মেট্রিকটন চাল ও শুকনো খাবার প্রদান করেছে। এছাড়া জেলার ৫০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজে বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সরকারি ভাবে ১০টি আশ্রয় কেন্দ্র সহ সকল স্কুল গুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এদিকে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিক ভুইয়া জানান, সুনামগঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ৮৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘন্টায় ১৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
কোম্পানীগঞ্জ
কোম্পানীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গত ক’দিনের অব্যাহত বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জে বন্যা দেখা দিয়েছে। টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে বলে আশংকা করা হচ্ছে।।
শুক্রবার থেকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় উপজেলা সদরের সাথে ছয়টি ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। সবকটি গ্রামীণ সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার সদরের সবকটি সড়ক দুই ফুট পানির নিচে। অফিস আদালতের চতুরদিকে পানি থৈ থৈ করছে। পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে উপজেলার সবকটি অফিসের নিচতলায় পানি প্রবেশ করবে।
উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চল প্লাাবিত হয়েছে। উপজেলা সদরের সাথে সংযুক্ত অধিকাংশ সড়কই তলিয়ে গেছে। লোকজনের চলাচলের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। ধলাই, নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় এসব এলাকার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। কোন কোন এলাকায় বন্যা দুর্গত লোকজন বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিশেষ করে বন্যায় তলিয়ে গেছে হাজার হাজার হেক্টর জমির আউশ, রোপা ও বোনা আমনের বীজতলা । বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কৃষকরা ভেঙ্গে পড়েছেন। পানিবন্দী লোকজন গরুছাগল ও হাসমুরগি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। দেখা দিয়েছে গো খাদ্যের তীব্র সঙ্কট। বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন পশ্চিম ইসলামপুর, পূর্ব ইসলামপুর, উত্তর রণিখাই, দক্ষিন রণিখাই, ইছাকলস ও তেলিখাল ইউনিয়নের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা বন্যার কারনে বিদ্যালয়ে যেতে পারছেনা। ভোলাগঞ্জ, উৎমা ও শাহআরেফিন টিলায় পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। ফলে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।
পশ্চিম ইসলামপুর ইউপি চেয়ারম্যান শাহ্ জামাল উদ্দিন জানান, বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করছে। লোকজনকে সর্তক থাকতে বলা হয়েছে। ফসলের পাশাপাশি গ্রামীণ সড়কের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের খাদ্য ও পুনর্বাসন জরুরী হয়ে পড়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিজেন ব্যানার্জী জানিযেছেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি ঘটলে লোকজনকে নিকস্থ বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র ও পাশ্ববর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিতে সকল ইউপি চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, সরকারীভাবে ৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে।
কানাইঘাট
কানাইঘাট প্রতিনিধি জানান, গত কয়েকদিন ধরে টানা ভারি বৃষ্টিপাত ও উজান নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে কানাইঘাটে বন্যা দেখা দিয়েছে। উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার নি¤œাঞ্চলে বানের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সুরমা ও লোভা নদীর পানি গতকাল শুক্রবার থেকে বাড়তে শুরু করেছে। শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে কানাইঘাট সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ১১৬ সে. মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কানাইঘাট বাজারের গলিতে সুরমা নদীর পানি ঢুকে পড়েছে। এতে করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতংক দেখা দিয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ও পশ্চিম ইউপির বিভিন্ন এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে। অনেকের বসত ঘরে আক্রান্ত হচ্ছে বন্যার পানিতে। বিভিন্ন স্থানে আউশ ধানের মাঠ ও আমন ধানের বীজতলা তলিয়ে গেছে। সুরমা ও লোভা নদীর ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারন করেছে। নদীর তীরবর্তী বসবাসরত লোকজনের মধ্যে হঠাৎ করে সুরমা ও লোভা নদীর পানি বেড়ে যাওয়া আতংক দেখা দিয়েছে। তবে এখনও কানাইঘাটের সাথে সিলেট শহরের সড়ক যোগাযোগ বি”ি”ন্ন হওয়ার খবর পাওয়া যায় নি। উত্তর লক্ষীপ্রসাদ গ্রামের বাসিন্দা চরিপাড়া স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী জানিয়েছেন, আমরী নদীর দক্ষিণ তীরে অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ দেওয়ার কারণে লোভা ও সুরমা নদীর পানি তীব্র আকার ধারন করে। তার গ্রামসহ দক্ষিণ লক্ষীপ্রসাদ, আসামপাড়া, নিহালপুর, বাজেখেল, মেছা, কান্দলা, সতিপুর গ্রামের অনেকের বাড়ী ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) লুসিকান্ত হাজং শুক্রবার কানাইঘাটের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। তবে এখনও কানাইঘাটে পুরোপুরি বন্যা আক্রান্ত হয়নি, নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন তদারকি করে যাচ্ছে বলে তিনি জানান।
এভাবে নদী-নদীর পানি আরোও বাড়তে থাকলে কানাইঘাটে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিতে পারে এমন আশংকা করেছেন অনেকে।
ওসমানীনগর
ওসমানীনগর প্রতিনিধি জানান, ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জে উজান থেকে নেমে আসা ভারতীয় পাহাড়ি ঢল আর বৃষ্টিপাতে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুই উপজেলার অন্তত ৪ টি স্থানে কুশিয়ারা ডাইকের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে এলাকার বিভিন্ন গ্রামের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। পাহাড়ি ঢলে দুই উপজেলার ১টি ইউনিয়ন সম্পূর্ণ এবং ২টি ইউনিয়ন আংশিক বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এতে দুই উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের ৭/৮ শ’ পরিবারের হাজারো লোকজন পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে এবং আজ শনিবারের মধ্যেই বন্যা কবলিত লোকজনের জন্য ত্রাণ এসে পৌঁছাবে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
জানা যায়, ওসমানীনগর উপজেলার সাদীপুর ইউনিয়নের কুশিয়ারা ডাইকের লামা তাজপুর গ্রামের ভিতরে কুশিয়ারা ডাইকের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে উপজেলার সাদীপুর ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামসমূহ প্লাবিত হচ্ছে। সাদীপুর ইউনিয়নের লামা তাজপুর, পূর্ব তাজপুর, সৈয়দপুর, দক্ষিণ তাজপুর, টুকরাগাঁও, সুরিকোনাসহ বিভিন্ন গ্রামের ভিতরে ৪/৫ শত পরিবারের শত শত লোকজন পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। কুশিয়ারা ডাইকের বাইরে অবস্থিত গ্রামসমূহের বিভিন্ন ঘর বাড়িতে হাঁটু পর্যন্ত পানি উঠেছে।
ওসমানীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, আমি বর্তমানে লামা তাজপুর অবস্থান করছি। কুশিয়ারা ডাইকের উপর দিয়ে যাওয়া পানির স্থানে বালু ভর্তি বস্তা দেওয়া হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি রয়েছে।
বালাগঞ্জ
বালাগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বালাগঞ্জ উপজেলার পূর্ব পৈলনপুর ইউনিয়নের ৩টি স্থানে কুশিয়ারা ডাইকের উপর দিয়ে পানি বিভিন্ন গ্রামে ঢুকছে। ইউনিয়নের ফাযিলপুর, হামছাপুর ও পৈলনপুর নামক স্থানে কুশিয়ারা ডাইকের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ার কারণে ইউনিয়নের সবক’টি গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে হামছাপুর, জালালপুর, রশিদপুর, গালিমপুর, পৈলনপুর, ফাযিলপুর, ইছাপুর, ঐয়া, কিত্তেজালালপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ২ শতাধিক পরিবারের শত শত লোকজন পানিবন্দী রয়েছেন। ইউনিয়নের ফাযিলপুর গ্রামের নতুন রাস্তায় কুশিয়ারা ডাইকের একটি স্থানে ভাঙ্গন দেখা দিলে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মতিনের উদ্যোগে মেরামত করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তাছাড়া উপজেলার পূর্ব গৌরীপুর, বালাগঞ্জ, দেওয়ানবাজার, পশ্চিম গৌরীপুর এবং ওসমানীনগরের উছমানপুর, উমরপুর, পশ্চিম পৈলনপুর, তাজপুরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চলের গ্রামসমূহে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানা গেছে।
সাদীপুর ইউনিয়নের লামা তাজপুর গ্রামের বাসিন্দা সৈয়দ হুমায়েল আহমদ জানান, লামা তাজপুর গ্রামে কুশিয়ারা ডাইকের একটি স্থানের উপর দিয়ে পানি ঢুকে বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত করছে। এতে সাদীপুরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামসমূহে বন্যা দেখা দিয়েছে।
বালাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুস সাকিব বলেন, বালাগঞ্জ উপজেলার পূর্ব পৈলনপুর ইউপি বন্যা কবলিত হয়েছে। পূর্ব গৌরীপুর ইউপি’র আংশিক বন্যা কবলিত রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে। শনিবারের মধ্যেই ত্রাণ এসে পৌঁছাবে।
ছাতক
ছাতক প্রতিনিধি জানান, ছাতকে ৪-৫ দিনের অবিরাম বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে ফের বন্যা দেখা দিয়েছে। সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীর পানি বিপদসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক সড়কের রহমতবাগ এলাকা ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে দু’এক দিনের মধ্যে গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। এছাড়া উপজেলা সদরের সাথে নি¤œাঞ্চলের প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে। ঢলের পানিতে এসব গ্রামীণ রাস্তাঘাট ভেঙ্গে কোটি কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি দেখা দিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি প্রবেশ করায় বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকার অধিকাংশ বাসা-বাড়ি ও রাস্তা-ঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এছাড়া বন্যার পানিতে ভেসে গেছে শতাধিক ফিসারীর লক্ষ লক্ষ টাকার মাছ। তবে এখন পর্যন্ত পানিবন্দী মানুষের জন্য কোন আশ্রয় কেন্দ্র খোলা বা ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের খবর পাওয়া যায়নি।
সরজমিনে দেখা যায়, গত ৪-৫ দিনের টানা বৃষ্টি এবং সুরমা, চেলা, আয়নাখালি, বটেরখাল ও ধলাই নদী দিয়ে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে উপজেলার সর্বত্র তলিয়ে গেছে। বিশেষ করে উত্তর খুরমা, দক্ষিণ খুরমা, ইসলামপুর, নোয়ারাই, চরমহল্লা, জাউয়াবাজার, দোলারবাজার, ছৈলা-আফজলাবাদ, গোবিন্দগঞ্জ-সৈদেরগাঁও, ভাতগাঁও, সিংচাপইড়, কালারুকা ও ছাতক সদর ইউনিয়নের প্রায় ৪শতাধিক গ্রাম-মহল্লার চলাচলের রাস্তা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ইসলামপুর ইউনিয়নের রতনপুর, নিজগাঁও, গাংপাড়, নোয়াকোট, বৈশাকান্দি, বাহাদুরপুর, ছৈদাবাদ, রহমতপুর, দারোগাখালী, পৌরসভার হাসপাতাল রোড, শাহজালাল আবাসিক এলাকা, কানাখালী রোড, শ্যামপাড়া, মোগলপাড়া তাতিকোনা, বৌলা, লেবারপাড়া নোয়ারাই ইউনিয়নের বারকাহন, বাতিরকান্দি, চরভাড়া, কাড়–লগাঁও, লক্ষীভাউর, চানপুর, মানিকপুর, গোদাবাড়ী, কচুদাইড়, রংপুর, ছাতক সদর ইউনিয়নের বড়বাড়ী, আন্ধারীগাঁও, মাছুখালী, তিররাই, মুক্তিরগাঁও, উত্তর খুরমা ইউনিয়নের আমেরতল, ঘাটপার, গদারমহল, রুক্কা, ছোটবিহাই, এলঙ্গি, রসুলপুর, শৌলা, চরমহল্লা ইউনিয়নের ভল্লপুর, চুনারুচর, চরচৌলাই, হাসারুচর, প্রথমাচর, সিদ্ধারচর, চরভাড়–কা, দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের হরিশ্বরণ, হাতধনালী, রাউতপুর, ধনপুর, চৌকা, রামচন্দ্রপুর, হলদিউরা, কাশিপুর, কালারুকা ইউনিয়নের রামপুর, মালিপুর, দিঘলবন, আরতানপুর, রংপুর, মুক্তিরগাঁও, ভাতগাঁও ইউনিয়নের জালিয়া, ঘাঘলাজুর, হায়দরপুর, বাদে ঝিগলী, সিংচাপইড় ইউনিয়নের গহরপুর, মহদী, মামদপুর, চিকনিকান্দি, সিরাজগঞ্জ বাজার, গোবিন্দগঞ্জ পুরান বাজারসহ বিভিন্ন এলাকার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে।
এদিকে, জামুরা, চানপুর, নোয়াগাঁও, ভাসখলা, করচা, গোয়ালগাঁও, ১১০নং রাউলী, ৪৭নং আলমপুর, মোহনপুর, শ্যামনগর, কৃষ্ণনগর, আব্দুল জব্বার, কাটালপুর, বেরাজপুরসহ ৩০-৩৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করায় শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের যাতায়াত সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় রাস্তা-ঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তাছাড়া অধিকাংশ এলাকায় আমন ধানের বীজতলা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির আশংকা করছেন কৃষকরা। এতে কৃষকরা অজানা আতংকে রয়েছেন। অপরদিকে, শতাধিক মৎস খামার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় অর্ধ কোটি টাকার ক্ষতির আশংকা করছেন মৎস খামারীরা।
এব্যাপারে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মানিক চন্দ্র দাস জানান, বিদ্যালয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করায় এখন পর্যন্ত ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবেদা আফসারি জানান, বন্যার সার্বিক পরিস্থিতির সার্বক্ষনিক খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।
জৈন্তাপুর
জৈন্তাপুর প্রতিনিধি জানান, সিলেটের জৈন্তাপুরে ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে জৈন্তাপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাাবিত হয়েছে। অবিরাম বৃষ্টির ফলে উপজেলার জনজীবন বির্পযস্ত। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের বেশীরভাগ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের অনেক এলাকার মানুষের বাড়িঘরে বানের পানি প্রবেশ করেছে। অনেক এলাকায় গ্রামীণ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। জনসাধারণকে নৌকা দিয়ে যাতায়াত করছে। প্লাবনের ফলে উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার খাল-বিলের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সারী নদী, শ্রীপুর, রাংপানি ও বড়গাং নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ার বালু, পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। বন্যায় নিজপাট, জৈন্তাপুর, চারিকাটা, দরবস্ত ও ফতেহপুর ইউনিয়নের বেশির গ্রামে পানি প্রবেশ করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশংকা করা হয়েছে। অনেক এলাকায় মৎস্য খামার পানিতে ভাসিয়ে গেছে।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামাল আহমদ বন্যা কবলিত নিজপাট ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে তিনি নিম্নাঞ্চল এলাকায় বসবাসরত মানুষ সর্তক থাকার আহবান জানান। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় উপজেলা প্রশাসন সর্তক রয়েছে বলে জানিয়েছেন।
অপরদিকে জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন বৃহস্পতিবার বন্যা কবলিত জৈন্তাপুর ইউনিয়নের বাওন হাওর, ডুলটিরপার, শেওলারটুকসহ বেশ কিছু এলাকা পরিদর্শন করে তিনি বন্যায় পানিবন্দী মানুষকে আতংকিত না হওয়ার আহবান জানান।
সরেজমিনে বন্যা কবলিত এলাকা উপজেলা নিজপাট ইউনিয়নের মেঘলী, বন্দরহাটি, লামাপাড়া, ময়নাহাটি, জাঙ্গালহাটি, মজুমদারপাড়া, হর্নি, বাইরাখেল, গোয়াবাড়ী, তিলকৈপাড়া, বড়খেল, ফুলবাড়ী, ডিবিরহাওর, ঘিলাতৈল, হেলিরাই। জৈন্তাপুর ইউনিয়নের মুক্তাপুর, বিরাইমারা, বিরাইমারা হাওর, লামনীগ্রাম, কাটাখাল, খারুবিল, চাতলারপাড়, ডুলটিরপাড়, ১নং লক্ষীপুর, ২নং লক্ষীপুর, আমবাড়ী, ঝিঙ্গাবাড়ী, নলজুরী হাওর। চারিকাটা ইউনিয়নের বালিদাঁড়া, লালাখাল, রামপ্রসাদ, থুবাং, বাউরভাগ উত্তর, বাউরভাগ দক্ষিণ, পুঞ্জীসহ উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এদিকে সারীনদী, বড়গাং নদী এবং নয়া গাং নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সারী নদীর পানি বিপদসীমার উপরদিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানান সারী-গোয়াইন বেড়ীবাঁধ প্রকল্পের দায়িত্বরত কর্মকর্তা মোঃ আলা উদ্দিন। তিনি আরও বলেন বৃষ্টি থামলে পানি নিচের দিকে প্রবাহিত হবে। বন্যার খবর জানতে জৈন্তাপুর পানি উন্নয়ন অফিসে গেলে কাউকে খোঁজে পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে জৈন্তাপুর উপজেলা নিবার্হী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) বিশ্বজিৎ কুমার পাল জানান, বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে প্রশাসন সর্তক রয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত জনসাধারণকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলা হয়েছে, বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিং করা হচ্ছে। ত্রাণ সহায়তার জন্য উপজেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে।
গোয়াইনঘাট
গোয়াইনঘাট প্রতিনিধি জানান, এ দিকে আমাদের গোয়াইঘাট প্রতিনিধি জানান, উপজেলার সার্বিক বন্যার পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। গত দুই দিনের টানা বর্ষণের ফলে নতুন করে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যাদুর্গত মানুষের মধ্যে ১৮ মেট্রিকটন চাল বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত কুমার পাল তিন ইউনিয়নে ত্রাণ বিতরণ করেন। পাশাপাশি প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে।