রক্তপাতহীন এক মহাবিজয়
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ জুলাই ২০১৯, ১২:৩৬:১৪ অপরাহ্ন
রক্তপাতহীন এক মহাবিজয়
।। শাহিদা বেগম ।।
ষষ্ঠ হিজরী সালে হঠাৎ এক রাতে মহানবী (সা:) একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখেন। তিনি দেখতে পান তাঁর সাহাবীরা কাবা ঘরের চারদিকে হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা পালনে রত। তিনি সকালে তাঁর সাহাবীদের এ ঘটনা বললেন। স্বপ্নের খবরে সবার মনে আশার আলো জ্বলে উঠলো। অতি শীঘ্রই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে বলে মনে করলেন।
কয়েকদিনের মধ্যেই আল্লাহর নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা:) মুসলমানদের ওমরার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিলেন। জ্বিলকদ মাসে তারা মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। সঙ্গে কুরবানীর উঠের বহরও নিয়ে চললেন। ওমরার এহরাম বেধে নিলেন, যাতে কুরাইশরা তাঁর পক্ষ থেকে যুদ্ধের আশংকা না করে এবং তিনি যে শুধুমাত্র আল্লাহর ঘর জিয়ারত করতে এবং তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়েছেন তা বুঝতে পারে। কিন্তু কুরাইশরা তাদেরকে বাধা প্রদান করলো। কুরাইশদের পক্ষ থেকে ৩ জন দুতকে নবীজী তার আগমনের উদ্দেশ্য বুঝিয়ে খবর পাঠালেও তাদেরকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়। রাসুল (সা:) খিরাস ইবনে উমাইয়া খাযায়ীকে নিজের উঠের পিঠে চড়িয়ে কুরাইশদের কাছে পাঠালেন। তারা রাসুলের উঠকে হত্যা করে এবং খিরাসকেও হত্যা করতে চাইলে অন্যরা তাকে বাঁচিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিল। পরে হযরত উসমান (রা:) কে কুরাইশদের কাছে পাঠালে তারা তাকে বন্দী করে ফেলে। কিন্তু চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে উসমানকে হত্যা করা হয়েছে। উসমান (রা:)-এর হত্যার খবর শুনে রাসুল (সা:) বললেন-কুরাইশদের সাথে লড়াই না করে স্থান ত্যাগ করবো না। তিনি মুসলমানদের লড়াই করার জন্য প্রতিজ্ঞা করালেন। এটাই বাইয়াতুর রিদওয়ান। বাইয়াত সম্পন্ন হয়েছিল একটি বৃক্ষের নিচে। অবশেষে তারা জানতে পারলেন যে উসমান (রা:)-এর নিহত হওয়ার খবর ভূল।
কুরাইশরা রাসুলুল্লাহ (সা:) এর কাছে চতুর্থ ব্যক্তি সুহাইল ইবনে আমরকে পাঠালো। এবার তারা আপোষের প্রস্তাব দিয়ে পাঠালো। এই আপোষ করার একমাত্র লক্ষ্য ছিল মুহাম্মদ (সা:) যেন অবশ্যই এ বছর মক্কায় প্রবেশ করতে না পারেন।
সন্ধির শর্তাবলী নিম্নরূপ-
* রাসুল মুহাম্মদ (সা:) এ বছর মক্কায় প্রবেশ না করে ফিরে যাবেন। আগামী বছর মুসলমানরা মক্কায় আসবেন এবং তিন দিন থাকবেন। তাদের সাথে কোষবদ্ধ তলোয়ার থাকবে। উল্লেখ্য একখানা তলোয়ার সাথে রাখা আরবের পুরুষদের বাধ্যতামূলক ছিল। তাদেরকে মক্কায় তিন দিন থাকতে দেয়া হবে, উত্যক্ত করা হবে না।
* উভয় পক্ষ দশ বৎসর য্দ্ধু বন্ধ রাখবে। কেউ কারো উপর হাত তুলবে না।
* যারা মুসলমান হতে চায় হতে পারবে। যারা কুরাইশদের মতাদর্শে থাকতে চায়, থাকবে। উভয় পক্ষই অন্য গোত্রের সাথে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তাদের বন্ধু গোত্রের উপর বর্তাবে।
* কুরাইশদের কোন লোক যদি নেতার অনুমতি ছাড়া মুহাম্মদের কাছে যায় তাহলে তাকে ফেরৎ পাঠাতে হবে।পক্ষান্তরে কোন মুসলমান যদি কুরাইশদের কাছে আশ্রয় চায় তবে তারা তাকে ফেরৎ দেবে না।
হযরত আলী(রা:) এই চুক্তিটির লিখিত রুপ দেন। রাসুল (সা:) বললেন লিখ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। সুহাইল বললো এটা আমার অজানা কথা। তুমি বরং লিখ বিসমিকা আল্লাহুম্মা। অতপর আলী (রা:) সুহাইল যা বললো তাই লিখলেন। এবার রাসুল বললেন-লিখ আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সা:) সুহাইল ইবনে আমরের সাথে নিম্ন লিখিত সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন। একথা শুনে আমর বললো আমি যদি তোমাকে রাসুল বলে মানতাম তাহলে তো তোমার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতাম না। তুমি লিখ আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বললেন তা-ই হবে। কিন্তু আলী (রা:) রাসুলুল্লাহ শব্দ কাঠতে চাইলেন না। বরং বারবার অপারগতা প্রকাশ করলেন। মুহাম্মদ (সা:) আলী (রা:) কে বললেন ঐ শব্দটা কোথায় আমার আঙুল তার উপরে রাখ। আলী (রা:) তাই করলেন এবং নবীজী নিজ হাতে রাসুলুল্লাহ শব্দটা মুছে দিলেন। এত অসমচুক্তি সম্পাদিত হতে দেখে মুসলমানরা খুবই মনোকষ্টে ভূগছিলেন। হযরত ওমর (রা:) নবী মুহাম্মদ (সা:) কে প্রশ্ন করেন- ইয়া রাসুল আল্লাহ, আপনি কি আল্লাহর রাসুল নন?
মুহাম্মদ (সা:) -অবশ্যই।
ওমর (রা:)-আমরা কি মুসলমান নই?
মুহাম্মদ (সা:)-অবশ্যই।
ওমর (রা:)-ওরা কি মুশরিক নয়?
নবী মুহাম্মদ (সা:)-অবশ্যই।
ওমর (রা:)- তাহলে কেন এই অবমাননাকর চুক্তি সম্পাদিত হচ্ছে?
রাসুল (সা:) বললেন “আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। তাঁর নির্দেশ আমি কখনো লংঘন করবো না। আর তিনি আমাকে কখনো বিপথগামী করবেন না।”পরবর্তীকালে হযরত ওমর (রা:) তাঁর এই আবেগজনিত ভূলের জন্য সারা জীবন নামাজ, রোজা, দাসমুক্ত করে কাফফারা আদায় করেছেন।
চুক্তি সম্পাদন কালেই সুহাইল ইবনে আমরের পুত্র আবু জান্দাল শৃংখলিত অবস্থায় মুসলমানদের কাছে এসে হাজির। কিন্তু তখনও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। আবু জান্দালকে মুসলমানদের কাছে ফেরৎ তো দিলই না, সুহাইল ইবনে আমর বললো আবু জান্দালকে ফেরৎ দিয়ে চুক্তির শর্ত পূরণ আরম্ভ হোক। তাকে ফেরৎ না দিলে সে চুক্তিতে সাক্ষর করবে না বলেও জানিয়ে দিল।
আবু জান্দালের আর্তচিৎকার মুসলমানদের ক্ষোভ আরো বাড়িয়ে দিল। এবার মুহাম্মদ (সা:) কুরবানী করে ইহরাম খুলে ফেলতে সাহাবীদের নির্দেশ দিলেন। তিনবার নির্দেশ দেয়ার পরও সাহাবীরা আগ্রহ দেখালেন না। ঐ সময় রাসুলুল্লাহ (সা:) বিষন্ন মুখে তাবুতে চলে গেলেন। তখন তাঁর সফরসঙ্গী স্ত্রী ছিলেন উম্মুল মু’মিনিন হযরত উম্মে সালমা (রা:)। নবীজীকে বিষন্ন দেখে উম্মুল মু’মিনিন বললেন-ইয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম আপনার কি হয়েছে? তিনি বললেন-কখনো আমার সাহাবীরা আমার কথা অমান্য করেননি, কিন্তু আজ তারা আমার কথা শুনতেছে না। উম্মে সালমা বললেন-কষ্ট পাবেন না, আপনি নিজে কুরবাণী করে ইহরাম মুক্ত হয়ে যান। দেখেন আপনার সাথীরা কি করেন। সত্যিই তার পরামর্শে কাজ হলো। রাসুল (সা:) কুরবানী করতেই সকল সাহাবী তাদের পশু কুরবানী করে ইহরাম মুক্ত হলেন।
হুদাইবিয়ার সন্ধির পর শান্তির যে নবযুগ রচিত হয়েছিল এতে মুসলমানরা ইসলামের দাওয়াত, প্রচার এবং দ্বীনের তাবলীগ করার গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ লাভ করেছিল। এ সময় ইসলামের দাওয়াত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। রাসুল (সা:) অনেক বাদশা ও আমীরের কাছে ইসলামের দাওয়াত চিঠির মাধ্যমে পৌঁছে দেন। এ চুক্তি অনুসারে দশ বৎসর এই অঞ্চলের শান্তি বিরাজমান থাকার কথা ছিল।
হুদাইবিয়ার সন্ধিতে যেসব বিষয়ের প্রতি স্বাক্ষর করা হয়েছিল তার প্রতি মহানবী (সা:) ও তাঁর অনুসারীগণের বিশ্বস্ততা ছিল স্পষ্ট। অপর পক্ষে কুরাইশ বংশীয় মুশরিকদের কপটতা ও বিশ্বাসঘাতকতা কিছু দিনের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যায়।
হুদাইবিয়ার সন্ধির তৃতীয় ধারা অনুযায়ী-মুসলমান ও কুরাইশরা যে কোন গোত্রের সাথে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে। সে অনুযায়ী ‘খুজাআহ্’ গোত্র মুসলমানদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং স্বাভাবিকভাবে তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব মুসলমানদের উপর বর্তায়।
কিন্তু সন্ধির দু’বছর যেতে না যেতেই কুরাইশরা শান্তি চুক্তি ভঙ্গ করে রাতের আধারে বনী বকর গোত্রকে অস্ত্র সরবরাহ করে নিজেরা পেছনে থেকে খুজাআহ্ গোত্রকে আক্রমণ করে ঘুমন্ত ও ইবাদতরত মানুষকে হত্যা করে এবং বাকীদের বন্দী করে। খুজাআহ গোত্রের গোত্রপতি মদিনায় মসজিদে নববীতে রাসুল (সা:)-এর কাছে পৌঁছে অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ভাষায় তাদের অত্যাচারিত হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করে সাহায্য কামনা করেন। তিনি বলেন-“মধ্যরাতে ঘুমন্ত অথবা রুকু সিজদারত নিরস্ত্র মানুষের উপর হামলা করে কুরাইশরা সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করেছে। আমরা যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি তখন গণহত্যার শিকার হয়েছি।” কুরাইশরা নিজেরা সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করে অন্যায় করেছে এবং রাসুল (সা:) তাদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন ভেবে তারা আবু সুফিয়ানকে মদিনায় রাসূলের ক্রোধ প্রশমন ও দশসালা চুক্তিটির অনুমোদন ও নবায়ন করার জন্য পাঠালো। আবু সুফিয়ান মদিনায় প্রবেশ করে সরাসরি নিজ কন্যা উম্মে হাবিবার কাছে যায়।
উল্লেখ্য উম্মে হাবিবা মহানবী (সা:) এর স্ত্রী ছিলেন। সেখানে সে মহানবীর তোষকের উপর বসতে চাইলে তার কন্যা তৎক্ষনাৎ তা গুটিয়ে ফেলেন। আবু সুফিয়ান তার মেয়েকে বললো- তুমি কি বিছানাকে তোমার পিতার অনুপযুক্ত মনে করছ, নাকি তোমার পিতাকে এর অনুপযুক্ত মনে করছ? তিনি বললেন-‘এ বিছানা মহানবী (সা:)-এর, আর তুমি একজন কাফির। তাই আমি চাই না, একজন অপবিত্র কাফির ব্যক্তি মহানবীর পবিত্র বিছানার উপর বসুক।’ আবু সুফিয়ান ভীষণ রাগান্বিত হয়ে মেয়ের গৃহত্যাগ করে। আবু সুফিয়ান অতপর রাসুলের সাহাবীদের সাথে যোগাযোগ করে রাসুলের কাছাকাছি যেতে চাইলেও কোন ফল হলো না।
রাসুলের জীবনে দেখা যায় যে তিনি সবসময় চেষ্টা করতেন যাতে শত্রু সত্যের সামনে মাথানত করে। আর তিনি কখনো শত্রুর কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ ও তাকে ধ্বংস করার অভিপ্রায় পোষন করতেন না।
পবিত্র মক্কা নগরী বিজয় ও মূর্তিপূজার সবচেয়ে সুরক্ষিত ও মজবুত দূর্গের পতন এবং কুরাইশদের জালিম প্রশাসন উচ্ছেদ করার জন্য মহানবী (সা:) রণপ্রস্তুতির কথা ঘোষণা করলেন। তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন কুরাইশদের গুপ্তচররা যেন মক্কা আক্রমণের খবর পৌঁছে না দেয়। কারণ কুরাইশরা সমর প্রস্তুতি নিলে রক্তপাত অনিবার্য হয়ে পড়বে। দশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে রাসূলের যাত্রার প্রাক্কালে হযরত জিবরাঈল (আ:) রাসূলকে জানালেন-‘সারাহ’ নামক এক মহিলা মক্কায় আক্রমণের খবর পৌঁছে দেবে বলে চিঠি নিয়ে যাচ্ছে। বদরী সাহাবী ‘হাতিম’ তার স্ত্রী সন্তানদের রক্ষার স্বার্থে এমন কাজ করেছেন। মহিলাকে মক্কায় পৌঁছার আগেই ধরে ফেলা হলো এবং তার কাছ থেকে চিঠি উদ্ধার করা হলো।
হিজরী অষ্টম বর্ষের দশ রমজান দশ হাজার সৈন্য নিয়ে রাসুল (সা:) যাত্রা শুরু করেন। নবীজী মদিনা থেকে বের হয়ে সৈন্য দলের অনুশীলন স্থলে পৌঁছে পানি আনিয়ে রোজা ভঙ্গ করেন এবং সাহাবীরাও তাকে অনুসরণ করেন। কিন্তু অনেকে ভাবলেন রোজা রেখে যুদ্ধ করলে বেশী সওয়াব পাওয়া যাবে। তাদের উদ্দেশ্যে কুরআনে আয়াত নাজিল হলো-“হে ঈমানদারগণ তোমরা মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের চেয়ে অগ্রগামী হয়ো না।” (সূরা হজরাত-১)
রাসুলুল্লাহ (সা:) এর চাচা হযরত আব্বাস (রা:) অনেক আগে ইসলাম কবুল করেছিলেন, কিন্তু বিভিন্ন কারণে হিজরত করতে দেরী হয়ে যায়। অবশেষে তিনি হিজরত করে মক্কা থেকে বের হয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে মুসলিম বাহিনীর সাথে দেখা। তাঁর মধ্যস্থতায় বিনা যুদ্ধে মক্কা বিজয় অনেক সহজ হয়েছিল।
মহানবী (সা:) মক্কাবাসীদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার, মক্কার বাসিন্দাদের প্রতিরোধ ছাড়াই আত্মসমর্পণ এবং বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয়ের জন্য সৈন্যবাহিনীর প্রত্যেককে পৃথক পৃথক ভাবে উঁচু উঁচু এলাকায় আগুন জ্বালাতে নির্দেশ দিলেন। মক্কাবাসীরা রাতের আধারে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখার উজ্জ্বল রেখা সবগুলো পাহাড় ও উঁচু এলাকা ছেয়ে ফেলতে দেখলো। তারা ভীত হয়ে পড়লো। হযরত আব্বাস (রা:) রাসূলের সাদা খচ্চরে চড়ে মক্কার দিকে রওয়ানা হলেন। তিনি দূর থেকে আবু সুফিয়ান ও বুদাইল ইবনে ওয়ারকার কথোপকথন শুনতে পান। আবু সুফিয়ান-‘আমি এ পর্যন্ত এতো প্রচন্ড আগুন এবং এত বিশাল সেনাদল দেখিনি’। বুদাইল ইবনে ওয়ারকা-‘তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। খুজাআহ্ গোত্র হবে।’ আবু সুফিয়ান-‘যারা এত প্রকান্ড আগুন প্রজ্জ্বলিত করেছে এবং এত বড় সেনা ছাউনি স্থাপন করেছে তাদের চেয়ে খুজাআহ গোত্র সংখ্যায় অতি অল্প’। ঠিক সে সময় হযরত আব্বাস তাদের কাছে পৌঁছে আবু সুফিয়ানকে বলেন-“মহান আল্লাহর শপথ, এ অগ্নিকুন্ড ও শিখাগুলো সবই মুহাম্মদের সৈন্যের। তিনি এ শক্তিশালী সেনাদল নিয়ে কুরাইশদের কাছে এসেছেন। কখনই এই সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কুরাইশদের হবে না।” তখন আবু সুফিয়ান করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে হযরত আব্বাস তাকে রাসুলের কাছে গিয়ে নিরাপত্তা প্রার্থনা করার পরামর্শ দিলেন। আবু সুফিয়ান তৎক্ষনাৎ রাজি হয়ে খচ্চরের পিটে চড়ে বসলো। তিনি আবু সুফিয়ানকে পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্যদের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুন্ডগুলোর মাঝখান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে ওমর (রা:) আবু সুফিয়ানকে আক্রমণ করতে চাইলে আব্বাস বলেন-‘আমি তাকে নিরাপত্তা দিয়েছি। রাসূলের কাছে গেলে রাসুল (সা:) তাকে একটা তাবুতে আটকে রাখতে বললেন। সকালে কথা হবে। সকালে আবু সুফিয়ান ভীত হয়েই ইসলাম কবুল করলেন।
ঐদিন ছিল অষ্টম হিজরীর ১৭ ই রমজান। সকাল বেলা মক্কা অভিমুখে রাসুলের বাহিনী যাত্রা শুরু করে। রাসুল (সা:) তাঁর চাচা আব্বাসকে বললেন আবু সুফিয়ানকে যেন প্রান্তরের পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এতে করে সে পথে আল্লাহর সৈনিকদের ব্রিগেডগুলোর অতিক্রম করা দেখতে পাবে এবং ভয় পাবে আর যুদ্ধ করার মনোবল হারিয়ে ফেলবে। সবশেষ ব্রিগেডে রাসুল (সা:) সহ লৌহবর্ম পরিহিত দল অতিক্রম করার পর আব্বাস বললেন-আবু সুফিয়ান, দ্রুত মক্কায় তোমার কওমের কাছে যাও। আবু সুফিয়ান তাড়াতাড়ি করে মক্কায় পৌঁছে উচ্চকন্ঠে বলতে লাগলো-“হে কুরাইশরা মুহাম্মদ তোমাদের কাছে এতো সৈন্য নিয়ে এসেছেন যে মোকাবিলা করা অসম্ভব। তারা পুরো শহর ঘিরে ফেলেছে। কাজেই মুহাম্মদ আমাকে কথা দিয়েছেন, যে কেউ কাবার প্রাঙ্গণে আশ্রয় নিবে বা মাটিতে অস্ত্র ফেলে দিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে অথবা আমার (আবু সুফিয়ানের) ঘরে প্রবেশ করবে তারা নিরাপদ থাকবে।” মক্কার লোকজন আবু সুফিয়ানের মতো লোকের মুখে এসব কথা শুনে প্রতিরোধের সকল শক্তি হারিয়ে ফেললো। তবু তার স্ত্রী হিন্দ মানুষকে উস্কানি দিচ্ছিল। একদিকে মুসলিম বাহিনীকে তারা প্রতিহত করতে চেষ্টাও করেছিল। সেখানে ১০/১২ জন কাফির মারা যায়। কিন্তু এ বিশাল বাহিনীকে প্রতিহত করতে পারেনি। তিনদিকে প্রবেশকারী সেনা দল পূর্ব নির্দেশ অনুসারে ‘যী তুওয়া’ নামক উঁচু স্থানে পৌঁছে। সেখান থেকে কাবাঘর ও মক্কার বাড়ীঘর সব দেখা যাচ্ছিল। ঐ সময় মহানবী (সা:) পাঁচ হাজার সৈন্যের একটি সেনা ব্রিগেড দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন। নবীজীর চোখ মক্কার বাড়ীঘর ও বায়তুল্লাহয় পড়তেই তাঁর দুচোখ আনন্দাশ্রুতে ভরে যায় এবং কুরাইশদের প্রতিরোধ ছাড়াই যে মহান বিজয় অর্জিত হলো সে জন্য কৃতজ্ঞতায় মাথাটা এতটা নত করেন যে, তার পবিত্র শ্মশ্রু উঠের উপর স্থাপিত গদি স্পর্শ করেছিল।
নবীজী মক্কায় প্রবেশ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে কাবাঘর তওয়াফ করার জন্য হাজরে আসওদের নিকট গিয়ে ইশারা করে তাকবির দিলেন। মহানবীর চারপাশ ঘিরে প্রদীপের চারপাশে ঘূর্ণায়নরত পতঙ্গের মতো আবর্তিত সাহাবীগণ নবীকে অনুসরণ করে উচ্চস্বরে তাকবির দিলেন। তাদের তাকবীর ধ্বনি মক্কার মুশরিকদের কানে পৌঁছলে তারা নিজেদের বাড়ি এবং উঁচু এলাকাগুলোয় গিয়ে আশ্রয় নিল। মসজিদুল হারামে এক অভিনব শোরগোল প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং জনগণের তুমুল হর্ষধ্বনির কারণে মহানবী প্রশান্ত মনে ও চিন্তামুক্ত ভাবে তওয়াফ করতে পারছিলেন না। জনগণকে শান্ত করার জন্য মহানবী তাদের দিকে এক ইশারা করলেন। অল্প সময়ের মধ্যে সমগ্র মসজিদুল হারাম জুড়ে সুনসান নিরবতা নেমে আসে। তিনি তওয়াফ শুরু করলেন। তওয়াফের প্রথম পর্যায়েই পবিত্র কাবার দরজার উপর স্থাপিত হুবাল, ইসাক ও নায়েলা নামক প্রতিমাকে হাতের ছড়ি দিয়ে আঘাত করে বলছিলেন- “সত্য এসে গেছে। বাতিল নির্মূল হয়েছে। নিশ্চয়ই বাতিল নির্মূল হওয়ার মতো।” সূরা বনী ইসরাইল-৮১ নং আয়াত। তওয়াফ শেষে সমস্ত মূর্তি কাবাঘর থেকে অপসারণ করা হলো। তখন মহানবী (সা:) জনতার উদ্দেশ্যে বললেন-“তোমরা কী ভাবছো? কী ধারণা করছো? তখন জনগন হতবাক, অস্থির হয়ে ভাঙা ভাঙা কাঁপা কন্ঠে বললোÑ“আমরা আপনার ব্যাপারে ভালো ধারণা পোষণ করা ছাড়া আর কিছুই ভাবছি না। আমরা আপনাকে আমাদের মহান ভাই এবং ভাই এর সন্তান ছাড়া আর কিছুই মনে করি না।” তাদের আবেগপূর্ণ এ কথাগুলোর মুখোমুখি হলে স্বভাবগত ভাবেই দয়ালু, ক্ষমাশীল, উদার মহানবী (সা:) বললেন-“আমার ভাই ইউসুফ তাঁর অত্যাচারী ভাইদের যে কথা বলেছিলেন, আমিও তোমাদের সে একই কথা বলবো।
“আজকের এ দিনে তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। মহান আল্লাহ্ তোমাদের ক্ষমা করে দিন এবং তিনি সবচেয়ে দয়ালু।” সূরা ইউসুফ-৯২