ইতিহাসে নদী ও সমুদ্রে
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ জুলাই ২০১৯, ১:৫৯:৫৫ অপরাহ্ন
ইতিহাসে নদী ও সমুদ্রে
সারওয়ার চৌধুরী
‘মিথ্যা’ দিয়ে ‘সত্য’ দেখানো
সত্য মানে এখানে, এই যেমন উপরের দিকে থুক মারলে, সোজা উপরের দিকে, থুকদলা এসে আপনার চোখে মুখে পড়বেই। পৃথিবীর অভিকর্ষ শক্তির ভিতরে থেকে এইরকম থুকলে উপরের দিকে, সেটা পড়বেই। এ একটা সত্য। আবার উপরের দিকে আপনার থুক মারার শক্তি যদি মহাশূন্যে ‘চ্যালেঞ্জার’ পাঠাতে, ঐ যে উৎক্ষেপক খাড়া-সোজা মাটি থেকে গেল,ঐ রকম জোরে যদি থু থু মারতে পারেন, তাহলে আর থুকদলা আপনার মুখে পড়বে না, অভিকর্ষ ফুঁড়ে অবারিত স্পেসের দিকে ছুটবে, এও এক সত্য।
তো এ রকম সত্য গল্প লিখে, মিথ্যা চরিত্রের মাধ্যমে দেখানো যায়। মানে, সাহিত্যের মাধ্যমে এ রকম কিছু সত্যও দেখানো হয়। আবার এরিস্টটলের সাথে হেরাক্লিটাসের সাক্ষাত দেখিয়ে একটা স্টোরি আছে, যে-স্টোরির সারমর্ম চমৎকার সত্য দেখায় ঠিক, কিন্তু দুইজনের জন্ম ব্যবধান বিস্তর। মানে, প্লেটো ও এরিস্টটলের অনেক আগে দুনিয়া খেয়ে গিয়েছিলেন হেরাক্লিটাস। খৃষ্টপূর্ব ৫৩৫ এ জন্ম হেরাক্লিটাসের। আর এরিস্টটল আসছিলেন খৃষ্টপূর্ব ৩৮৪ সালে। হেরাক্লিটাস মারা যান খৃষ্টপূর্ব ৪৭৫ সালে। মানে এরিস্টটলের জন্মের ৯১ বছর আগে হেরাক্লিটাস ইন্তেকাল করেছিলেন ৬০ বছর বয়সে।
কিন্তু এরিস্টটল আর হেরাক্লিটাসের সমুদ্র সৈকতে সাক্ষাতের গল্পটি একটি মিথ্যা গল্প, ঐতিহাসিক সত্য না। (এই গল্প সদগুরু জগ্গি বাসুদেবও প্রচার করেছেন)। কারণ, এরিস্টটলের সময়ে অসাধারণ সাধক হেরাক্লিটাস জীবিত ছিলেন না।
এ গল্পটি হিউম্যান ইন্টেলেক্টের তুচ্ছতা দেখায় চমৎকারভাবে।
দেখায় বুদ্ধিজীবি/দার্শনিক এরিস্টটলের মুখে হাসি আসে না মাসের পর মাস বুদ্ধি চর্চার কারণে। কিন্তু যে-কারণকে তিনি বোকামী মনে করে হাসলেন, ওটা হাসির বিষয় ছিল না, ছিল অতুলনীয়-ইন্টেলেক্টেরই অসাধারণ আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের-বিস্ময়কর বোধশক্তির।
সংক্ষেপে গল্পটি হল-
এরিস্টটল সমুদ্র সৈকতে হাঁটছিলেন আর ভাবছিলেন। এক পর্যায়ে দেখলেন এক লোক খুব সিরিয়াসলি চামচ নিয়ে সমুদ্রের পানি আনতে যায় আর চামচে পানি নিয়ে এসে সৈকতে একটা ছোট গর্তে ঢালে। লোকটার সিরিয়াসনেস দেখে, এরিস্টটল জিজ্ঞেস করেন-
‘এই যে কী করেন আপনি?’
লোকটির জবাব-‘খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতেছি, আমারে ডিস্টার্ব দিয়েন না।’
আবার ভাল করে খেয়াল করে দেখলেন এরিস্টটল কী সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বুঝবার জন্যেই আবার জিজ্ঞেস করেন-
‘এইটা কী ধরণের গুরুত্বপূর্ণ কাজ একটু বলেন?’
লোকটি বললেন-
‘এই সমুদ্রটারে এই গর্তে ঢুকাইতেছি চামচে নিয়ে।’
এরিস্টটল দিলেন ঠা ঠা হাসি। আর মশকারি মারলেন তার উদ্দেশে-
‘তো এই চামচ দিয়ে কেন? একটা বালতি নেন কমপক্ষে। এইটা ত খুব হাস্যকর!’
লোকটি চামচ ছুঁড়ে ফেলে বললেন-
‘শেষ আমার কাজ।’
এরিস্টটল বললেন-
‘সমুদ্র রয়ে গেল তার জায়গায়, আপনি আপনার গর্তই ভরতে পারলেন না, কাজ ছেড়ে দিলেন! আপনি একটা ভাল টাইপের পাগল দেখতেছি।’
লোকটি বললেন-
“আপনি আমার এই সমুদ্র গর্তে ভরার কাজটাকে হাস্যকর বুঝলেন, আপনি জানেন কি অস্তিত্ব কতো বিশাল ব্যাপার? বিলিয়ন বিলিয়ন মহাসমুদ্রের চাইতেও বিশাল। এই বিশালতাকে আপনি চিন্তা নামের চামচ দিয়ে আপনার মাথার ছোট গর্তে ভরবার চেষ্টা করতেছেন। ব্যাপারটা হাস্যকর না?”
এরিস্টটল অবাক? কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না।
বলা হয়, এই লোকটি হলেন হেরাক্লিটাস, যার ইন্টেলেক্টের সামনে এরিস্টটলের ইন্টেলেক্ট থেমে গেল।
উল্লেখ্য, গর্ত আর সমুদ্র আর চামচ মিথ্যা। এরিস্টটল আর হেরাক্লিটাস চরিত্রও মিথ্যা। এসব মিথ্যা দিয়ে সত্য বিষয়ক একটা উপলব্ধি দেখানো হয়েছে।
অতএব, কথা এই যে, ইন্টেলেক্টের ফোট্টাই দেখাতে মশগুল যারা, তারা তার আশপাশের সৌন্দর্য দেখে না, হাসি কান্নায় দোলে না, তারা ভোরের সূর্যোদয় দেখে না, সন্ধ্যার বেদনাবোধ ধারণ করবার টাইম নাই, অন্তরের তা তা থৈ থৈ উপলব্ধিতে নিতে পারে না, ভালোবাসা বুঝতে পারে না, মেটেরিয়েল এক্সপে-নেশন খাড়া করেন। তারা দেখে না— ‘সহ¯্র’ জোনাকি মিটিমিটি হাসছে, সবুজ ঘাসজলে… অসম্ভব ঐকতানিক’(উড্ডয়নলীন রাত্রীর গান-নাঈম ফিরোজ)।
সবশেষে সাধক মানুষ হেরাক্লিটাসের একটি কথা স্মরণ করা যাক। বলেছিলেন- ‘সূর্য প্রতিদিনই নতুন হয়ে আমাদের মাঝে আসে।’
লেখক: জালাল উদ্দিন রুমি গবেষক, অনুবাদক, কবি, আবুধাবি থেকে।