আজ ফাইনাল : কে গাইবে বিশ্বজয়ের গান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জুলাই ২০১৯, ৫:৩৮:০৬ অপরাহ্ন
আহবাব মোস্তফা খান, লর্ডস থেকে ::
নিজ ঘরে ফাইনাল। অথচ নেই উন্মাদনা, নেই বাদ্যের তাল, নেই আবেগের অসহ্য বিস্ফোরণ। ফাইনালের একদিন আগেও শান্ত নীরব। ‘হোম অব ক্রিকেট’ লর্ডস সেজেছে সাজের মায়ায়। শেষের রোমাঞ্চ নির্বিঘœ করতে বেড়েছে মাঠকর্মীদের দৌড়ঝাপ। কিন্তু নেই বাড়তি কোন উচ্ছাস। অথচ এখানে আজ নিউজিল্যান্ডের সাথে বিশ^জয়ের লড়াইয়ে নামবে ইংল্যান্ড। তবে কে জানে, হয়তো আজকের জন্যই সকল উচ্ছাস জমা রেখেছে তারা। দিনশেষে হয়তো তারাই গাইবে বিশ^জয়ের গান…।
কাল সকাল ১১ টা। আকাশে তখন মেঘ-রোদের লুকোচুরি। রোদ উঁকি দেয় তো মুহূর্তে এক খন্ড মেঘ এসে আবার রোদকে আড়াল করে দেয়। প্রকৃতির এমন আবহের মাঝে লর্ডসের মুল প্রবেশ গেট পার হয়েই দেখা গেলো ব্যলকনীতে দুই ফাইনালিস্ট দেশের পতাকা উড়ছে নির্ভয়ে। মাঠকর্মীরা ব্যস্ত মাঠ পরিচর্যায়। তাদের ধোয়া মোছায় সাদা সফেদ চেয়ারগুলো হয়ে উঠছে আরো সাদা। অন্যদিকে, আইসিসির গ্রাউন্ড স্পেশালিস্টরা ব্যস্ত মুল মাঠের পর্যবেক্ষনে। এমন সময় হঠাত দেখা গেলো ইয়ান মর্গ্যান বাহিনীর মাঠে প্রবেশ। এর একটু পরেই আসলো উইলিয়ামসনের দল। মাঠে নেমেই ব্যাট-বলের নিভিড় অনুশীলন। এরমাঝে একদলের সাথে আরেক দলের খেলোয়াড়দের খুনসুটি, হাসি-ঠাট্টা নজর কাড়লো সাংবাদিকদের। এমন সময় একজন মাঠ কর্মীর সতর্ক উচ্চারন, আজ সবাই হাসছেন একসাথে। কাল (আজ) দিনের শেষে এই হাসি কাদের থাকবে তাই দেখার বিষয়। তবে ওই মাঠকর্মীর কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিলো কে জিততে পারে আজ। তখন তার সতর্ক উক্তি, ‘যে ভালো করবে সেই জিতবে’।
আসলে ফাইনাল দিনের আগে একজন ক্ষুদ্র মাঠকর্মীর মতো একই কথা তো হতে পার ক্রিকেট বোদ্ধাদেরও। আজ যে ভালো করবে সে-ই তো জিতবে। এরমাঝে একটা দল গতবারের রানার্স-আপ। আর অন্য দলটি ২৭ বছর পর বিশ্বকাপের ফাইনালে। বিশ্বজয়ের স্বাদ থেকে বঞ্চিত দুই দলই। তাই এবার নয়া ইতিহাস রচিত হবে বিশ্ব ক্রিকেটে। কিন্তু সোনালি আখরে কার নাম লেখা হবে সোনালী পাতায় সেটাই এখন প্রশ্ন। আর সেই প্রশ্নের উত্তর মিলবে আজ সুর্য ডোবার আগেই, গোধূলী বেলায়। যদি প্রকৃতি তাতে বাধ না সাধে।
এবার শিরোপা জয়ের পাল্লা কার ভারী সেটা নিয়েই আলোচনা বিশ^ময়। দ্য টেলিগ্রাফ লিখেছে ‘ছন্দ ঠিক থাকলে জয় ইংল্যান্ডেরই’। আর গার্ডিয়ান তো থরেই নিয়েছে ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন। আসলেই তাই। মাঠে বল গড়ানোর আগে কিন্তু পাল্লা ভারী স্বাগতিকদেরই। বিশ্বকাপের শুরুতে অনেক বিশেষজ্ঞই ইংল্যান্ডকে সম্ভাব্য বিজয়ী বলছিলেন। শুরুও করেছিল ইংল্যান্ড সেই ভাবেই। কিন্তু মাঝে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে হঠাৎ-ই তাঁদের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যাওয়া নিয়ে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। তবে পরে ইংল্যান্ড বুঝিয়ে দেয় কেন তারা ঘরের বিশ^কাপে ফেবারিট। শক্তিশালী ভারতকে রীতিমত মাটিতে নামিয়ে এনে তারা ইঙলিশ উতসবের আভাস দেয় টেমসের তীরে। বুঝিয়ে দেয় একদিন খারাপ গেলেও তাঁরা সত্যি বিশ্বকাপের দাবিদার। তবে ইংল্যান্ড যতই ফেভরিট হোক, লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত উইলিয়ামসনরাও। সেমিফাইনালেও তাঁরা আন্ডারডগ হিসেবেই নেমেছিলেন। কিন্তু সব সমীকরণ ভুল প্রমাণ করে শিরোপাকে াতি কাছে দেখা ভারতকে হারিয়েই ফাইনালে পৌঁছে যায় কিউয়িবাহিনী। আর এই জয়ই তো নিঃসন্দেহে ফাইনালে আত্মবিশ্বাস জোগাবে নিউজিল্যান্ডকে। এবার দেখার পালা হাইভোল্টেজ লড়াইয়ে কে হাসে শেষ হাসি।
ফাইনাল নিয়ে কাল সাংবাদিকদের কাছে মর্গ্যানও বললেন, ‘‘আমাদের কোনও চাপ নেই। নিজেদের যোগ্যতায় লর্ডসে ফাইনাল খেলার টিকিট অর্জন করেছি। ফাইনালটাও উপভোগ করব। আশা করছি, সে ভাবেই সাফল্য আসবে।’ চার বছর আগের বিশ্বকাপে প্রাথমিক পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল ইংল্যান্ড। কিন্ত এবার আমরা ভিন্ন এক ইংল্যান্ড। তিনি বলেন, আমি স্বপ্নেও ভাবিননি, আমার নেতৃত্বে ইংরেজ ক্রিকেটাররা ২৭ বছর পরে বিশ্বের সব চেয়ে বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলবে। তা-ও অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিশালী দলকে সেমিফাইনালে হারিয়ে। আবেগে ভাসতে থাকা ইংরেজ অধিনায়ক বলেছেন, ‘ প্রত্যেক ক্রিকেটার মাঠে এবং ড্রেসিংরুমে ক্রিকেট উপভোগ করেছে। গোটা দলটা মারাত্মক মাথা ঠান্ডা রেখে খেলছে। সবার ভাবনা এরকম যে, যেন আমরা কোথাও ঘুরতে বেরিয়েছি। আর কিউই অধিনায়ক উইলিয়ামসন সবসময়ের মতো বিনয়ের শেষটুকুই ঢেলে দিলেন। বললেন, ইংল্যান্ড অনেক ভালো ক্রিকেট খেলছে। আর ঘরের মাঠে তো তারা ফেবারিটই। তবে আমরাও জয়ের ক্ষমতা রাখি। সেটা আমরা দেখিয়েছি ভারতকে সেমিতে হারিয়ে। তাই বিশ^কাপ শিরোপা আমাদেরও হতে পারে।
তবে মর্গ্যান- উইলিয়ামসনের এমন কথার মাঝে অতীতকেও একটা শক্তি ভাবছেন ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা। গত দুই বিশ্বকাপের দিকে তাকালে দেখা যাবে, হোম ফেভরিটরাই ট্রফি ঘরে তুলেছে। ২০১১ সালে ধোনির ইন্ডিয়া আর ২০১৫ তে অস্ট্রেলিয়া। তাই সাম্প্রতিক রেকর্ড বলে এবারও বিশ^ শিরোপা ঘরে উঠছে ইংল্যান্ডের। আর এর প্রত্যাশা মতোই বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছেছে মর্গ্যানরা। ২৭ বছর পর টুর্নামেন্টের ফাইনালে পৌঁছে একই ভুলের আর পুনরাবৃত্তি চায় না ইংল্যান্ড। ১৯৯২ বিশ্বকাপে ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে হেরে রানার্স-আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল ইংলিশবাহিনীকে। এবার থ্রি লায়ন্সের হোম কামিংয়ের পালা। গত বছর রাশিয়ায় ফুটবল বিশ্বকাপে স্বপ্ন দেখিয়েও হতাশ করেছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু এবার ফুটবলের সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি চায়না কেউ ক্রিকেটে। ফুটবলের সেই শিরোপা ক্ষুধা এবার ক্রিকেটেই মেটাতে চায় ইংল্যান্ড। এমনটা বলছে বিবিসিও।
এদিকে, ফুটবল জোয়ারের এই দেশে একটি শিরোপাই যেন ইংল্যান্ডে ক্রিকেট জোযার এনে দিতে পারে-এমনটা বলছে দ্য টেলিগ্রাফ। আর সেই সম্ভাবনাও দেখা দিযেছে ইতিমধ্যে। প্রায় ১৪ বছর পর ইংল্যান্ডে ক্রিকেট দেখা যাবে ‘ফ্রি টু এয়ার’ চ্যানেলে। এতে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়বে। ফুটবলের দেশে অভিজাত খেলার পরিচিতিও বাড়বে। আর এই জনপ্রিয়তায় হয়তো ক্রিকেটের বিশ^ায়ন হবে। এমনটা আশা ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডেরও।
এদিকে, ফাইনালের টিকিটের জন্য ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড সমর্থকদের মধ্যে হাহাকার চলছে। কারণ বেশির ভাগ টিকিট ভারতীয় সমর্থকদের দখলে, হয়তো তারা ধরেই নিয়েছিলো যে তারা ফাইনাল খেলবে। অথচ সেই ভারত ফাইনালেই নেই। তাই এখন ফাইনালিস্ট দলগুলোর সমর্থকরা পাচ্ছেননা টিকিটি। এ নিয়ে ভাবনায় খোদ আইসিসি। যদি টিকিট কেটে ভারতীয় সমর্থকরা মাঠে না আসে তাতে ফাইনালের রঙিন মঞ্চটা থাকবে দর্শকহীন। আর এমন দর্শকহীন মাঠে শিরোপা উতসব হবে কিভাবে?