ভ্রমণ : রাগ করে রাঙামাটি
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ জুলাই ২০১৯, ৫:৪৩:২৮ অপরাহ্ন
।। মুশাহিদ বিন মুছাব্বির ।।
শহর কিংবা গ্রাম সব জায়গাতেই নগরায়নের ছোঁয়া। বসতবাড়ী বাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল সব কিছুতেই নির্দিষ্ট নিয়মের ভিতরে থাকতে হয়। দৃষ্টির সীমানায় সবুজ এখন নিশ্চিহ্ন। খোলা মাঠে শিশু, কিশোর, তরুনদের দৌড়ঝাঁপ আজ দু:স্বপ্নে পরিনত হয়েছে। বিনোদন হতে চরমভাবে বঞ্চিত হচ্ছে কোমলমনা ছোট্ট সোনামনিরা। বিনোদন বলতে এখন যা বুঝায় তাহলো টিভি, কার্টুন কিংবা গেম-শো। আর শিশুদের হাতে ‘ট্যাব’ তো আছেই। এসব থেকে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম উগ্র হয়ে যাচ্ছে। কোন কোন শিশু ইন্টারনেটে বিভিন্ন প্রোগ্রাম দেখে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে তাদের স্বভাব চরিত্র।
বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে আবেগ কিন্তু নিয়ে গেছে বেগ। শিশুদের এমন হয়ে উঠার পেছনে যে কারনগুলো দায়ী তা হলো প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে না উঠা। খোলা প্রান্তর, সবুজের সমারোহ আর শিশুদের বিনোদনের অপ্রতুলতা। এত্তোসব ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে হলে একবার ঘুরে আসুন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি। সত্যিকার অর্থে রাগ করে গিয়েছিলাম রাঙামাটি। সঙ্গী এবং সাথী না পেয়ে লালাবাজারের নিজগাঁওর শাহরিয়ার আহমদ ইমন কে নিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলাম। সে কাহিনী এখানে নয়, অন্যখানে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাঙামাটি জেলা। ঢাকা থেকে সড়ক পথে তার দূরত্ব ২৬৪ কিলোমিটার আর চট্টগ্রাম শহর থেকে ৭৭ কিলোমিটার। পাহাড়, নদী ও লেক বেষ্টিত একটি বৈচিত্র্যময় জনপদের নাম রাঙামাটি। পাহাড়ী ও বাঙালীসহ মোট ১৪টি জনগোষ্ঠি বাস করে। পাহাড়ের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা সবুজ রুপ আর বৈচিত্রের শ্যামলভূমি দেশী বিদেশী পর্যটকদের মনের মনিকোটায় স্থান করে নিয়েছে। যার জন্য পর্যটকরা বারবার ফিরে আসেন হ্রদ আর পাহাড়ের দেশে। যা দেশের অন্য কোথাও নেই। হ্রদের স্বচ্ছ জলরাশি আর সবুজ পাহাড়ের অপরুপ সৌন্দর্য পর্যটকদের সহজেই আপন করে নেয়।
রাঙামাটি জেলার একটি হৃদের পানি প্রবাহের সময় লাল দেখাতো বলে রাঙামাটি নামকরন হয়। আবার কেউ মনে করেন মাটির রং লাল বলে এ জেলার নামকরন হয় রাঙামাটি।
৬১১৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জেলার উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, দক্ষিনে বান্দরবান জেলা, পূর্বে ভারতের মিজোরাম রাজ্য ও মায়ানমারের চিন প্রদেশ এবং পশ্চিমে খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলা। জেলার বিস্তীর্ন জায়গা জুড়ে রয়েছে কাপ্তাই লেক। যার আয়তন ১৭১২ বর্গকিলোমিটার। ১৯৬০ সালে পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে কাপ্তাই বাঁধ নির্মানের ফলে কর্নফুলি হ্রদের সৃষ্টি হয়। এই কর্নফুলি নদী ভারতে লুসাই পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এ হ্রদের সাথে কর্নফুলী সহ কাচালং ও মাইনি নদীর রয়েছে নিবীড় সম্পর্ক। সবুজ গাছপালায় আচ্ছাদিত উচু নিচু পাহাড়, গভীর মমতা আর ভালোবাসায় ভরা অপূর্ব সুন্দরও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মিলিত আহবান এই কাপ্তাই লেক। প্রকৃতির সব রূপ ও রং যেন এখানে মিশে আছে একাকার হয়ে। এরই সাথে আছে জীব বৈচিত্রের অপূর্ব সংমিশ্রন। দেশের সবচে বড় জেলা রাঙ্গামাটির ভৌগলিক বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য এবং বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও সংস্কৃতি যোগ করেছে এক ভিন্ন মাত্রা। ১৯৮৫ সালে জেলার মর্যাদা পায় রাঙ্গামাটি। এবং রিকশা বিহীন হওয়ায় পরিবেশ বান্দব শহরের স্বীকৃতি পেয়েছে এ জেলা। রাঙ্গামাটি শহরের প্রবেশ পথেই রয়েছে উপজাতীয় জাদুঘর। এ জাদুঘরের পাশাপাশি রয়েছে ‘রাজবন বিহার’। বিহারের পাশাপাশি আছে একটি দ্বীপে চাকমা রাজার রাজবাড়ী। নৌকা যোগে খুব সহজেই যাওয়া যায় এই রাজবাড়ীতে।
জেলা সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান। ১৩ হাজার একর জায়গা নিয়ে কর্নফুলি নদীর কোল ঘেঁষে কাপ্তাই উপজেলায় গড়ে উঠেছে এ উদ্যান। এখানে আছে বিচিত্র বন্যপ্রাণী ও পাখ-পাখালির অবাধ বিচরণ। বর্ষাকালে মেঘ পাহাড়ের মিতালী আর শীতে কুয়াশার লুকোচুরী এক বিচিত্র আমেজ তৈরি করে। সেগুন, জারুল, গামার, কড়ই, প্রভৃতি গাছে ভরা এ উদ্যানে চলতে চলতে ক্লান্তিবোধ করলে বিশ্রামের জন্য ২টি বিশ্রামাগার আছে।
এছাড়াও কাপ্তাইয়ে রয়েছে চট্রগ্রামের বৃহত্তর ও মনজুড়ানো চা বাগান। ‘কাদেরী টি স্টেট’ পরিচালিত এই বাগানটি পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত মনোরম ও উপভোগ্য। রাঙামাটি শহরের শেষ প্রান্তে রিজার্ভ বাজার ছাড়িয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে রয়েছে পর্যটন কমপ্লেক্স। যা ১৯৮৬ সালে গড়ে উঠেছে। এই এলাকা ‘ডিয়ার পার্ক’ নামেই বেশী পরিচিত। আর এখানেই আছে সবার চেনা সেই সুন্দর ঝুলন্ত ব্রীজ। ক্যালেন্ডার, পর্যটকের পোষ্টার, পত্রিকার পাতা কিংবা বিনোদন সংবাদে বিশেষ করে ঈদের সময় রাঙামাটির এই ঝুলন্ত সেতুটির ছবি দেখা যায়। কর্নফুলি হ্রদের ৩৩৫ ফুট দীর্ঘ এ ঝুলন্ত সেতুটি ইতোমধ্যে “সিম্বল অব রাঙামাটি” হিশেবে খ্যাতি পেয়েছে।
তাছাড়া এখানে আছে অডিটোরিয়াম পার্ক, পিকনিক স্পট, স্পীড বোট এবং দেশীয় নৌ যান। রাঙামাটি সদর হতে ২৫ কিলোমিটার দূরে বরকল উপজেলায় অবস্থিত শুভলং ঝর্ণা। এই পাহাড়ী ঝর্ণাটি ইতোমধ্যে পর্যটকের কাছে ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে। শুভলং ঝর্ণাসহ আরো প্রায় ৮টি ঝর্ণা আছে। এসব ঝর্ণায় পানির প্রবাহের ¯্রােতধারা পর্যটকদের হৃদয়ে এক ভিন্ন অনুভূতির সৃষ্টি করে। এছাড়া আরো আছে সাজেক, কাপ্তাই ইকো পার্ক, টুকটুক ইকো পার্ক, পেদা শ্যুটিং স্পট, ফরমুন পাহাড় সহ অনেক।