বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ জুলাই ২০১৯, ৭:১০:৪৩ অপরাহ্ন
সিলেটে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বিভাগের বেশিরভাগ জায়গায় অনেক লোক পনিবন্দী হয়ে আছেন। এদিকে আগের দিনের তুলনায় গতকাল সোমবার দিনে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও ছিলো বেশি। সিলেট আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সোমবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৩০ দশমিক ১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা গত ২৪ ঘন্টায় ছিলো ১৮ দশমিক ২ মিলিমিটার। বৃষ্টিপাত বাড়ার কারণে নিম্নাঞ্চলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। অনেক জায়গায় লোকজন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন। বিভাগের বিভিন্ন উপজেলা থেকে আমাদের সংবাদদাতারা বন্যা পরিস্থিতির খবর জানিয়েছেন।
সুনামগঞ্জ : আমাদের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জসিম উদ্দিন জানান, গত একসপ্তাহের টানা অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় সুনামগঞ্জে আবারও বাড়ছে সুরমা নদীর পানি। ফলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। শুরুতে ৬টি উপজেলা প্লাবিত হলেও গতকাল থেকে ১১টি উপজেলাই প্লাবিত হয়েছে। জেলার বেশীর ভাগ এলাকার মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছেন। কয়েক হাজার বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। সরকারিভাবে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও বন্যার্তরা আত্মীয় স্বজনের বাড়িতেই বেশী আশ্রয় নিচ্ছেন। ত্রাণ তৎপরতা অপ্রতুল হওয়ায় দুর্গতদের ভোগান্তি ক্রমে বেড়েই চলছে। সরকারি হিসেবে বন্যায় জেলার ৭৪টি ইউনিয়নে ১ লাখ ৪ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু বেসরকারি হিসেবে প্রায় ৩ লাখের মত মানুষ পানিবন্দী আছেন বলে জানা গেছে। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৭৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, যা গত রোববারের চেয়ে ১ সেন্টিমিটার বেশী ছিলো। গত ২৪ ঘন্টায় ৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তবে বৃষ্টিপাত বন্ধ হলে পানি কমবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। রাস্তাঘাট ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে অনেক এলাকা। সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর ও সুনামগঞ্জ-ছাতক সড়কের কয়েটি স্থান পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় জেলা শহরের সাথে সরাসরি যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারন মানুষজন। বন্যার কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন শ্রমজীবী, শিক্ষাথীসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ। তবে বন্যার্তরা জানিয়েছেন যে পরিমাণ চাল ও নগদ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। পানিবন্দী মানুষজনের মধ্যে খাবারের জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোঃ শরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বন্যা দুর্গত মানুষের মাঝে ৬৮৫ মেট্রিক টন জি আর এর চাল, নগদ ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও ৮ হাজার ৪০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। সেই সাথে আরো ৫০০ মেট্রিকটন চাল, নগদ ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকার এবং ৫ হাজার ২৩৫ প্যাকেট শুকনা খাবার মজুদ রয়েছে জেলা প্রশাসনের কাছে।
শাল্লা : আমাদের শাল্লা প্রতিনিধি আনিসুল হক চৌধুরী জানান, শাল্লা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ৪ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে আছেন। ৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষনা করে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৯টি স্কুলে বন্যায় প্লাবিত প্রায় ৫০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে এবং ১০টি স্কুল এরইমধ্যে প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দীন মোহাম্মদ। দিন দিন বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ আজিজুর রহমান জানান বন্যার কারণে উপজেলার চারটি ইউনিয়নে প্রায় ৪ হাজারেরও বেশী পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে।
উপজেলা কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, চারটি ইউনিয়নের প্রতিটিতে একটি করে মনিটরিং টীম গঠন করা হয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে আরো জানা যায়, উপজেলার বন্যা কবলিত মানুষের জন্য আরো দেড়শ প্যাকেট শুকনো খাবার, ২৫ মেট্রিকটন জিআর চাল ও নগদ ৫০হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে।
দিরাই : আমাদের দিরাই প্রতিনিধি ইমরান হোসাইন জানান, উপজেলায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। উপজেলার সহস্্রাধিক ঘর-বাড়ীর বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। পানিবন্দী আছে ২ হাজারেরও বেশি পরিবার। তলিয়ে গেছে ২৫/৩০ টির মতো মাছের খামার। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বন্যার কারনে উপজেলায় সরকারি ছুটি বাতিল করে সবাইকে বন্যার্তদের পাশে থাকতে বলা হয়েছে। উপজেলার ২০ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রয়েছে। দিরাইয়ে ৩৪টি বিদ্যালয়ে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। দিরাই-শাল্লার সংসদ সদস্য ড. জয়া সেনগুপ্তা শাল্লা উপজেলার বন্যা কবলিত কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তিনি বানভাসি লোকজনকে আতঙ্কিত না হয়ে সাহসের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলার আহবান জানিয়ে বলেন, বানভাসিদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রচুর পরিমানে খাদ্য সামগ্রী মজুদ রাখা হয়েছে। সময়মতো সবার কাছে সরকারের সাহায্য পৌছে দিতে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তা/ কর্মচারিরা প্রস্তুত রয়েছেন। দিরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম চৌধুরী জানান, দিরাই উপজেলায় নিচু এলাকার ৬ শতাধিক ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। ভানবাসিদের জন্য দিরাইয়ে ৩৪টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
বিশ্বনাথ : আমাদের বিশ্বনাথ প্রতিনিধি জানান, কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায় অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে পানি। বিপদসীমা অতিক্রম করেছে বাসিয়া ও খাজাঞ্চি নদীর পানি। ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়েছে উপজেলার নিম্নাঞ্চল। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, আমন ধানের বীজতলা ও মাছের ঘের।
সরেজমিন উপজেলার লামাকাজি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, সুরমা নদীর পার্শ্ববর্তী এ ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। ব্যাহত হচ্ছে পানিবন্দী মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। পানিবন্দী গ্রামগুলো হলো- লামাকাজী ইউনিয়নের মির্জারগাঁও, মাহতাবপুর, মাধবপুর, কাজীবাড়ি, রাজাপুর, তিলকপুর, হাজারীগাঁও, আকিলপুর, রসুলপুর, সোনাপুর ও খাজাঞ্চী ইউনিয়নের বাওনপুর, চরগাঁও, তেঘরী। এছাড়াও দশঘর ও দেওকলস ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকাও প্লবিত হয়েছে বন্যার পানিতে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রমজান আলী জানান, সোমবার পর্যন্ত এলাকার চাষকৃত ৫০ হেক্টর আউশ ধানের জমি ও ২০ হেক্টর রোপা আমনের বীজতলা পানির নিচে চলে গেছে। দ্রুত পানি না কমলে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণ হবে।
কমলগঞ্জ : আমাদের কমলগঞ্জ প্রতিনিধি প্রণীত রঞ্জন দেবনাথ জানান, কমলগঞ্জে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নতুন করে ধলাই নদীর কমলগঞ্জের রামপাশায় আরও একটি ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে ধলাই নদীতে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে মোট ৪টি। এসব ভাঙ্গনে অন্তত ১১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যাক্রান্ত প্রায় ৮শত পরিবার। আদমপুর ইউনিয়নের হকতিয়ারখোলা ও রহিমপুর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর গ্রামে ধলাই প্রতিরক্ষা বাঁধে ২টি নতুন ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। উপজেলার নতুন-নতুন এলাক প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ভাঙ্গন দিয়ে কমলগঞ্জের পৌরসভা, রহিমপুর, আদমপুর, পতনঊষার, মুন্সীবাজার ও শমশেরনগর, কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের ১১৫ টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, বন্য্ াদুর্গতদের জন্য ইতিমধ্যে ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার ইতিমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এদিকে সোমবার কমলগঞ্জ পৌর এলাকা ও রহিমপুরে বন্যাক্রান্তদের মাঝে শুকনো খাবার ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশেকুল হক বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি সার্বক্ষনিক মনিটরিং করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কমলগঞ্জে ১২ মেট্রিক টন চাল ও ২০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও ইতিমধ্যে বেশকিছু শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে বন্যা কবলিত গ্রামহগুলোতে।