সত্য প্রকাশে লেখালেখি-সাহিত্যচর্চাও একটি সংগ্রাম
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুলাই ২০১৯, ১:৪২:৪৮ অপরাহ্ন
সত্য প্রকাশে লেখালেখি-সাহিত্যচর্চাও একটি সংগ্রাম
।। এহসান বিন মুজাহির ।।
লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চা অন্যতম একটি সংগ্রাম। দ্বীনি প্রেক্ষাপটে এটা একটা ইবাদতও। লেখা আল্লাহর দান। আল্লাহ তায়ালা সকলকে সব বিষয়ে লেখার যোগ্যতা দান করেননি। এই কারণেই সবাই সব বিষয়ে লিখতে অপারগ। মহান আল্লাহ তায়ালা কাউকে কাব্যপ্রতিভা দিয়েছেন, আবার কাউকে সাহিত্যপ্রতিভা দিয়েছেন। কেউ গল্প লিখতে পারে, কেউ উপন্যাস, কেউ গবেষণাধর্মী লেখা, কেউ বর্ণনাধর্মী লেখা লেখতে পারদর্শী। সবাই কিন্তু লেখক না। কেউ কেউ লেখক। মনোযোগী পাঠক ছাড়া লেখক হওয়া দুরূহ ব্যাপার। দুনিয়াতে বড় লেখক হয়ে কেউ জন্ম নেয় না। আবার কেই হঠাৎ করেই বড় লেখক হয়ে যেতে পারে না। কেউ কেউ ভালো লেখক, কিন্তু ভালো বক্তা না। কেউ কেউ ভালো বক্তা, তবে ভালো লেখক না। আল্লাহ সকলকে লেখার যোগ্যতা দান করেননি। এমন অনেক শিক্ষাবিদ আছেন যাদের রচিত বই পড়ে অন্যরা ভালো বক্তব্য দিতে পারেন। কিন্তু তিনি কারো এক মিনিটও কথা বলতে পারেন না। কারো সামনে বক্তব্য দিতে দাঁড়ালে বলার মতো শব্দ খুঁজে পান না। তবে বিপরীত এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা চমৎকার বক্তব্য দিতে পারেন, কিন্তু এক পৃষ্ঠা লেখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। এভাবে আল্লাহ তায়ালা একেকজনকে একক ধরণের প্রতিভা দান করেছেন। লেখার কিছুটা যোগ্যতা যাদের আছে তাদের লেখাকে অভ্যাসে পরিণত করলে ভালো ফলাফল আশা করা যায়। লেখক হতে চাইলে নিরন্তর সাধনায় ডুব দিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন প্রতিভা, আত্মপ্রত্যয়, দৃঢ় সংকল্প, ধৈর্য এবং প্রচুর অধ্যবসায়। ভালো লেখক হতে হলে প্রচুর পড়তে হবে। সর্বোচ্চ সাধনা করতে হবে। নিয়মিত লেখালেখির অভ্যাস থাকলে সময়ের ব্যবধানে লেখক হওয়া যাবে। লেখালেখি রাজপথের দখলদারিত্ব নয়, আবার এ পথ যেমন পুষ্পিত না, তেমনি ফুলাঙ্কিতও না। লেখালেখির রাজপথে সবাই সফলতা অর্জন করতে পারে না। ভালো লেখক হতে হলে গবেষণা ও প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। লেখালেখির দুর্গম পথ ও পথের বিভিন্ন আঁকবাঁক ও চড়াই-উৎরাই পারি দিয়ে সফলতার স্বর্ণশিখরে পৌছতে প্রয়োজন প্রচুর পড়াশোনা, নিমগ্ন সাধনা, প্রশস্ত মন, সৎ সাহস ও অসীম ধৈর্য। ভালো লেখক হতে হলে প্রয়োজন বই পড়াশোনা, নিরন্তর প্রচেষ্টা, অক্লান্ত পরিশ্রম, তীব্র ইচ্ছা, অদম্য স্পৃহা এবং আত্মবিশ্বাস। লেখালেখি করাটা সামাজিক দায়বদ্ধতারই একটি অংশ। তাই একজন লেখক তাঁর সাহিত্য কর্মকে কেবল মনীষার বাহনরূপে নয়, ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্বের প্রকাশ মাধ্যম রূপে, সমাজ চৈতন্যের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রতিমা রূপে দেখতে হবে। লেখককে অনস্বীকার্যভাবে কুসংস্কার, ভীরুতা, জরাজীর্ণতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সত্য ও সুন্দরের আরাধনা করতে হবে, বুদ্ধিবৃত্তির পরিচর্যায় নিমগ্ন হতে হবে।
লেখক হতে চাইলে যা যা দরকার :
লেখক হতে চাইলে প্রথমে মনোযোগি পাঠক হতে হবে। পড়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করতে হবে। পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান কবি, লেখক সাহিত্যিকদের রচিত গ্রন্থসমুহ প্রচুর পড়তে হবে। লেখক হতে চাইলে প্রাথমিক পর্যায়ে অনুশীলন চালিয়ের যাওয়ার বিকল্প নেই তারপর সঠিক নিয়মে পর্যায়ক্রমে চেষ্টা চালাতে হবে। আমরা জানি বীজ থেকে অঙ্কুর, অঙ্কুর থেকে গাছ, গাছ থেকে কুঁড়ি, কুঁড়ি থেকে পূর্ণ বিকশিত ফুল, এটাই প্রকৃতির বিধান। একজন চিত্রশিল্পি কত শত কাগজই না নষ্ট করেছেন যা তা এঁকে এঁকে। একজন বক্তা নির্জনে পথে ঘাটে মাঠে যেখানেই সুযোগ পেতেন হাত নেড়ে নেড়ে গলা ছেড়ে গরু চরাতে গিয়ে সেগুলোকে শ্রুতা বানিয়ে চালিয়ে যেতেন বক্তব্যের অনুশীলন। লেখক হতে চাইলে স্বপ্ন দেখতে হবেএবং স্বপ্ন পূরণের জন্য নিমগ্ন সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালাম শৈশব থেকেই স্বপ্ন দেখতেন বড় হওয়ার। শিশুকাল থেকেই তিনি স্বপ্ন পূরণের জন্য চেষ্টাও করে গেছেন। আব্দুল কালাম’র সহোদরা ফাতেমা বেগম থেকে জানা যায়-আব্দুল কালাম তখন ৮ বছরের বালক। বাবার পাগড়ি মাথায় বেঁধে বোনদের বলতেন সরে দাঁড়াও তোমরা! দিল্লির মাওলানা আসছেন। দেখো দেখো-তিনি তো চলে এসেছেন..। তারপর ঘরের বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করতেন। একটু থেমে বোনদের বলতেন-ধরো, আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অনেক লোক এসেছে। খানিক পরে আবার বলতেন-তোমরা সবাই আমার চারপাশে এসে দাঁড়াএ। ‘জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দাও। বোনেরা প্রতিবাদ করে বলত-এখানে তো আমরা তিন-চারজন মাত্র। হাজার হাজার মানুষ কোথায়? আব্দুল কালাম বলতেন এটা তো একটা খেলা। খেলায় অনেক কিছুই ধরে নিতে হয়। এটা ছিল শিশু অবস্থায় এ.পি.জে অবস্থায় আব্দুল কালামের স্বপ্ন! স্বপ্নের আকাশে নিজেকে এঁকেছিলেন দিল্লির বড় মাওলানারুপে। এই স্বপ্ন আব্দুল কালাম আজাদকে ভারতের রাষ্ট্রপতির আসনে সমাসীন করেছিল। নিমগ্ন সাধনা যদি ঠাঁই পায় কারও জীবনে তাকে আর হার মানতে হবে না ব্যর্থতার কাছে। বিশিষ্ট সাহিত্যিক মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ একদিন এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন-‘ব্যথা ছাড়া লেখা হয় না। তবে সত্যিই সত্যিই সে ব্যথা হওয়া জরুরি না। একজন আমাকে ব্যথা দেয়নি কিন্তু আমি কল্পনা করে নিচ্ছি একটি আচরণ সে আমার সে করলো। কিন্তু বাস্তবে সে এমন আচরণ করেনি, তাই আমার কল্পনার কারণে তার কোনো ক্ষতি হবে না, তবে এই ব্যথা থেকে লেখা তৈরি হবে। লেখক হওয়ার জন্য একজন ভালো লেখক কত কলম ডায়েরি আর কাগজ শেষ করেছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। লেখক হতে হলে পড়তে হবে, পড়তে হবে এবং পড়তে হবে, অতপর লেখতে হবে। যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে হবে বই পাঠে। বই পাঠ ছাড়া ভালো লেখক হয়ে ওঠা দুরূহ ব্যাপার। কুরআনুল কারিমের দিকে দৃষ্টি ফিরালেও আমরা দেখতে পাই বপাঠের গুরুত্ব। পবিত্র কুরআনের প্রথম বাণী ছিল-‘ইকরা’ অর্থ পড়। পড়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে প্রথমে। আর পড়ার মাধ্যম হচ্ছে বই। শুধুমাত্র পাঠ্যসূচির কয়েকটি বই পড়ে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিতেই জ্ঞানের পূর্ণতা অর্জন করা যায় না। এ জন্য বহুমুখী প্রতিভা অর্জন ও বিচিত্র জ্ঞান এবং লেখালেখির জন্য নানা ধরণের বই পড়তে হবে। জ্ঞানার্জনের নির্দিষ্ট বই এবং নির্ধারিত কোন সময়সীমা নেই। বিখ্যাত ফার্সি কবি শেখ সাদী (রাহ.) এ প্রসঙ্গে বলেন, সমস্ত জীবন জ্ঞানের ওপর লেখা-পড়া করে বুঝেছি যে, জ্ঞানের বাতাস গায়ে লেগেছে মাত্র। প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে পারি নাই। এটা ছিল জ্ঞানীদের কথা। জ্ঞানরাজ্যের তৃপ্তি মেটানোর জন্য পড়ার বিকল্প নেই। মানুষের দু’ধরণের ক্ষুধার সৃষ্টি হয়। একটি হলো দৈহিক ক্ষুধা, অন্যটি মানসিক ক্ষুধা। দৈহিক ক্ষুধার চাহিদ সাময়িক এবং সহজলভ্য। মানসিক ক্ষুধার চাহিদা এর সম্পূর্ণ উল্টে। এটা পূরণ করাও খুব কঠিন। জানার জন্য পড়তে হবে। পড়ার প্রধান মাধ্যম হলো বই। কুরআনে এরশাদ হয়েছে-‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি কখনো সমান? না তারা কখনো সমান হতে পারে না। জ্ঞানরাজ্যের ক্ষুধা মেটানোর অন্যতম মাধ্যম হলো বই। বই আত্মার খোরাক জোগায়। বই পড়া হলো অনাবিল আনন্দের অফুরন্ত উৎস। বই পড়ার মাধ্যমে মনোযোগী পাঠক হওয়া যাবে। আর পাঠক হলেই লেখক হওয়া যাবে। এ বিশ্বের বড় বড় জ্ঞানী ব্যক্তিরাই ছিলেন বই পাঠক। বহু ভাষাবিদ ও বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বই পড়ার প্রতি এত বেশি আসক্ত ছিলেন যে, লাইব্রেরি কক্ষে কর্মচারীরা তার নির্বিষ্ট পাঠক মনের উপস্থিতি পর্যন্ত টের পেত না। তাই বহুবার তিনি লাইব্রেরি কক্ষে তালাবন্দি হয়েছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন। এটা শেষ পর্যন্ত তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। দিন-রাত বই নিয়েই তিনি নিমগ্ন থাকতেন। তিনি একদিন পাঠাগারের এক কোনায় বসে বই পড়ছিলেন। এক সময় লাইব্রেরিয়ান পাঠাগার বন্ধ করে চলে যান। তিনি তখনও মুগ্ধ হয়ে বই পড়ছিলেন। যত বড় বই-ই হোক, তিনি একবারে শেষ না করে কোনোভাবেই টেবিল থেকে উঠতেন না। পরদিন যথাসময়ে পাঠাগার খোলা হলো। লাইব্রেরিয়ান দেখতে পেলেন ড. শহীদুল্লাহ মগ্ন হয়ে বই পড়ছেন। লাইব্রেরিয়ান অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি সারা রাত পাঠাগারে বন্দি ছিলেন? আর তখনই শহীদুল্লাহ ধ্যান ভেঙে গেল। লাইব্রেরিয়ান লোকটির প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন-সে রকম কিছু নয়। আমি তো কেবল বই পড়ছিলাম। বই পাঠের প্রতি গুরুত্ব ও আসক্তির কারণেই তিনি হয়ে ওঠেছেন অগাধ পান্ডিত্য ও বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী। বই ছিল তাদের পরম বন্ধু। আমরা যত বড় বড় জ্ঞানী, সাহিত্যিক, কলামিস্টদের নাম শুনি, তাদের জীবনে পড়লে পাওয়া যায় বই পাঠ এবং সংগ্রহের প্রতি ছিল তাদের ভীষণ আগ্রহ। বিশিষ্ট সাহিত্যিক আল্লামা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রাহ.) ছোটবেলা থেকেই বই পাঠে খুবই আগ্রহী ছিলেন। কোন বই হাতের নাগালে পেলে পড়ে শেষ করার পূর্বে বসা থেকে উঠতেন না। তিনি ছোটবেলায় কিছু টাকা জমিয়ে বই কেনার জন্য বাজারে রওয়ানা দিলেন। ফার্মেসির দোকানে গিয়ে বললেন আমাকে একটা বই দিন। এমন ছোট ছিলেন যে, তিনি জানতেন না সব কিছুর দোকান ভিন্ন ভিন্ন। ফার্মেসির দোকানে ঔষুধ বিক্রি হয়, আর লাইব্রেরিতে বই বিক্রি হয়। একথা তিনি জানতেন না। ফলে ডাক্তার একটা ঔরুধের লিস্ট তাঁর হাতে দিয়ে অপর হাতে টাকা দিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। এমনই ছিল হযরত নদভীর (রাহ). কিশোর জীবন। হাজ্বী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রাহ.) জীবনে যত বই পড়েছেন তার কোন পরিসংখ্যান নেই। তিনি এমন বই প্রেমিক ছিলেন যে, বই পড়তে পড়তে লাইব্রেরিতেই মৃত্যুবরণ করেন।
বর্তমান যুগ ভাষা ও সাহিত্যের। সাহিত্যের বিপ্লব ঘটাতে চাইলে প্রয়োজন সাহিত্য চর্চার। ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্বে আসাটা আমাদের জন্য অপরিহার্য। প্রখ্যাত সাহিত্যিক মাওলানা আবু তাহের মিসবাহর ভাষায়-‘এই দেশে এই সমাজে যদি ইসলামী শিক্ষার ভবিষ্যত নিরাপদ করতে চাও এবং বাতিলের মোকাবেলায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাও তাহলে সৈয়দ আবুল হাসান আলীর নদভীর ভাষায়-‘বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ইমামতি ও নেতৃত্ব অবশ্যই আপনাদের দখল করতে হবে এবং সেজন্য অক্লান্ত সাধনা ও মুজাহাদায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। আপনাদের তো এমন সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে, যাতে শিক্ষিত সমাজ অন্যদের ছেড়ে আপনাদের সাহিত্য নিয়ে বিভোর থাকে’।
লেখালেখি কেন করবো?
বর্তমান যুগটি মিডিয়ার। আর মিডিয়াকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সকল তাগুতি শক্তি ইসলামের বিরুদ্ধে মিডিয়াকে তলোয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। হাজার অস্ত্রধারী যা করতে পারে না, ঘরে বসে একজন কলম সৈনিক তথা মিডিয়াকর্মী লেখালেখির মাধ্যমে তারচেয়েও বেশি কিছু করতে পারেন। লেখালেখির মাধ্যমে সকল আপশক্তির মোকাবেলা করার জন্যই হবে আমাদের লেখালেখি। যার কলম যত বেশি ক্ষুরধার ও শাণিত, প্রতিপক্ষের মোকাবেলায় তিনি ততই অপ্রতিরোধ্য ও সফল। লেখালেখির মাধ্যম কলম। আর কলমের শক্তি ও প্রভাব আপরিসীম। কলম যদি হয় ‘কলবের কলম’ যা হৃদয়ের আবেগ ও উত্তাপকে প্রকাশ করে, যা কলবের জোশ ও জযবাকে উজ্জীবিত করে, তাহলে সেই কলমের একেকটি কথা পাহাড়ের চেয়েও ওজনদার, হীরকখন্ডে চেয়েও মূল্যবান। কলম যদি হয় ‘কথার কলম’ তাহলে এমন কলম থেকে লেখালেখি ও সাহিত্য বিপ্লব আশা করা যাবে না। কাজেই আমাদের কলম হবে ‘কলবের কলম’ কথার কলম না।
লেখালেখির প্রয়োজনীয়তা :
লেখালেখির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী মনীষী আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী (রাহ.) বলেছিলেন-‘যামানা এখন নতুন খালিদ বিন ওয়ালিদ এবং নতুন আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ’র (রা.) এর অপেক্ষায় রয়েছে। তাঁদের পাক রুহের উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর লক্ষ কোটি রহমত। তাঁদের নমুনা তো কেয়ামত পর্যন্ত আর পয়দা হতে পারে না। কিন্তু আমি শুনতে পাই তাঁদের রুহ যেন তোমাদের ডেকে ডেকে বলছে তলোয়ারের জিহাদ তো আমরা করেছি, বুকের রক্ত যত প্রয়োজন ঢেলে দিয়েছি। যখনই ডাক এসেছে মুহুর্ত বিলম্ব করিনি। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছি। কিন্তু আজ রক্তের জিহাদের যতটা প্রয়োজন, চিন্তার জিহাদের প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি। ধারালো জিহাদের যতটা প্রয়োজন, চিন্তার জিহাদের প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি। ধারালো তলোয়ারের যতটা প্রয়োজন শাণিত কলমের প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি, বাতিলের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে আজ লড়তে হবে, শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ময়দানে এবং চিন্তা মতবাদ ও দর্শনের জগতে। কেননা নবুওয়তে মুহাম্মদির উপর এখন তলোয়ারের হামলা যতটা না চলছে তার চেয়ে বেশি চলছে যুক্তি প্রমাণের হামলা। চিন্তা ও দর্শনের মামলা। সুতরাং নতুন যুগের নতুন জিহাদের জন্য তোমরা এককদল মুজাহিদ তৈরি হও’। লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চা হবে জীবনের জন্য এবং জীবন হবে সাধনার জন্য। সে হিসেবে সে সাহিত্যই গুরুত্ববহ, মানুষ যে সাহিত্যের সাহায্যে জীবনের উন্নয়ন সাধন করতে পারে। সেই সাহিত্যের একটি লক্ষ্য থাকতে হবে। লক্ষ্য-উদ্দেশ্যহীন সাহিত্যের কোন আবেদন থাকে না। লক্ষ্যহীন সাহিত্য যতই শক্তিধর ও শাণিত হয়ে থাকুক, তা শুধু শাব্দিক কারুকার্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তার প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে খুবই স্বল্পমেয়দী ও অতি সাময়িক। তাই যে সাহিত্যে েেকান পবিত্র লক্ষ্যের দিকনির্দেশনা নেই, তা নিরর্থক। তার কোনো কার্যকর গুরুত্ব েেনই জীবন ও সাহিত্যে।
লেখালেখি হোক সহজ ভাষায় :
লেখালেখির ভাষা হতে হবে সহজ সাবলীল। লেখালেখিতে জটিল ও দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করলে পাঠক এর সুফল লাভ ব্যর্থ হয়। তাই সাহিত্যের ভাষা হতে হবে সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল, ঝরনার মতো প্রবাহমান, যাতে তা সব মানুষের বোধগম্য হয়। কারণ সাহিত্য রচনা যদি মানুষের বোধগম্য না হয় তাহলে সাহিত্য রচনার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়। েেলখাটি যদি পাঠকের উদ্দেশ্যে হয় আর পাঠকই তার মর্ম হৃদয়ঙ্গমে ব্যর্থ হয় তাহলে এত কষ্ট করে রচনার লিখার স্বার্থকতা কোথায়? অপ্রচলিত ও দুর্বোধ্য ভাষায় সাহিত্য রচিত হলে পাঠক তার মর্ম উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়, আর তাতে সাহিত্যের মুল্য কমে যায়। পাঠক সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। পক্ষান্তরে সকলের বোধগম্য সহজ-সরল ভাষায় সাহিত্য রচিত হলে পাঠক সহজেই তার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারে। ফলে এ সাহিত্য পাঠকের কাছে গ্রহণীয় হয় এবং এর মূল্য অনেক বেড়ে যায়। সাহিত্যের ভাষা এমন হওয়া উচিত যাতে সবাই তা পড়তে পারে, বুঝতে পারে। বর্তমানে অনেক উদিয়মান সাহিত্যকগণ সাহিত্যের আদর্শ হিসেবে কঠিন, অপ্রচলিত, ভারী ও ওজনদার শব্দগুলো বেছে নিয়েছেন। সে শব্দগুলো সাধারণ পাঠক বুঝুক আর নাই বুঝুক। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের স্থপতি, প্রখ্যাত ভাষাবিদ বঙ্কিকচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধে তিনি বলেন-‘গ্রাম্য বাঙ্গালি নারীরা মনে করে, শোভা বাড়ুক আর নাই বাড়ুক ওজনে ভারি সোনা অঙ্গে পরলেই অলঙ্কার পরার গৌরব হলো’। এমনিভাবে এযুগের তরুণ লেখকরা মনে করেন, পাঠক বুঝুক আর নাই বুঝুক, দুর্বোধ্য ও অপ্রচলিত শব্দ চয়নে সাহিত্য রচনা করলেই তা উৎকৃষ্ট সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করবে। মূলত তাদের এ ধারণা সঠিক নয়। সাহিত্যের প্রধান গুণ এবং প্রথম প্রয়োজন সরলতা ও স্পষ্টতা। যে রচনা পড়ামাত্রই সকলে বুঝতে পারে, তাই উৎকৃষ্ট রচনা। তাই সাহিত্যের ভাষা হতে হবে সহজ সাবলীল যাতে পাঠক তা বুঝতে পারে। সাহিত্য যদি কঠিন ও দুর্বোধ্য হয় তাহলে পাঠক তা পড়ে বুঝতে পারে না। আর যে সাহিত্য পড়ে বোঝা যায় না তা রচনারও কোন অর্থ হয় না। যেখানে যে শব্দ ব্যবহার করলে ভাষা সহজ ও বোধগম্য হয় সেখানেসে ধরণের শব্দ ব্যবহার করাই উচিত।
আমাদের সাহিত্য আমাদের ইবাদত। সাহিত্য আমাদের আরাধ্য। যে সাহিত্যে কোন লক্ষ্যের দিকনির্দেশনা নেই আমাদের কাছে তা নিরর্থক। তার কোন কার্যকর গুরুত্ব নেই জীবন ও সাহিত্যে। যেমন, জাহেলি যুগের সাহিত্য। মুলত সে যুগের সাহিত্যের কোনো লক্ষ্য ও টার্গেট ছিলো না। এযুগেও জাহেলি সাহিত্যের বিপ্লব চলছে। জাহেলি সাহিত্যের উত্তরাধিকারী হয়ে তারা লিখে চলেছে অব্যাহতভাবে। মানবতার সৌধ নির্মাণের পরিবর্তে সে সাহিত্যের দ্বারা মানবতা ও মনুষ্যত্ব ধ্বংসের কাজ আঞ্জাম দেয়া হচ্ছে। মানবিক রিপু ও তাড়নাকে চাঙ্গা করে তোলা হচ্ছে। সাহিত্য তো সেটাই-যার আবেদন মানবতার পুনগর্ঠন , মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধন ও ইসলাম-মানবতার কল্যাণ সাধিত হয়। আরও সহজ ভাষায় বলা যায়, যে সাহিত্য ইসলাম, মানবতার কাজে আসে না, নিছক আনন্দ-বিনোদনেই সীমাবদ্ধ এবং ইসলাম উপেক্ষিত এটাই অপসাহিত্য। নিছক ভাষাগত ও শাব্দিক কারুকার্য তো একটি তুচ্ছ ও নিষ্ফল ক্রীড়াশৈলী ও যাদুকরির নামান্তর।
এমন সাহিত্যের দ্বারা মানবতার কল্যাণ আসে না। যে সাহিত্য মানুষের মুল্যবোধ জাগ্রত করতে পারে না; যেখানে মনুষ্যত্বের বিকাশ নেই, যার মাধ্যমে হয় না আত্মার উন্নতি, মন হয় না প্রশান্ত, মানবতায় হৃদয় হয় না ভরপুর, সে সাহিত্য কখনই আদর্শ সাহিত্য হয় না। সে লেখক কখনও হয় না আদর্শ লেখক। বরং সে সাহিত্যই সুসাহিত্য- যা মহান রাব্বে কারীমের পরিচয় গ্রহণে সক্ষম, যা তার আদেশ পালনে তৎপর, নিষেধ বর্জনে সোচ্চার। একজন সাহিত্যিকের কাজ শুধু প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের কথামালা উপস্থাপনের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। শুধু ব্যক্তিগত সুখ-দু:খ, চাওয়া-পাওয়া ধারণ করে এগিযে চলা নয়। তার কাজ হচ্ছে সত্য-ন্যায়, কল্যাণ ও সৌন্দের্যের স্বপ্ন দেখানো। সহজ-সাবলীল ও সুন্দর বর্ণনার মধ্যদয়ে মানুষের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলে আন্ধকারে আলোর মশাল প্রজ্জ্বলিত করাই একজন আদর্শ সাহিত্যিকের প্রধান দায়িত্ব। যাদের যোগ্যতা আছে সাহিত্য রচনার মাধ্যমে ইসলামের সার্বজনীন আদর্শের পয়গাম মানুষের কাছে তুলে ধরা জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক