বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুলাই ২০১৯, ৪:৫২:৩০ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট ::
সিলেটের সুরমা এবং সারি নদীর পানি না বাড়লেও বাড়ছে কুশিয়ারা নদীর পানি। পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয় মঙ্গলবার জানায়, কুশিয়ারার অমলসিদ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১৪০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন স্থান থেকে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট অনুযায়ী বন্যা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। তবে সিলেটে আজ দিনে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সুরমার পানি কিছুটা কমতে দেখা গেছে। জেলার ১৩টি উপজেলার অন্তত ১২টি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফলে ১শ ৯০টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
গোলাপগঞ্জ : গোলাপগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গোলাপগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। উপজেলার উল্লেখযোগ্য অংশ প্লাবিত হওয়ায় হাজার হাজার মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছেন। এদিকে গতকাল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মামুনুর রহমান লক্ষণাবন্দ ইউনিয়নের নোয়াইরচক, বাঘা ইউনিয়নের খালপারসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যা দুর্গত স্থান পরিদর্শন করেন। এসময় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরকারি ত্রাণ বিতরণ করা হয়।
মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজার থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানান, দেশের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা ঢলে কুশিয়ারা নদী আরো ফুঁসে উঠে গ্রামীণ ঘর-বাড়ি প্লাবিত হয়েছে। এতে মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ৪৩টি গ্রামের হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এদিকে আভ্যন্তরীন বৃষ্টি ও ভারত থেকে আসা ঢলে মনু ও ধলাই নদ-এর পানি বেড়ে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
মনু ও ধলাই নদ এর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জলমগ্ন হয়ে পড়েছে বহু ঘর-বাড়ি। বিশেষ করে মনু নদী এর পানি বাড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ অনেক বাঁধ নিয়ে শঙ্কায় আছেন মৌলভীবাজার শহরের কয়েক হাজার মানুষ। ইতিমধ্যেই শহরের এম সাইফুর রহমান সড়কের পশ্চিমবাজারে মনু থেকে ছুঁই-ছু্ইঁ করে পানি ঢুকছে শহরে। স্থানীয়রা বলেছেন, এদিক দিয়ে কোথাও যদি বাঁধ ভেঙ্গে যায় তবে ১৫/২০টি মার্কেটসহ ৩ শতাধিক বাসা-বাড়ি প্লাবিত হবে।
এদিকে, মনু সেতুর চাঁদনীঘাট এলাকায় মঙ্গলবার পাউবোর সর্বশেষ রেকর্ড অনুযায়ী বিপদসীমার ১শ ১ সে. মি. উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও কুশিয়ারা নদীতে ৫৫ সে.মি. উপর ও ধলাই নদ-এ বিপদসীমার ১৩ সে.মি. নীচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্ত্তী মঙ্গলবার দুপুরে জানান, রাজনগর উপজেলার টেংরা ইউনিয়নের কোনাগাঁও এলাকায় মনু নদ বাঁধ ভাঙ্গার উপক্রম ছিল। আমরা তাৎক্ষনিক সেখানে গিয়ে কাজ করেছি। মৌলভীবাজার শহরের পশ্চিমবাজারে মনূ থেকে ছুঁই-ছুঁই করে পানি ঢুকছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে “ফ্লাড ওয়াল” রয়েছে তাই বাঁধ ভাঙ্গার সম্ভাবনা নাই। এর আগে পাউবো এ প্রতিবেদককে জানিয়ে ছিল, সদর উপজেলার মীরপুর ও ঢেউপাশা এলাকার মুহাম্মদপুরে ঝুকিপূর্ণ দুটি স্থানে আপাতত বাঁধ দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন এ দুটিস্থান এখনো নিরাপদ নয়।
এদিকে কুশিয়ারা নদীর মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনুমুখ ইউনিয়ন, রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ও ফতেপুর ইউনিয়নে নদী পাড়ের প্রায় ৪৩টি গ্রামে পানি ঢুকেছে। এতে ওই ভাটি এলাকার সিংহভাগ যাতায়াতের রাস্তঘাট, ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। মঙ্গলবার মৌলভীবাজারে বৃষ্টি না হলেও পানি ছুঁই ছুঁই করে বাড়ছে এখনো। রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ইউপির ছিক্কা গাঁও, কামালপুর, আমনপুর, সুরিখাল, যোগীকোনা, কেশরপাড়া, সুনামপুর, উমরপুর, কান্দিগাঁও, জোড়াপুর ও ফতেপুর ইউনিয়নের সাদাপুর, হামিদপুর, বেড়কুড়ি, শাহাপুর, জাহিদপুরসহ প্রায় ২০-২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এদিকে বৈরী আবহাওয়া ও বন্যাক্রান্ত খেটে খাওয়া মানুষেরা বিভিন্ন রোগের আশঙ্কা করছেন।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, মৌলভীবাজার সদর উপজেলায় ৩ ইউনিয়নের ২০টি গ্রাম, রাজনগরে দুই ইউনিয়নের ২৩টি গ্রাম, কমলগঞ্জে ৩ ইউনিয়নের ২২টি গ্রাম ও কুলাউড়ায় ২ ইউনিয়নের আরো ৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ৪ হাজার ৭০টি পরিবার প্লাবিত হয়েছে। এসব বন্যাক্রান্তদের মাঝে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোট ২৩৬ মেঃ টন চাল, ১ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার ও নগদ আড়াই লক্ষ টাকা বণ্টন করা হয়েছে। এসব বন্যাক্রান্ত এলাকায় ৭টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌসী আক্তার জানান, জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে পাওয়া এসব ত্রাণ সামগ্রী স্থানীয় চেয়ারম্যানগণের কাছে পাঠিয়েছেন। রাজনগর উপজেলায় কুশিয়ারা নদী পাড়ের কামালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,সুরিখাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,সুনামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাওর করাইয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
সুরিখাল ৩৫টি, সুনামপুর ৩৮টি ও কামালপুরে ১৭টি পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে এসে ঠাঁই নিয়েছেন। উত্তরভাগ ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড সদস্য হুমায়ুন কবীর জানান, গত সোমবার সুনামপুর আশ্রয় কেন্দ্রে ২৮ পরিবার উঠে। ওই দিন সংসদ সদস্য নেছার আহমদ এসব পরিবার এর হাতে ত্রান সামগ্রী তুলে দেন। তিনি আরো জানান, মঙ্গলবার ওই কেন্দ্রে আরো ১০ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। মঙ্গলবার বেলা ৩টা পর্যন্ত ওই ৩৮ পরিবারের মাঝে কোন ত্রান সামগ্রী দেয়া হয়নি।
বড়লেখা : বড়লেখা প্রতিনিধি জানান, বড়লেখার হাকালুকি হাওর পাড়ের ৩ ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। মঙ্গলবার উপজেলা চেয়ারম্যানসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
কয়েক দিনের ভারি বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হাকালুকি হাওর তীরবর্তী তালিমপুর, বর্ণী ও সুজানগর ইউনিয়নের ১৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়ায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে উপজেলার বিভিন্ন প্রাইমারী স্কুল। মঙ্গলবার বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়নের বন্যা দুর্গত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন উপজেলা চেয়ারম্যান সোয়েব আহমদ, ভারপ্রাপ্ত ইউএনও মো. শরীফ উদ্দিন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. উবায়েদ উল্লাহ খান, প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. আশরাফুল আলম খান, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হাওলাদার আজিজুল ইসলাম প্রমুখ।
উপজেলা চেয়ারম্যান সোয়েব আহমদ জানান, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৯টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র। বৃষ্ঠি না হলে ২-৩ দিনের মধ্যে বন্যার উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জুড়ী : জুড়ীতে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ধর্মনগর হয়ে জুড়ী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে জায়ফরনগর ও পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের হাওর তীরবর্তী ১৫টি গ্রাম ও ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার প্রায় ১৩ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। জুড়ী-ফুলতলা সড়কের হাফিজিয়া-কলাবাড়ী মধ্যবর্তী সড়ক বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় রোববার সকাল থেকে এ সড়কে সব ধরণের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। মঙ্গলবার ইউএনও অসীম চন্দ্র বণিক বন্যা দুর্গত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওর তীরবর্তী এলাকায় বন্যা দেখা দেয়। মঙ্গলবার ভারী বর্ষণ না হলেও জুড়ী নদী দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বৃষ্টির পানি ও পাহাড়ি ঢল নেমে আসায় হাকালুকি হাওরে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে জায়ফরনগর ইউনিয়নের শাহপুর, নিশ্চিন্তপুর, ভূঁযাই, পশ্চিম গোবিন্দপুর, দীঘলবাক, কানকইর চক, রাজাপুর সোনাপুর, বেলাগাঁও, নয়াগ্রাম, ইউসূফ নগর ও শিমুলতলা গ্রামের প্রায় ১৩ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। এদিকে পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের খাগটেকা, কালনীগড়, তালতলা, পশ্চিম বাছিরপুর, কৃষ্ণনগর, শিলঘাট ও হরিরামপুর গ্রামে বন্যার অবনতি ঘটেছে।
বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়ায় জুড়ী উপজেলার পশ্চিম জুড়ী ও জায়ফরনগর ইউনিয়নের ৯টি প্রাইমারী ও মাধ্যমিক স্কুলের পাঠদান কার্যক্রম আংশিক বন্ধ রয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের খাকটেকা, কালগীগড়, তালতলা গ্রামের বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন জুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অসীম চন্দ্র বণিক, থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার, ওসি তদন্ত আমিনুল ইসলাম, পশ্চিম জুড়ী ইউপি চেয়ারম্যান শ্রীকান্ত দাস, আওয়ামীলীগ নেতা এমএ সালাম প্রমুখ।
ইউএনও অসীম চন্দ্র বণিক জানান, উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরী সভায় বন্যায় যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি ও মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসনের কাছে ত্রাণ চাওয়া হয়েছে। এছাড়া ভারি বর্ষণে টিলা ধসার আশংকায় উপজেলার মনতৈল ও গুচ্ছগ্রাম এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ টিলায় বসবাসকারী ২৫টি পরিবারের ১০০ জনকে বিশ্বনাথপুর প্রাইমারী স্কুলে আশ্রয় দেয়া হয়েছে।
কমলগঞ্জ : কমলগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, পাঁচ দিনের বন্যার পর মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের শমশেরনগর, পতনউষার ও মুন্সীবাজার এলাকায় বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। তবে হতদরিদ্র পানিবন্দী শত শত পরিবারের মধ্যে এখন পর্যন্ত কোন ত্রাণ পৌঁছায়নি। ৫২ মে.টন চাল বরাদ্ধ হলেও বুধবার থেকে সেগুলো বিতরণ করা হবে বলে জানা গেছে। শুকনো খাবার না থাকায় অনেক পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছে। নদী ভাঙ্গন ও ঢলে গত শুক্রবার রাত থেকে পানিবন্দি হতে থাকে এসব পরিবার।
মঙ্গলবার পতনঊষার ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নন্দ্রগ্রাম, কোনাগাঁও, নিজ বৃন্দাবনপুর, গোপীনগর, রাধাগোবিন্দপুর, মাজগাঁও, বাজারকোণা, কোনাগাঁও, পশ্চিম পতনঊষার, ফরিংগাকোণা প্রভৃতি গ্রামে এখনো মানুষের বসতবাড়িতে পানি রয়েছে। এখন পর্যন্ত কোন সরকারী ত্রাণ সহায়তা আসেনি। পতনঊষারের কৃষক তোয়াবুর রহমান জানান, আমরা ত্রাণ চাই না। বীজ, হালির চারাসহ জরুরী ভিত্তিতে কৃষি পূণর্বাসন চাই। বাজারকোণা গ্রামের রিক্সাচালক ও হোসেন মিয়া জানান, গত ৫দিন ধরে এ গ্রামের ৩৫টি পরিবার পানিবন্দী। ঘরের চুলা পর্যন্ত জলছে না। এখন পর্যন্ত কোন ত্রাণ আসেনি।
এছাড়া উপজেলার শমশেরনগর, পতনউষার, মুন্সীবাজার ও রহিমপুর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্ছল এলাকার প্রায় ৩৫টি গ্রামের সাত শ’ পরিবার গত চারদিন ধরে বন্যার পানি মোকাবেলা করে দিন কাটছেন। চারদিনেও সরকারি কোন ধরণের ত্রাণ না আসায় হত দরিদ্র পরিবার সদস্যরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কেউ কেউ গবাদি পশু নিয়েও একই ঘরে দিন যাপন করছেন। এসব পরিবার সদস্যদের শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সংকট দেখা গেছে।
নবীগঞ্জ : নবীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ কুশিয়ারা রাধাপুরের নিকট ভেঙ্গে ডাইক দিয়ে গত তিনদিন ধরে পানি প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। তবে উপজেলা প্রশাসন ও হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড গত সোমবার মথুড়াপুর এলাকায় অবস্থিত বাধঁটি মেরামত করেছেন। ফলে ওই বাধঁ দিয়ে পানি প্রবেশ আপাতত বন্ধ রয়েছে। তবে নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দীঘলবাক ইউনিয়নের কসবা গ্রামটি বন্যায় আক্রান্ত হয়ে ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করেছে। নবীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দূর্গত এলাকায় শুকনো খাবার, ইনাতগঞ্জ ইউপিতে ৫শ কেজি এবং আউশকান্দি ইউনিয়নের বন্যার্ত লোকদের মাঝে ৫শ কেজি চাল বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দীঘলবাক ইউনিয়নের দুগর্তদের মাঝে আরো চাল বিতরণ করা হয়েছে বলে উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। এদিকে গতকাল মঙ্গলবার আরো নতুন কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গত রবিবার বিকেল সাড়ে ৩ টার দিকে জামারগাঁও রাধাপুর জামে মসজিদের সন্নিকটে ডাইক ভাঙ্গনের ফলে নবীগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৩৫/৪০টি গ্রাম এবং তিনটি সুপরিচিত হাওরের কয়েক হাজার একর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।
গত তিনদিন ধরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার তৌহিদ বিন হাসান, থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ ইকবাল হোসেনসহ রাজনৈতিক, সামাজিক নেতৃবৃন্দ দূর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। সোমবার সকালে ইউএনও তৌহিদ বিন হাসান হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা স্থানীয়দের সহযোগিতায় নিজে পানিতে দাঁড়িয়ে থেকে দীঘলবাক ইউনিয়নের মথুড়াপুর ভাঙ্গন ডাইকের বাধঁ মেরামত করেছেন। এব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বলেন, মথুড়াপুর বাধঁ দিয়ে আপাতত পানি প্রবেশ করার সম্ভাবনা নেই। তবে পানির ¯্রােত বেশী থাকায় রাধাপুরের বাধঁ মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের মাঝে শুকনো খাবার, চাল বিতরণ করা হয়েছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে।
জগন্নাথপুর : জগন্নাথপুর প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। প্রতিদিন বন্যার পানি বেড়েই চলেছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। তলিয়ে যাচ্ছে বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট। উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে এবার উঁচু এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল তলিয়ে পৌর শহরে আক্রমন করেছে। ১৬ জুলাই মঙ্গলবার সরজমিনে দেখা যায়, জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদ চত্বরে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে উপজেলা ভূমি অফিস। অফিসের সামনে পানি থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন অফিসে আসা লোকজন।
যদিও বিগত প্রায় এক সপ্তাহ টানা বৃষ্টিপাতের পর অবশেষে ১৬ জুলাই মঙ্গলবার সূর্য্যরে দেখা মিলেছে। এতে বন্যা কবলিত মানুষের মুখে কিছুটা হলেও হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। তবে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। পানি বেড়েই চলেছে। সূর্য্যরে দেখা পেয়ে মানুষের মনে আশা জেগেছে। এভাবে যদি আরো ২/১ দিন প্রখর রোদ থাকে, তাহলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে পানিবন্দী অসহায় লোকজন আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এদিকে বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জগন্নাথপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শওকত ওসমান মজুমদার বলেন, বন্যায় এ পর্যন্ত ১১ হেক্টর আমন ধানের বীজতলা তলিয়ে গেছে। এছাড়া ৮ হেক্টর আউশ ধানের ক্ষতি হয়েছে। জগন্নাথপুর উপজেলা সহকারি মৎস্য কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন. বন্যায় মোট ২৫০টি মৎস্য ফিসারি তলিয়ে প্রায় ২৫ লক্ষ টাকার মাছ বেরিয়ে গেছে। জগন্নাথপুর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন, বন্যার কারণে এ পর্যন্ত ৪৫টি স্কুলের পাঠদান বন্ধ রয়েছে। জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা জগন্নাথপুর উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) ইয়াসির আরাফাত বলেন, বন্যা কবলিত মানুষের জন্য বেশ কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ২০টি পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া সরকারিভাবে পানিবন্দি মানুষের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।
ছাতক : ছাতক থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানান, ছাতকে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পানিবন্দী হওয়া লক্ষাধিক মানুষ মঙ্গলবার সকাল থেকে সূর্যের দেখা পেয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। তবে বন্য কবলিত অধিকাংশ এলাকায় এখন পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারিভাবে ত্রাণ সামগ্রী না পৌঁছায় খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন বানবাসী লোকজন।
সরজমিনে উপজেলার বিভিন্ন বন্যা প্লাবিত গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। পানিবন্দি এসব লোকদের মধ্যে অনেকেই খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। গো-খাদ্যের অভাবে গবাধিপশু নিয়েও চরম বিপাকে রয়েছেন বানবাসী লোকজন। বন্যার পানি কমতে শুরু করায় ছাতক-দোয়ারা, ছাতক-সুনামগঞ্জ, ছাতক-জাউয়া সড়ক যানচলাচল অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। তবে শহরের কানাখালি সড়ক, ফকিরটিলা-মাছিমপুর বাজার সড়ক, ইসলামপুর ইউনিয়নের ছনবাড়ি-রতনপুর সড়ক, ছনবাড়ি-গাংপাড়-নোয়াকোট সড়ক, কালারুকা ইউনিয়নরে মুক্তিরগাঁও সড়ক, বঙ্গবন্ধু সড়ক, রায়সন্তোষপুর সড়ক, আমেরতল-ধারন সড়ক, পালপুর-খুরমা সড়ক, বোকারভাঙ্গা-সিরাজগঞ্জ সড়কসহ উপজেলার অনান্য সড়কগুলো এখনা পানির নিচে রয়েছে। ঢলের পানি কমতে শুরু করলেও বন্যা কবলিত শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনো শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়নি। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে আরো ২-৩ দিন লাগতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
গত ৯জুলাই থেকে একসপ্তাহের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে উপজেলার অন্তত দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৯০ সে.মি., চেলা নদীর পানি বিপদসীমার ১০০ সে.মি.ও পিয়াইন নদীর পানি ১১০ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়া ডাইকি, বটেরখাল ও বোকা নদীর পানিও বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে ছাতক-দোয়ারা, ছাতক-সুনামগঞ্জ, ছাতক-জাউয়া সড়কের বিভিন্ন অংশ পানিত তলিয়ে যায়। অধিকাংশ গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে শহরের সাথে গ্রামের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। বিভিন্ন বাড়ির আঙ্গিনাসহ নিম্নাঞ্চলের অনেক বসতঘরে বন্যার পানি প্রবেশ করে। ঢলের পানি প্রবেশ করায় অন্তত শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে পড়ে। এছাড়া সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীর পানি প্রবল বেগে প্রবাহিত হওয়ায় নৌপথে ছোট-ছোট নৌকা চলাচল প্রায় বন্ধ। প্রবল বর্ষণে সুরমা, পিয়াইন ও চেলা নদীতে পাথর বালুবাহী বার্জ-কার্গো ও বাল্কহেডে লোডিং-আনলোডিং প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কয়েকটি স্টোন ক্রাসার মিল, পোল্টি ফার্ম, মৎস্য খামার, সদ্য বপন করা আমন ধানের বীজতলা ও শাক-সবজির বাগানে পানি ঢুকে সংশ্লিষ্টদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।