ভিতরের জ্ঞান আর বাইরের জ্ঞান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুলাই ২০১৯, ১:৫০:১৩ অপরাহ্ন
ইতিহাসে নদী ও সমুদ্রে
।। সারওয়ার চৌধুরী।।
ভিতরের জ্ঞান আর বাইরের জ্ঞান
জালালউদ্দিন রুমি ও শামস তাবরিজি দুজনেই ফকিহ (ইসলামী আইনশাস্ত্রবিদ) ছিলেন। রুমি নিয়মিত ওয়াজ করতেন। খুব যুক্তিসংগত ওয়াজ তাঁর শুনবার জন্যে কোনিয়ার আশপাশ হতে মানুষ ছুটে আসত।
এক পর্যায়ে রুমি দেখলেন তাঁর নিজের পা-িত্য ঘিরে আছে একটা আমিত্বের অহং, যাকে ব্যক্তির ইগো বলে। এই অহং ফালতু তা তাঁকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন শামস তাবরিজি।
তাবরিজির আলাপ থেকে প্রখর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন রুমি দেখলেন, ভেতরের জ্ঞান আর বাইরের জ্ঞান বলে দুটি ব্যাপার আছে। বাইরে যা ভিতরে তা না। ভিতর দেখায় উপকারি অপকারি দুই-ই দরকারি। তাই কেবল ‘আলো’র জ্ঞানে নির্ভর করে জগতে কাজ সম্পন্ন হয় না। সম্পর্কসূত্রে অন্ধকারও ভূমিকা রাখছে।
ফলে হাসি কান্না জগতে থাকছেই। সুতরাং ‘আলো’র জ্ঞানভিত্তিক খবরদারী বা অহং লালন তো ফালতু। ঐ যে অন্ধকার থাকছেই এর তাৎপর্য বুঝতে দিওয়ানা হলেন রুমি। তিনি দেখেন আংগুরের নানা ভাষার নাম নিয়ে না-বুঝে মানুষ ঝগড়ায় লিপ্ত। অথচ সব ভাষার আংগুর রস তো একই।
আবার এও দেখেন লড়াইও একটা অনিবার্য ব্যাপার। শামস তাবরিজি সবুর করা কাকে বলে দেখালেন এভাবে-“সবুর করা মানে এই না যে অপ্রতিরোধী হয়ে সইতে থাকা। এর মানে হলো, কার্যধারাটির শেষের দিকে তাকানো। ধৈর্য ধরা কি বোঝায়? কাঁটার দিকে তাকিয়ে গোলাপ দেখতে থাকেন, রাতের দিকে তাকিয়ে ভোর দেখেন। অধৈর্য হওয়া মানে দূরে দেখতে অসমর্থ হওয়া। মানে দুর্বল- ফলাফল পর্যন্ত পৌঁছতে অক্ষম। খোদাপ্রেমী ধৈর্যচ্যুত হন না। তারা জানেন, অর্ধচন্দ্র পূর্ণচাঁদ হওয়ার জন্যে সময় দরকার।” (ভালবাসার চল্লিশ নিয়ম, মূল: এলিফ সাফাক, অনুবাদ: সারওয়ার চৌধুরী)
জালালউদ্দিন রুমির আগে পিছে আরও বেশ ক’জন ইলমে তাছাউফ নিয়ে নানাভাবে মনের ভাব প্রকাশ করেছেন। তাদের মধ্যে আছেন- কবি নূর আদ দীন আব্দুর রহমান জামী, আন্দালুসিয়ার সাধক ইবনে আরাবি, নিশাপুরের ফরিদ উদ্দিন আত্তার, শেখ সাদী, ওমর খৈয়াম , ইমাম গাজ্জালী প্রমুখ। রুমির ‘মসনবি’ ইলমে তাছাউফের সারসমৃদ্ধ এবং কোরআন সুন্নাহর আলোকে লিখিত।
পঞ্চদশ শতকের ফারসি কবি নূর আদ দীন আব্দুর রহমান জামী। বিখ্যাত ইউসুফ-জুলায়খার কাহিনী ‘হাফ্ত আওরঙ’ ও ‘লায়লা-মজনুন’ তাঁর রচনা। তাঁর একটি প্রতীকী গল্পতে প্রাণীজগতের প্রত্যেক প্রাণের ইননেইট নেচার থাকার ব্যাপারটি দেখানো হয়েছে। গল্পটি আমি চার্লস ইলিয়া ক্রেমপিঅক্স এর সাইটের ইংলিশ ভারশন থেকে বাংলা অনুবাদ করি।
সেটি নিম্নরূপ: সাঁতার জানে না এক হিং¯্র বিষাক্ত বৃশ্চিক। তাকে কাঁকড়াবিছাও বলা হয়। নদীপারে এসে কচ্ছপকে অনুরোধ করে তার পিঠে চড়িয়ে নদী পার করে দিতে। অবাক কচ্ছপ বলে, “তোমার কি মাথা খারাপ? আমি সাঁতার কাটার সময় নদীতে তুমি দংশন করবা আমারে আমি ডুবে মরবো।”
হাসলো বৃশ্চিক। বললো, “শোনো ভাই কচ্ছপ, তুমি তো অযৌক্তিক কথা কইলায়। তোমারে সাঁতার কাটার সময় হুল ফুটাইলে শুধু তুমি ডুইবা মরবা না আমিও ত মরমু।”
রাজি হয় কচ্ছপ। পিঠে লয়ে বৃশ্চিক রওনা দিল। মাঝ নদীতে যেতে যেতে বৃশ্চিকের জোশ আসে দংশন করার। নিজেকে সামলাতে না পেরে দিল ডাট করে হুল ফুটিয়ে কচ্ছপের গর্দান বরাবর। দ্রুত বিষক্রিয়ায় চটফট করতে করতে ডুবছে কচ্ছপ ডুবছে বৃশ্চিক।
হতাশ মৃত্যুযাত্রী কচ্ছপ তলিয়ে যেতে যেতে বললো, “যুক্তি দেখাইছিলা দংশন করবা না, তাইলে ক্যান করলা?”
বিমর্ষ বৃশ্চিক জানিয়ে দিল, “যুক্তিটুক্তি মাথায় কাম করে নাই রে ভাই, দংশন করা আমার জন্মগত স্বভাব।”
এ্যালেগরিক্যাল এই গল্পের মেসেজ:
– সবাইকে বিশ্বাস করা যায় না
– সবাই যুক্তির আলোকে কাজ করে না
– সহজাত স্বভাবের কাছে যুক্তি টিকে না
– যার যা জন্মগত স্বভাব তাতেই সে থাকে।
এই যে সহজাত স্বভাব, এই যে যুক্তির ব্যর্থ হওয়া, এসব ভেতরের ব্যাপার বুঝে নিতে মশগুল ছিলেন কবি জালালউদ্দিন রুমি। তাই তিনি জ্ঞানের ইগো প্রদর্শন থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন। আর এসব যার মায়ার লীলা তাঁকে বুঝতে আত্মমগ্ন থাকেন।
লেখকঃ জালালউদ্দিন রুমি গবেষক, অনুবাদক, কবি, আবুধাবি থেকে।