অতিথি পাখিদের কথা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জানুয়ারি ২০২০, ৪:৫১:৩০ অপরাহ্ন
- আনিসুর রহমান
কুয়াশা আর হিমহিম বাতাসে জমে উঠছে শীতের মৌসুম। তার ওপর আবার শুরু হয় শৈত্যপ্রবাহ। সকাল যায় দুপুর আসে, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। তবুও সূর্যের মিষ্টি আলোর দেখা মিলে না। প্রচন্ড ঠাণ্ড,শীতের প্রকোপে পাড়াগাঁয়ের মানুষগুলোকে চাদর, জ্যাকেট গায়ে দিয়ে, কাঁথা কম্বল জড়িয়ে কাটাতে হয় সারাটা দিন। গরিব- দুখি মানুষগুলো ভুগে শীতের কষ্ট ব্যথায়। অনাহারে অর্ধাহারে এতিম,পথশিশুরা এমনিতেই কাতর। শীতের সাথে পাঞ্জা লড়ে পাথর হওয়ার অবস্থা।গ্রামের শিশু-কিশোরদের আনন্দ, উল্লাস, খেলাধূলায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই শীত। একটুখানি মিঠা রোদের ঝলক দেখার আশায় গুনতে থাকে সময়ক্ষণ।
শীত এলেই আমাদের সবুজ শ্যামল বাংলাদেশে আগমন ঘটে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখিদের। সূদূর সাইবেরিয়া ও হিমালয় অঞ্চল এবং তার আশপাশের দেশগুলো থেকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে উড়ে আসে আমাদের দেশে। আমাদের দেশে যখন শীত তখন সেই অঞ্চলগুলোতে বরফ ঝরা শুরু হয়। বরফে ঢেকে যায় স্থলভূমির অধিকাংশ জায়গা। পাখিরা তখন খাবার খেতে পায় না। আর তাই তারা খাবারের খোঁজে কিছুদিনের জন্য বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়। এসব অতিথি পাখিদের একটা অংশ বাংলার রূপ বৈচিত্র্যের প্রেমে মুগ্ধ হয়ে ডানা মেলে উড়ে আসে আমাদের দেশে। আমার দেশের প্রকৃতিকে সাজিয়ে তুলে আরো আকর্ষণীয় করে। শীতকাল জুড়ে এসব অতিথি পাখিরা গ্রামগঞ্জের হাওড়, মাঠ, খাল-বিল, জলাশয়, নদী-নালায় দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায় খাবারের খোঁজে। সবুজ বন- বনানী, ঝোপঝাঁড়ে অস্থায়ীভাবে গড়ে তোলে সুখের নীড়।
আমাদের দেশের পাখিদের সাথে জড়িয়ে পড়ে সু-সম্পর্কে। প্রেম,ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তার মেলবন্ধনে। সকাল-বিকাল কিচিমিচির শব্দে মাতিয়ে তুলে পাড়াগাঁও।
এসব অতিথি পাখিগুলো দেখতে খুবই সুন্দর। অতিথি পাখি রং-বেরঙের, নানান প্রজাতির হয়ে থাকে। যেমনঃ বালিহাঁস, চমাহাঁস, লেজহাঁস, পেরিহাঁস, চমাহাঁস, জলপিপি, পানকৌড়ি, রাজসরালি, বক,
গাঙ কবুতর, শামুককনা, কাইমা, শ্রাইক, বনহুর ইত্যাদি ইত্যাদি…নাম না জানা পাখি।
ওরা যখন দলবেঁধে আকাশের পানে ডানেমেলে উড়ে বেড়ায়,তখন একধ্যানে শুধু চেয়ে থাকতেই মন চায়। মন মননে খেলা করে সুখের ফাল্গুধারা। খোলা আকাশের নীচটা তখন নতুন রঙে সেজে উঠে। এসব অতিথি পাখিদের দেখতে বিভিন্ন লেক বা হাওড়, মাঠে ভিড় জমায় অসংখ্য পাখিপ্রেমি দেশী বিদেশি দর্শক,পর্যটক। ওদের উড়াউড়ি ডানা ঝাঁপটানো দেখে মুগ্ধ হয় তারা। হৃদয় মনে খেলা করে প্রফুল্লতা।
কিন্তু বড়ই দুঃখ এবং পরিতাপের বিষয় হল। দূর দেশ থেকে উড়ে আসা এসব অতিথি পাখিদেরকে শান্তি সুখে থাকতে দেয় না একদল পাখিঘাতক নীচু মনের মানুষ। ওরা বিভিন্নভাবে অতিথি পাখি শিকার করে চলে প্রতিদিন। আর পাখিগুলো ভয়ে আতঙ্কে দিনাতিপাত করে। বনবাদাড়ে তাদের অস্থায়ী নীড়েও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁচতে হয়। একটুখানি সুখের আশায় হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এসেও দুঃখ, কষ্ট আর শিকার হওয়ার ভয় নিয়ে দিনযাপন করতে হয়।
আসলে আমরা মানুষ একটুও বুঝতে চাই না যে, এসব পাখিগুলো আমার দেশের অতিথি। আমাদের ঘরে যেমন কোন অতিথি, মেহমান আসলে আমরা যথাসাধ্য আদর, আপ্যায়ন, কদর করি। তাদের সম্মানে নিজেদেরকে উজাড় করে দিই। যাতে কোন রকম কষ্ট না পায় সেদিকে খুব খেয়াল রাখি। সতর্কতা অবলম্বন করি। অথচ এসব অতিথি পাখিদের বেলায় আমরা মানুষ সেই চিন্তা চেতনা বেমালুম ভুলে যাই। ভুলে যাই ওরাও আল্লাহর সৃষ্টি জীব। ওদেরও আছে জীবন সংসার। ওরাও চায় একটু সুখ, আনন্দে বেঁচে থাকতে। অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে, দিনের পর দিন রাতের পর রাত কষ্টের লম্বা জার্নি করে ওরা এসেছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে। একটু সুখ শান্তিতে বসবাস করবে এই আশায়। অথচ আমরা এসব অতিথি পাখিদেরকে শান্তিতে থাকতে দিই না।
আমাদের বিবেক বলতে কিছু আছে কিনা, সেটা ভেবে দেখা প্রয়োজন। সৃষ্টির সেরা আশরাফুল মাখলুকাত, আমরা কী সত্যিই সেই মানুষ!
আমাদেরকে একটু ভাবতে হবে, বুঝতে হবে। এসব অতিথি পাখিদের সুখ দুঃখের কথা চিন্তা করতে হবে। জানার চেষ্টা করতে হবে, ওরাও প্রভুর সৃষ্টি জীব। আমাদের এই লাল সবুজের বাংলার প্রেম, ভালোবাসায় ওরা এখানে অতিথি হয়ে এসেছে। ক’দিন পরে আবার আপনালয়ে চলে যাবে। আমার জন্মভূমির রূপ বৈচিত্র, প্রাকৃতিক সুন্দর্যতায় ওরা মুগ্ধ। তাই অস্থায়ীভাবে আমার দেশে নানান প্রজাতির এসব পাখিগুলো অতিথি হয়ে ছুটে আসে প্রতি বছর এই শীত ঋতুতে।
আসুন, আজ থেকে আমরা সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। এখন থেকে এসব অতিথি পাখিদের আর কোনরকমভাবে কষ্ট দিব না। কেউ কখনো ওদের শিকার করব না। ওদের সুখ দুঃখের কথা মাথায় রেখে শান্তিতে থাকার সুযোগ করে দিব। তাইলে এসব অতিথি পাখিরা যেমন সুখে থাকবে, ঠিক তেমনি ওদের মুক্ত মনে মুক্ত আকাশে ডানাঝাঁপটনো, কলকাকলি আর সুন্দর্য্যতায় মুগ্ধ হব আমরাও প্রতিদিন। এসব অতিথি পাখিদের আগমনে আমাদের দেশে শীতের মৌসুমে প্রকৃতির রূপ যেন আরো দ্বিগুণ করে তুলেছে। যোগ করেছে নতুন আনন্দের মাত্রা। তাই আমাদের সবার উচিৎ, এসব অতিথি পাখিদেরকে এদেশে স্বাধীনভাবে উড়াউড়ি ঘোড়াঘুড়ি করার নিশ্চয়তা প্রদান করা।