প্রকৃতি দর্শনে নির্মল বন্ধুত্ব
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ মার্চ ২০২০, ৪:৪১:৪১ অপরাহ্ন
- সামছুল আবেদীন
বন্ধুত্বের বন্ধন কখনো বুড়ো হয়না। দোস্তিয়ানার কাল নেই, জাত নেই, স্থান নেই। আমার মতে, ‘এক বন্ধু আরেক বন্ধুর কাছে সর্বদা ঋণী থাকে; এবং এটা অন্তরের ভালোবাসা থেকেই হয়।’ তাইতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “গোলাপ যেমন একটি বিশেষ জাতের ফুল, বন্ধু তেমনি একটি বিশেষ জাতের মানুষ”। বন্ধুত্বের উন্মাদনা চির তরুণ, উদ্বেল – কৈশোরে ভরপুর। এ বন্ধনের অভিধানে ভদ্রতা যেনো বেমানান, বেমালুম। এ সমাজে যে শান্ত ও শৃঙ্খল, সে সবচেয়ে বেশি স্বার্থপর ও অসামাজিক। যে বেশি শৃঙ্খলা ভাঙতে পারে সেই বেশি পটু ও আবেগি। যার নাচে ও গানে তাল নেই, সুর নেই ; তারপরও সবচেয়ে বেশি গালি-করতালি তার ভাগ্যেই জোটে। পকেটের সব টাকা খরচ করার পরও, ‘কিপ্টে’ তকমাটা বহন করতে হয় রাজমুকুটের মতো। ভালো কথায়ও হাসি-ঠাট্টা, আর দুর্দিনে আটার মতো লেগে থাকা মানুষগুলোই বন্ধু হয়।
এজন্যই প্লেটো বলেন,“বন্ধুদের মধ্যে সবকিছুতেই একতা থাকে”। এবং এটাই উত্তম বন্ধুর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
আবারো এমন একটা মধুময়, স্মৃতিময় দিন কাটালাম ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষের অনার্স এবং ২০০৮ সালের মাস্টার্সের সহপাঠীদের সাথে। অনেকদিন থেকে আমরা একটা গেটটুগেদার করবো বলে ভাবছিলাম। সেই ভাবনা থেকেই হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের বন্ধুরা জড়ো হতে থাকে। সাথে যোগ হলো এইডেড স্কুলের ২০০১ ব্যাচের কয়েকজন বন্ধু।
১৭/০১/২০২০ ইং, রোজ শুক্রবার ; সকাল সাড়ে সাতটার সময় রিকাবি বাজার পয়েন্ট থেকে যাত্রা শুরুর প্রাক্ষালে একে একে সবাই উপস্থিত। দীর্ঘ আট-দশ বছর পর অনেকের সাথে দেখা হলো। অনেককেই ঠিকমতো চেনা যাচ্ছে না। কেউ স্থুলকায়, কারো মুখে অজাতশ্মশ্রæ ভরা। অনুমান করেই কোলাকুলির পর্ব শেষে আমরা ফিরে গেলাম এগারো- বারো বছরের সেই পুরনো দিনের স্মৃতিচারণে। হারিয়ে গেলাম সেই টগবগে তারুণ্যে ভরপুর হৈ-হুল্লোড়ের ক্যা¤পাস জীবনে। বাসে উঠে যার যার আসন গ্রহণ করে পরিচিতি পর্ব শেষ হলো। গাড়ি চললো তার গতিতে আর আমরা চললাম আড্ডা দিতে দিতে। রাস্তায় বিরতিতে সকালের নাস্তা সারলাম।
নাচ, গান, কৌতুক, কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে যার যার পারদর্শিতা প্রয়োগ করা শুরু হলো। জুবের, টিপুর বায়না আমাকে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে হবে। দেখালাম উল্টো দৃশ্যাপট; কবিতা নয় গানের মুগ্ধতায় বিমোহিত করলাম সবাইকে। তারপর আবার বিরতি দিয়ে স্বরচিত কবিতা “প্রিয়ার খোঁজে” আবৃত্তি করলাম। আতাউর, শিমুল, আলতাফের ডিজে ডেন্সে মাতোয়ারা পুরো গাড়ি।
বাউল কন্ঠের আউলা মনে, ইয়াহিয়া গাইলো গীতিকার হাসান মতিউর রহমানের গান; জুনেল, ফয়সাল, আতাউরের রক গানও হৃদয়ে মোহনীয়তার পরশ বুলিয়েছে। আর রম্যরসে ভরপুর বিউটন কথায় কথায় হাসিয়েছে সবাইকে।
আমরা পৌঁছে গেলাম সবুজে আচ্ছাদিত বন, পাখি ও জীবের অভয়ারণ্যখ্যাত সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে। তখন সকাল সাড়ে এগারোটা। সেখানে আমাদের সাথে যোগ হলো ঢাকা থেকে আসা রাজন, রাসেল আর বিশাঙ্ক। চট্টগ্রাম থেকে আসা উত্তম যোগ দিয়েছে আগেই।
টিকিট কেটে দল বেঁধে মুক্ত মনে ঘুরতে থাকলাম ছোটো টিলার পাদদেশ বেয়ে চলা সরু-বন্ধুর পথে। নতুন জায়গায় যেনো সবকিছুই নতুন নতুন। অসংখ্য গাছের মাঝে চিরচেনা হিজলবন আর লতানো বেত গাছগুলোকেও কেমন যেনো নতুন মনে হচ্ছে। বেতের পাতাগুলো তো মাথা নেড়ে রীতিমতো অভ্যর্থনা দিতে থাকলো! হিজলবনে ‘গিবন’ আর ঝোপঝাড়ে টুনটুনি, সারস পাখিদের দৌড়ঝাঁপ জানান দিচ্ছে তারা আজ মহা ব্যস্ত। অতিথি সেবায় প্রকৃতির এই জীববৈচির্ত্যের যেনো কোনো ক্লান্তি নেই। সৌন্দর্যে মুগ্ধ-আতঙ্কিত মনে কয়েকজন চলে গেলো টিলার ঢালে, গন্তব্যহীন গহীন অরণ্যে। আমরা কয়েকজন ওয়াচ-টাওয়ার থেকে বাংলার একখÐ সবুজের বিস্তীর্ণ বনভ‚মি উপভোগ করলাম। ক্ষণিকের জন্যে হলেও পাখির মতো উড়তে ইচ্ছে হলো সবুজের ঐ দিগন্তের তেপান্তরে। আরো এ্যাডভেঞ্চার মনে হচ্ছিলো যখন ওয়াচ-টাওয়ার এদিক-ওদিক মৃদু দোল খাচ্ছিলো (উদ্যান কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি)।
মুসলিম বন্ধুরা সাতছড়ি উদ্যান জামে মসজিদে জুমআর নামাজ আদায় করে সবাই চলে গেলাম পাম বাগানে। সেখানে দুপুরের খাবারের আগে এদিক-ওদিক ফটোসেশান শুরু। আর খাবার গ্রহণের জন্য প্রতীক্ষমান লাইনটা বলে দেয়, আমরাও মাঝেমধ্যে সভ্য হই! এক প্লেটে কাড়াকাড়ি করে খাওয়া খাবারগুলো ফিরিয়ে নিয়ে গেলো মেচ জীবনের সরাইখানায়। এরপর দফায় দফায় ছবি তোলে সবাইকে একফ্রেমে বেঁধে শিল্পীমনের পরিচয় দিলো বন্ধু আলতাফ। আমাদের কয়েকজনকে বিশেষ মর্যাদায় আলাদাভাবে স্থিরবন্দী করা হলো। “আমরা যে এতবড় ‘সেলিব্রিটি’ হয়ে গেছি তা কেবল তোদের কারণেই। তাইতো সম্মান জানিয়ে আলাদাভাবে ছবি তুলে তোদের হৃদয়পটে চিরকাল বেঁধে রাখতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করিসনি। জানি, আমাদের ভালো অবস্থা তোদের সহ্য হয় না। কিন্তু প্রত্যেকেই তাঁর স্ব স্ব সম্মানে ভ‚ষিত হবে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে।”
শেষপর্ব শুরু হলো ভাগ্য বিসর্জিত লটারি দিয়ে। প্রথম পুরস্কার জিতে গিয়ে তার আয়োজনকে সার্থক রূপ দিয়েছে বন্ধু জুনেল। তারপর শুরু হলো কৌতুক, ছড়া, কবিতা, গান এবং মুক্তনৃত্য প্রতিযোগিতা। কৌতুক যেমন মনোরঞ্জন দিয়েছে, কবিতা ছড়িয়েছে মুগ্ধতা, গানের সুরে প্রাণের ¯পন্দন, হৃদয় হেরেছে আগত অন্যান্য পর্যটকেরও। শেষমেশ অকৃপণ প্রকৃতির পাতার-বাঁশির সুরে ¯িœগ্ধতা দিয়েছে বন্ধু রবি শেখর দে রিংকু। তার ফুঁৎকারে সাতছড়ি উদ্যানে বন্ধু বিচ্ছেদের বেদনার সুর বেজেছিলো এভাবে ” মধু খই খই আঁরে বিষ খাঁওয়াইলা, কোন কারণে ভালোবাসার দাম ন দিলা…..!” তারপর এই সুর তরঙ্গাহত হয়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলো সবুজের বুকে। বেলাশেষে কেবল ব্যাথাতুর প্রকৃতি বলে দিলো, ” তোরা আবার আসিস”!
এমন আয়োজনে পুরস্কার যদি হয় টয়লেট ক্লিনার, ডিস ওয়াশার সাবান, হারপিক, বদনা, মুলা-পেঁয়াজ এই জাতীয়, তাহলে যার জীবনে হাসির কলি পর্যন্ত ফুটেনি; সে-ও হাসতে বাধ্য। যে সকল বন্ধু এমন সার্থক আনন্দে অক্লান্ত শ্রম দিয়েছে তাদের অকৃত্রিম বন্ধুবৎসল হৃদয়ের কাছে চির ঋণী। আর তাই আমেরিকান কবি এমিলি এলিজাবেথ ডিকেনসনের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, “আমার বন্ধুরা আমার সাম্রাজ্য”।
ভ্রমণ বিনোদন মানুষকে সতেজ রাখে, ভ্রমণ মানুষের মনকে উদার, ত্যাগী ও আন্তরিক করে তোলে। সেই সাথে, সৃষ্টির দর্শন জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করে। তোদের জীবনও এই প্রকৃতির মতো সুন্দর হোক, নির্মল হোক; দীপ্তিময় হোক আগামীর পথচলা এই প্রত্যাশা আজীবনের।