কমছে জমি-কৃষক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ মার্চ ২০২০, ৪:৩০:২৯ অপরাহ্ন
- লোকমান হেকিম
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি আমাদের প্রাণ। কৃষক আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারিগর। কৃষি খাতে সমৃদ্ধি মানে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া। ক্ষুধার বিরুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ে জিতে যাওয়া। কৃষি ও কৃষক বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। কৃষিই কৃষ্টি। কৃষিকে ঘিরেই বাঙালি সভ্যতার জাগরণ শুরু।
মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সর্বত্র কৃষির কোনো বিকল্প নেই। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজস্ব বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, পরিবেশ উন্নয়ন, দারিদ্র্যবিমোচন, বেকারত্ব দূর, আত্মকর্মসংস্থানসহ সবকিছুতেই কৃষির অবদান রয়েছে। ৪৭ বছরে দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। জমি কমেছে অথচ খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণ । প্রতি এক শতাংশ হারে বছরে ৫০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বাড়ছে ১.৫৪ শতাংশ হারে। ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য চাষিরা মাথার ঘাম পায় ফেলছেন। রোদ, বৃষ্টি, শীত, অভাব, অনটন, ক্ষুধাসহ হাজারো সমস্যা উপেক্ষা করে খাদ্য উৎপাদন করছে দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের জন্য। অথচ চাষিরা অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত।
সাম্প্রতিককালের এক গবেষণা তথ্যে প্রকাশ, মাত্র ২ বছরের ব্যবধানে দেশে আবাদযোগ্য কৃষিজমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৪ লাখ হেক্টর। ২০১৬ সালে ছিল প্রায় ৯০ লাখ হেক্টর বর্তমানে ২০১৯ সালে ৮৫.৭৭ লাখ হেক্টরে ঠেকেছে। এই কমার মধ্যে আবাদযোগ্য পতিত কৃষিজমির পরিমাণ ২.২৩ লাখ হেক্টর। গবেষণায় দেখানো হয়েছে কৃষক বিভিন্ন কারণে কৃষিকাজ থেকে নিজেকে অন্য পেশায় নিয়ে যাওয়ায় পতিত জমির পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সাল পর্যন্ত কৃষি ক্ষেত্রে জনশক্তি নিয়োজিত ছিল প্রায় ৭৫%। ঐ সময়ে জনশক্তি এবং অর্থনীতি কৃষিতে মজবুত ও নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে কৃষির কাজে নিয়োজিত জনশক্তির হার মাত্র ৪০.৬% অর্থাৎ কৃষি কাজে নির্ভরশীলতা কমেছে প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে মোট কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১৫১৮৩১৮৩, যা অতীতের চেয়ে অনেক কম। ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, কৃষি শ্রমিকের অভাব ও মজুরী বৃদ্ধিসহ নানাবিধ কারণ রয়েছে কৃষক পরিবার ও কৃষি ক্ষেত্র কমার পেছনে।
এদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মাথাপিছু জমির পরিমাণও কমছে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল ০.২৮ একর আর বর্তমানে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ০.২৫ একরে। প্রতিবছর জন্ম নিচ্ছে নতুন মুখ ফলে বছরে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ। সম্প্রতি ‘খাদ্য নিরাপত্তা বিজ্ঞান’ শীর্ষক এক সেমিনারের একটি গবেষণাপত্রে প্রকাশ, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৯ কোটি, তখন খাদ্যের প্রয়োজন হবে ৩ কোটি ১৫ লাখ মেট্রিক টন। আর ১৯৫০ সালে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২৫ কোটিরও বেশি। তখন খাদ্যের চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ৪ কোটি ২৫ লাখ মেট্রিক টন। তাল মিলিয়ে চাষযোগ্য জমির পরিমাণও কমবে। ২০২৫ সালে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে দাঁড়াবে ৬৯ লাখ হেক্টরে। ‘৫০ সালে যা এসে দাঁড়াবে মাত্র ৪৮ লাখ হেক্টর।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আগে ভাগেই সকলকে ভেবে চিন্তে এগুতে হবে। তাই খাদ্য ও খাদকের এ জগতে কৃষক শুধুই উৎপাদক নয়, নিজেও একধরনের খাদ্য। কৃষকের শ্রম খেয়ে জমিদার মোটা হয়েছে, রাজারা মহারাজ হয়েছে। অথচ যে লোকটি সবার খাদ্য জোগায়, সে-ই থাকে খাদ্যশৃঙ্খলের সবার নিচে। কৃষককে সবাই খায়, শোষণ করে, কিন্তু কৃষক কাউকে শোষণ করতে পারে না। কারণ, তার তলায় ঠকানোর মতো কোনো শ্রেণি নেই। দেশের কৃষি ও কৃষক অগণিত সমস্যায় জর্জরিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আর্থিক দুরবস্থা, উপকরণের অভাব এমন হাজারো সমস্যা নিয়ে এখানকার কৃষককে কৃষিকাজ করতে হয়। কৃষি উন্নয়নের জন্য বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, কৃষি উন্নয়নের বড় মূলধন। যতই এসবকে খাটাতে পারবে উন্নয়নের পথ ততই প্রশস্ত হবে।