বিদেশে ফকির
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ মার্চ ২০২০, ৪:০৮:৪৮ অপরাহ্ন
- ডা. সাঈদ এনাম
ওয়ারশো এক্সপো আন্তর্জাতিক কনভেনশন হল থেকে বেরিয়ে আমি আর ডা. সুমিত মুখার্জি বাইরে একটু ঘুরাঘুরি করছিলাম। সেমিনারের ২য় দিনে ভারত থেকে অংশ নেয়া সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. সুমিত দাদার সাথে পরিচয় হয়। সেশনের এক ফাঁকে হঠাৎ পিছন থেকে কে একজন বললো, আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া। চেয়ে দেখি আমাদের মত চেহারার এক যুবক আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। বুঝলাম এশিয়ান। ‘সরি, নো আই এম ফ্রম বাংলাদেশ’।
বাংলাদেশ শুনেই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সুমিত দা বললেন, ‘আরে বুকে আসুন দাদা, বুকে আসুন…’। বুকে বুক মিলিয়ে প্রাণ ভরে দম নিলাম দিলাম দুজনে। আসলে দুদিনে ইংরেজদের সাথে মিশে মিশে, ইংরেজি খানা খেয়ে খেয়ে দমটা আমার বন্ধ হয়ে আসছিলো।
ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন এর বার্ষিক সাধারণ সভা ও সায়েন্টফিক সেমিনারে বাংলাদেশ থেকে কেবল আমি তবে ইন্ডিয়া থেকে দেখলাম অনেক সাইকিয়াট্রিস্ট। সুমিত’দা বললেন, ‘এই সেশনের পর ঘন্টা দুয়েকের ব্রেক, চলুন দু’ভাই মিলে কোথাও ঘুরে আসি’।
হাঁটতে হাঁটতে দাদা জিগ্যেস করলেন, ‘আমার বাড়ি কলকাতায়, আপনার?’ আমি বললাম, ‘সিলেট’। দাদা সিলেট শুনে হেসে হেসে বললেন, ‘ওহ সিলেট। আমি গিয়েছি সিলেটে একবার’।
একটা শপিংসেন্টারে ঢুকে দু’কিপ্টে আয়েশ করে উইন্ড শপিং করলাম। দাদা’র সাথে আমার চমৎকার মিলে গেলো। যেহেতু জিনিসপত্র সবকিছুই আমাদের ওখানে সস্তা অযথা কেনো অর্থের অপচয়, তাই দুজনেই কিছু না কিনে দু’ঘন্টা কেবল এটা ওটা খেয়ে দেয়ে কাটালাম। দাদা’কে কেবল বললাম, খেয়াল রাখবেন যাতে খাবারে শুকর জাতীয় কিছু না থাকে। দাদাও আমাকে বেশ সাহায্য করলেন। তিনিই প্রতিবারই আমার সাথে খুটিয়ে খুটিয়ে আমার মেনু গুলো চেক করে নিতেন বার বার।
এধরণের বিদেশ কনফারেন্সে আমার মতো বাংগালী মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হয় খাবারের বাছবিচারে। কখন কি হয়ে যায়।
ফুটপাত ধরে হেঁটে হেঁটে দু’জন কনভেনশন হলে ফিরছি এমন সময় সুমিতদা চমকে বললেন, ‘সাঈদ ভাই, দ্যাখেন দ্যাখেন’। এক বৃদ্ধা ফুটপাতে ভিক্ষা করছে। ‘প্লিজ গিভ মি সাম ইউরো স্যার..’। দাদা বললেন, ‘দেখলেন, ইউরোপেও ফকির আছি। আমিতো ভাবতাম, ফকির কেবল ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশে’।
সামান্য কিছু দিয়ে দাদা পিছন থেকে তার কয়েকটি ছবি তুললেন । ‘…বুঝলেন, দেশে গিয়ে দেখাবো বন্ধুদের’। ইউরোপের রাস্তায় ভিক্ষুক থাকতে পারে এটা আমারও ধারনার বাহিরে ছিলো। সাইকিয়াট্রি কনফারেন্সে স্পিকার প্রেজেন্টার হিসাবে অংশগ্রহণ করতে ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশে ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে। কমবেশ সব জায়গায় ফুটপাতে হাটতে যেয়ে ফকির মিসকিন দেখেছি। ধারণা ছিলো রাস্তাঘাটে দুস্থ গরিব কেবল বাংলাদেশেই। নিউইয়র্কে তেমন চোখে না পড়লেও ক্যালিফোর্নিয়ার রাস্তায় অনেক ফকির দেখেছি। ওরা দলে দলে থাকে। একেবারে দীনহীন। ‘স্যার গিভ মি ওয়ান ডলার, স্যার প্লিজ গিভ মি ওয়ান ডলার’।
খুব মায়া হতো ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে। দিতাম। তবে একটু ভয় করতো, পাছে আবার জড়িয়ে না ধরে, ছিনতাইকারীর মতো। আসলে মানুষ নিতান্তই না পেরে মানুষের কাছে হাত পাতে। দুঃস্থ অসহায় মানুষকে সাহায্য করা পূণ্যের কাজ। সৃষ্টিকর্তা অনেক সময় দুঃখ কষ্ট দারিদ্র্যতা দিয়ে আমাদের পরীক্ষা করেন।
লেখক: সাইকিয়াট্রিস্ট, সহকারী অধ্যাপক, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ।