জীবনে হতাশা এবং হতাশার জীবন
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ জুলাই ২০২০, ১০:০০:৩৯ অপরাহ্ন
*ব্যারিস্টার আব্দুস শহীদ*
আমাদের সময় ইন্টারমিডিয়েটে এম.সি কলেজে পড়া অনেক গর্বের বিষয় ছিল। কারণ বৃহত্তর সিলেটের প্রতিটি ডিস্ট্রিক্ট থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীরা এই কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসতেন এবং তিন চার হাজার ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকে ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে যাচাই বাছাই করে নেয়া হত। আমরা যারা চান্স পেয়েছিলাম অবশ্যই আমরা প্রত্যেকে ভালো ছাত্রছাত্রী ছিলাম। লক্ষণীয় বিষয় ছিল – পরবর্তী জীবনে মোটামুটি ২৫০ জনই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। তো কিছু কিছু ছাত্রছাত্রীদের লক্ষ্যই ছিল যে তারা ডাক্তার হবে। একটি সেবা মূলক পেশা ! খুবই ভালো পেশা নিঃসন্দেহে। এই কোবিড – ১৯ এর সময়ই আমরা বুঝতে সক্ষম হয়েছি পেশাটা কতটুকু মহৎ একটি পেশা ! বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই পেশায় আসতে হলে অনেক পড়াশোনা করতে হয় ইন্টারমেডিয়েট লেভেলে। কারণ বাংলাদেশে অলমোস্ট প্রতি ছাত্রছাত্রীই ডাক্তার হতে চায়। ইংল্যান্ডে যদিও ১০০ জনের মধ্যে একজনও চাইবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। তার একটি কারণও আছে। আমাদের দেশে মানুষের পড়ালেখা শেষে চাকরির নিশ্চয়তা নেই মোটেই । অন্তত: এই পেশায় এলে মানুষ নিজে নিজে কিছু হলেও ইনকাম করতে পারবে , তা সে চাকুরী পাক অথবা না পাক। এজন্যই ছাত্রছাত্রীরা এ পেশায় আসতে বেশি আগ্রহী।
আমরা যারা এমসি কলেজে পড়েছি আমাদের বড় কনফিডেন্স ছিল যে আমরা এমসি কলেজে পড়ার চান্স পেয়েছি। এই কনফিডেন্সই আমাদের পরবর্তী জীবনে নিজেকে মূল্যায়ন করতে সাহায্য করেছে। আমাদের মধ্যে একটি আত্মবিশ্বাস ছিল যে আমরা সব কিছুই পারবো।
শুধু ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিতে পড়তে না পারলে অনেক ছাত্রছাত্রীরাই হতাশ হয়ে পড়তে দেখেছি। তারা ভাবতে থাকে জীবনে সম্ভবত আর কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু একটি সমাজে, একটি রাষ্ট্রে এই দুই পেশা ছাড়াও আরো অনেক পেশা আছে। দেশ চালাতে হলে প্রশাসনে মানুষ নিয়োগ করতেই হবে , ব্যাংকে নিয়োগ হবে , নিয়োগ হবে স্কুল কলেজে, ইউনিভার্সিটির শিক্ষক পদে, বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানে। আমাদের দেশে তরুণরা ফ্রাস্টেটেড না হয়ে বরং তাদের আশান্বিত হওয়া উচিত এই ভেবে যে তারাই ভবিষ্যতে এই দেশের জন্য চালিকা শক্তি। তাদের মধ্যেই একজন প্রধানমন্ত্রী হবেন , হবেন প্রেসিডেন্ট , সচিব হবেন। দেশ চালাবেন তারাই। আমার মতে স্কুল কলেজের শিক্ষা এবং সার্টিফিকেট হলো একজনকে একটি কনফিডেন্স দেয়া যে – যেদিন থেকে সার্টিফিকেট অর্জন করেছেন , তখনই শুরু হলো তার জীবনের শিক্ষা মাত্র। যেকোনো সাবজেক্টে আপনি পড়তে পারেন , এর অর্থ এই নয় যে এই সাবজেটেই আপনার ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। না , আপনার এডুকেশন হলো আপনার নিজের একটি কনফিডেন্স মাত্র এবং জীবন পথের চলার প্রাথমিক পদক্ষেপ।
একটি বিষয়ে শুধু আপনার লক্ষ্য রাখতে হবে – আপনি আপনাকে মূল্যায়ন করতে শিখতে হবে। আপনি ছাত্র হন অথবা ছাত্রী হন। আপনার রিজাল্ট ভালো হোক অথবা খারাপ হোক। আপনি যখন নিজেকে নিজে মূল্যায়ন করতে শিখবেন তখনই আপনি জীবনে কিছু করতে পারবেন। আপনি চিন্তা করে দেখুন আপনার জীবনে কোন একটি বিষয় যা আপনি করেছেন এবং সাফল্যের সহিত করেছেন। সেই ঘটনাই আপনাকে কনফিডেন্স এনে দিতে পারে। অন্য দশজন যা পারে তা আপনিও পারবেন। একটি পেশায় যেতে না পারা মানে জীবন শেষ নয়। কারণ জীবন-পথ অনেক বড় এবং কর্মজীবনের গন্ডিও অনেক বড়।
‘ঈর্ষা’ নিয়ে আমি একটি পোস্ট দিয়েছিলাম ফেইসবুকে যে প্রতিযোগিতা এবং প্রতিহিংসা দুইটি পৃথক শব্দ, আমাদের প্রথমটিই প্র্যাক্টিস করা উচিত , দ্বিতীয়টা নয়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে পরে আরো ভেবেছি অনেক। পরবর্তীতে আমি আমার অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছি। ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, অমঙ্গল কামনা, প্রতিহিংসা এগুলো মূলত একই অর্থ বহন করে। তারপরও আমরা অহরহ এই শব্দগুলো ব্যবহার করে থাকি। পার্টিকুলারলি, ঈর্ষা শব্দটি আমরা ভালো অর্থেও ব্যবহার করি। যেমন কেউ এমন কোনো সাফল্য অর্জন করেছে যা অর্জন করা অনেকের সাধ্যের বাইরে মনে করে এবং সহজেই বলবে ‘তাঁর সাফল্য দেখে ঈর্ষা হয়’। এ কথা দিয়ে বক্তা এখানে সাফল্যকারীর প্রশংসাই করেন। এখানে এই ঈর্ষা খারাপ অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে না , অথবা বলতে পারি বক্তা এই শব্দটি যখন বলেন, ক্ষুদ্র মানসিকতার পরিচয় দেন না নিশ্চয়ই।
দেখেন হিংসা না থাকলে কিন্তু প্রতিযোগিতা করা যায় না। অন্যদের সাফল্য দেখে আপনি ঈর্ষান্বিত না হলে জীবনে কিছু করতে পারবেন বলে মনে হয় না। ঈর্ষার একটি লিমিট থাকা প্রয়োজন যদিও। আর সে লিমিট হবে অন্যের সাফল্যে হিংসায় নিজে নিজেকে জ্বালিয়ে না ফেলা। আমরা মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়েছি। আমাদের হাত পা সব কিছুই আছে অন্য দশজন মানুষের মত। প্রাথমিক ভাবে ধরে নিতে হবে অন্যরা যা পারে আমিও তা পারবো। নিজে নিজেকে প্রথমে আবিস্কার না করতে পারলে , নিজে নিজের যোগ্যতা নির্ণয় করতে না পারলে জীবনে নিজেকে দিয়ে ভালো কিছু করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এমনকি ভাল কিছু হয়তো আপনাকে দিয়ে করাই হবে না। আসলে আমরা নিজেদের ‘একটি সাফল্যকে’ চিহ্নিত করে ভাবতে শিখতে হবে যে – আমি অন্যদের চেয়ে কম নই। এরকম ভাবার মাঝে কোনো অহংকারের কিছু নাই। আমরা আমাদের সংস্কৃতিগত ভাবে অন্যদেরকে আমাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে সুযোগ করে দেই। আমরা আমাদের সাবমিসিভ স্বভাবের কারণেই অন্যদেরকে আমাদের চেয়ে বড় ভাবতে সুযোগ করে দেই। আমরা নিজেদেরকে অন্যের চেয়ে কোনো অংশে কম ভাবার আগে নিজে নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে জানতে হবে।
আমি মনে করি আমাদের মধ্যে অন্যের সাফল্যে ঈর্ষা করা উচিত এতটুকুই, যে আমরা নিজেকে প্রশ্ন করবো আমি কেন তা পারবো না। অন্যের সাফল্য হিংসা মানে – গীবত করা অথবা তাকে ভৎসনা করা নয় , তাকে ক্ষতি করাও নয়, বরং এত টুকুই ঈর্ষা হওয়া উচিত যে আমিও তার মত রক্তে মাংসে একজন মানুষ, আমারও হাত পা আছে , আছে বিচার বুদ্ধি । এমনও হতে পারে যে আমার নিজের কাছে আছে লুকিয়ে এমন একটি প্রতিভা, যা অন্যের কাছে নাই , তাই বিকশিত করবো। আমি নিজেকে যদি অন্যের চেয়ে ছোট ভাবতে থাকি তবে অন্যরা নিজেকে আমাদের চেয়ে বড় ভাবতে থাকবে। আরো আছে অনেক কিছু , যা সক্ষেপে বললে উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধকতা। আমরা সবাই যে একই পেশায় আসতে হবে তা হবে কেন ? আমরা আমাদের নিজ নিজ জায়গা আমরাই চিহ্নিত করবো এবং সেই লক্ষ্যে পরিশ্রম করে উন্নতি করবো। ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রতিযোগিতা করবো এবং অন্যের চেয়ে নিজেকে পার্থক্য করেই উপস্থাপন করবো। আর যারা পিছনে কিছু বলে তাদের জন্য আমাদের জীবনকে কেন ঘুচিয়ে রাখবো ? আমাদের সাফল্য দিয়েই তথাকথিত নিন্দুকদেরকেও সমাজের সুন্দরতম স্থানে নিয়ে আসতে স্বচেষ্ট হবো। এর অর্থ এই যে আমরা যখন সাফল্য অর্জন করবো, তখন নিন্দুকরাও সত্যিকারের ভালো মানুষ হয়ে যাবে এবং তারাও এগিয়ে আসবে একটি কিছু করতে , নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবে। একেকজনের সাফল্য হবে অন্যজনের অনুপ্রেরণা।