নিত্যপণ্যের বাজার কী আমরা হারাতে বসেছি
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ জানুয়ারি ২০২১, ৫:৫৬:০৬ অপরাহ্ন
সৈয়দ মুলতাজিম আলী বখতিয়ার
বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী প্রফেসর শাহেদ আলীর বিখ্যাত ছোটগল্প ‘ফসল তোলার কাহিনী’। শাহেদ আলী সাহেব ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের মানুষ। শাহেদ আলী সাহেবের উল্লিখিত গল্পের প্রতিপাদ্য মূলত: সুনামগঞ্জের ধান বোরো ফসল তোলার মৌসুমের আনন্দ এবং উদ্বেগ, আশা ও নিরাশার দোলাচলে দুদোল্যমান কৃষককূলের সংগ্রামী জীবনকথা। বোরো ধানকাটার মৌসুম মূলত: চৈত্রের মাঝামাঝি হতে পুরো বৈশাখ মাসব্যাপি; পাশাপাশি বছরের এই সময়টায় প্রকৃতির আকস্মাৎ বিরূপ আচরণের কারণে ফসল তোলা নিয়ে হাওর অঞ্চলের মানুষেরা থাকে খুবই আতংকগ্রস্থ। কালবৈশাখী, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত কিংবা হাওরে ঢলের পানি প্রবেশ করে মুহুর্তেই হাজার হাজার একর হাওরের ফসল নষ্ট করে দিতে পারে। এহেন দুর্ভোগের শংকায় বোরো ফসল তোলার মৌসুমে আমাদের দেশের হাওরাঞ্চলের কয়েক লক্ষ চাষী ধানকাটা নিয়ে থাকে সদা সর্বদা খুবই ব্যতিব্যস্ত তটস্থ, শংকিত। প্রকৃতির এই প্রতিকুল আচরণ কৃষাণের হাসির ঝিলিক, কান্না আর আহাজারীতে পরিণত হতে তাই সময়ের ফারাক হয় খুবই স্বল্প। তাই সামগ্রিকভাবে উক্ত গল্পে একটি অঞ্চল বিশেষ এবং একটি বিশেষ মৌসুমের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।
অন্যদিকে অগ্রহায়ণ মাসে যে ফসল কাটা হয় সেটা হচ্ছে আমন ফসল এবং সারা বাংলাদেশের সর্বত্রই এ ফসল চাষ ও তোলা হয়। ফসল কাটার মৌসুম অগ্রহায়ন মাস, ঋতুচক্রের হিসেবে হেমন্ত ঋতু। তখন প্রকৃতি থাকে বছরের মধ্যে সবচাইতে অনুকূলে, ঝলমলে রোদ্দুরভরা দিনে। কোন ধরণের প্রাকৃতিক বিরূপতার কারণে তাই এই সময়ে ফসলহানির প্রশ্নই উঠে না। অগ্রহায়নের ফসল কাটার আগের মাসটাকে বলা হত ‘মরা কার্তিক’ আর অগ্রহায়ণ মানেই অফুরন্ত আনন্দ, রোদ ঝলমলে দিনে ফুরফুরে মেজাজে কৃষকের ধানকাটা, আর সেই ফসলে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ শুধু নয়; ফসল তোলার এ মৌসুমটি আবহমান বাংলার মানুষের জন্য এক চিরায়ত উৎসব। স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে “মাছে ভাতে বাঙালী” প্রবাদ বহুলাংশে এই আমন ফসল নির্ভর।
২০২০ সালের অগ্রহায়ণ মাসে আবহমান বাংলার রীতি অনুযায়ী ধানকাটা ও ফসল তোলা হচ্ছে কোন ধরণের ব্যতিক্রম ছাড়াই। তবে ব্যতিক্রম কেবল একটি জায়গাতেই, এ বছর ফসল তোলার ভরা মৌসুমে ভোক্তার মনে আনন্দ নাই; ক্রমবর্ধমান চালের দামের উর্ধ্বগতির কারণে। এ প্রবন্ধ যখন লিখছি পঞ্চাশ কেজির চালের বস্তা তখন ২৮০০ থেকে ৩০০০ কিংবা ৩০৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
কেজি প্রতি গড় বৃদ্ধি ১০ থেকে ১৫ টাকা। প্রশ্ন হচ্ছে পর্যাপ্ত উৎপাদন ও সরবরাহের মধ্যেও কোন কারসাজিতে বাজার অর্থনীতি তত্ত্ব শতভাগ ফেল মারল, কে বাড়াচ্ছে চালের দাম, কাদের সম্মিলিত অপপ্রয়াসে এই করোনাকালে ফসলের ভরা মৌসুমে ভোক্তার পকেট কাটা হচ্ছে? এই চক্রটা কি কোন অশরীরি আত্মা; যাদের ধরা ছোয়া যায় না? খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ পাইকারদের প্রতি, আর পাইকাররা দোষে মিল মালিকদের। অন্যদিকে, মিল মালিকরা বলে ধানের বাজার নাকি চড়া। ধানচাষীদের আজীবনই অভিযোগ তারা ধানের সঠিক মূল্য পায় না। ক্ষেত্র বিশেষে অভিযোগ এতটাই গুরুতর পর্যায়ে পৌছে যে, ধানের সঠিক মূল্য পাওয়া দূরে থাক, ধান চাষ থেকে শুরু করে ফসল বোনা পর্যন্ত যে অর্থ ও শ্রম ব্যয় হয়, সেটাই তোলা যায় না। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা চাষীদের অভিযোগকে সত্যায়িত করে।
এক্ষেত্রে বাজার বিশ্লেষকদের অভিযোগ সর্ষের মধ্যে ভুত আছে কি-না তা অবশ্যই পর্যবেক্ষণের বিষয়। বাজার নজরদারী ভেঙে না পড়লে অবশ্যই এমনটি হতো না। কিন্তু যারা বাজার মনিটারিং করছেন, তাদের নীতি-নির্ধারণী জন-বান্ধবহীন হওয়ার কারণে এই চক্রের সাথে কোন না কোনভাবে তাদেরই যোগসূত্র আছে কি-না, সেই রহস্য উদঘাটন এখন সময়ের দাবী। কারণ সরকারী সিদ্ধান্তগুলো বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে। আর এ কারণেই আজ এখানে ভোক্তা ও কৃষক হচ্ছে বঞ্চিত ও উপেক্ষিত।
মাঠ পর্যায়ে অভিযোগ সর্ষের ভুতসব সময়ই অদৃশ্য থাকে, যারা কি-না নিজেদের স্বার্থে ব্যবসায়ীদের দিয়ে চালের বাজারে আগুন লাগিয়েছে। জোরদার বাজার মনিটরিং থাকলে এই ভরা মৌসুমে চালের এই অযৌক্তিক উর্ধ্বগতি অবশ্যই হতো না। আমরা বিশ্বাস করি, সত্যিকার বাজার মনিটারিংয়ের বিকল্প চাই। তবেই অঘটনের নেপথ্য কুশলীরা বেরিয়ে আসবে। করোনার কারণে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের আয়-রোজগার অর্ধেক কিংবা তার চাইতেও কমে এসে ঠেকেছে। এমনও আছে যাদের আয়-রোজগার একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে, অপরের সাহায্য-সহযোগিতাই যাদের ক্ষন্নিবৃত্তি নির্ধারণের একমাত্র উপায়। চাল ছাড়াও ভোজ্য তেল ও পিয়াজ সহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েই চলছে। একটা অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থার কারণে আজ মানুষ দূর্বিসহ দিন যাপন করছে।
এ অবস্থায় বিদেশ থেকে চাল আমদানীর মাধ্যমে চালের চাহিদা মেটানোর সরকারী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে নতুন সংযোজিত আর একটি দু:সংবাদ আমাদের পিয়াজ চাষীদের হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত করে দিচ্ছে। গত দু’বছর যাবত আমাদের পিয়াজের সংকটকালে ভারত বাংলাদেশে পিয়াজ রপ্তানী বিনা নোটিশে বন্ধ করে দেয়। তখন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী ভারত তাদের এহেন, অনৈতিক কর্মের জন্য আমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে বলে মিডিয়াতে ব্রিফ করেন। এ ঘটনা গত জুলাই বা আগস্ট মাসের। হিলি, বেনাপোল বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে শতশত পিয়াজ বোঝাই ট্রাক আটকে আছে বলে আমাদের আশার ঝিলিক দেখানো হয়। ইতিমধ্যে ২০১৯ সালে পিয়াজের দাম কেজি প্রতি ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০/২৫০ এমনকি ৩০০ টাকাতে বিক্রি হয়। ২০২০ সালে পিয়াজের দর এতটা না বাড়লেও প্রতি কেজি ৮০ টাকা থেকে ১০০/১২০ টাকা বিক্রি হতে থাকে।
পরবর্তীতে তুর্কি থেকে পিয়াজ আমদানী হলে পিয়াজের কেজি প্রতি দর ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসে। লক্ষণীয় যে, জুলাই-আগস্ট থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ৫/৬ মাস অতিবাহিত হয়ে যায়; ভারতীয় পেয়াজ আর বাংলাদেশে এসে ঢুকে না। পিয়াজ চাষের অনুকুল মৌসুমে এলে পিয়াজ চাষীরা পরিস্থিতি বিবেচনায় লাভের আশায় বিপুল পরিমাণ দেশীয় পিয়াজ চাষ করে। আর এ সময়েই কিনা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো পিয়াজ চাষীদের হৃদয় বিদীর্ণ হওয়ার মতো ভারতীয় পিয়াজ বাংলাদেশে আমদানীর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এটি কার্যকর হলে চাষীরা একদিকে কৃষিতে উৎসাহ হারিয়ে বেকারত্বের অভিশাপে ভূগবে; অন্যদিকে এ (মহান?) কাজখানি গত দু’বছরের ন্যায় আগামী চার পাচ বছর চালিয়ে যেতে পারলে নব প্রজন্ম বুঝতে শিখবে আঙ্গুর আপেলের ন্যায় পিয়াজ ও এক মহার্ঘ্য আমদানী পণ্য; অতএব এর ক্রয়মূল্য বিনা দ্বিধায় খুবই উচ্চবর্ণের হওয়াই স্বাভাবিক!
চাল রপ্তানী বিষয়ে সরকার মহোদয়ের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা একটাই, এই মৌসুমে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ চালের কী হলো, কোন উথাল হাওয়ায় উঠে বেড়াচ্ছে কৃষাণের রক্ত-ঘাম পানি করা বাঙালীর মুখের গ্রাস; এর একটা সুরাহা করে সেই রিপোর্ট জাতির সামনে তুলে ধরতে পারলে কতই না ভাল হতো।
(দুই)
২০২০ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দেশের প্রায় সবকটি টিভি চ্যানেলে একটি সচিত্র প্রতিবেদন দেশের সমস্ত সংবেদনশীল মানুষকে সাংঘাতিকভাবে মর্মপীড়া দিয়েছে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের হাজার হাজার হেক্টর জমিতে আখচাষীরা আখের সঠিক মূল্য না পেয়ে আখক্ষেত আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের ভারী শিল্পগুলোর মধ্যে একসময় কৃষি নির্ভর চিনিশিল্প আমাদের নিজস্ব চাহিদা মিটাত, পাশাপাশি এর মাধ্যমে আমাদের রপ্তানী আয়ও হতো। এ শিল্প তখন এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, ফরিদপুর জেলা থেকে শুরু করে একেবারে উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর জেলা পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক ছোট বড় চিনিকল চালু ছিল। এই চিনিকলগুলোর আখের ছোবড়ার উপর ভিত্তি করে পাবনার পাকশীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেশের অন্যতম বৃহত্তম ‘নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল’। একটি কৃষিজাত পণ্যের ভিত্তিতে দু’ধরণের ভিন্ন ভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা ছিল নিঃসন্দেহে তখনকার জামানায় আমাদের জাতীয় জীবনে এক বিশাল গৌরবময় অর্জন।
চিনিকলগুলোর অধিকাংশই আজ বন্ধ; আর কোন কোনটির দশা বড়ই করুণ; কোনমতে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। ফলশ্রুতিতে পাকশীতে প্রতিষ্ঠিত নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলটিও আজ বন্ধ দীর্ঘকাল যাবত। এই সুযোগে একসময় যে পণ্যগুলো ভারতে রপ্তানী হতো, এখন উল্টো সেগুলো ভারত আমাদের দেশে রপ্তানী করছে। অসংখ্য কেমিকেলের সমাহার ভারতীয় চিনি খাদ্যগুণের চাইতে মানব দেহের জন্য ক্ষতিকারক বিষেভরা। পাটশিল্পে একসময় বিশ্বে আমাদের শীর্ষ অবস্থান ছিল। বিশ্বের বৃহত্তম জুটমিল আদমজী সহ প্রায় সমস্ত জুটমিলগুলো আজ বন্ধ। একসময়কার আমাদের ভারী শিল্প কেন্দ্রীক রপ্তানী বাণিজ্যগুলো আজ বন্ধ হয়ে গেছে। সত্যিকার অর্থে একটি দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ হচ্ছে সে দেশে প্রতিষ্ঠিত তার ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, সীমাহীন দুর্নীতির কারণে এগুলো বন্ধের একটি বড় কারণ; আর সেই সাথে যুক্ত হয়েছে বৈধ পথে কিংবা চোরাচালানীর মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে নি¤œমানের ভারতীয় পণ্যের অনুপ্রবেশ।
সুগার মিলগুলো বন্ধের মূল কারণ হচ্ছে চাষীরা মিলে ঠিকই নিয়মমাফিক আখ সরবরাহ করে, কিন্তু মাসের পর মাস অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও মিল কর্তৃপক্ষ আখের মূল্য পরিশোধ করে না; পরিণামে একসময় আখ চাষীরা মিলে আখ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় এবং শেষমেষ মিল বন্ধ। এ ব্যপারে সাবেক সচিব জনাব মোফাজ্জল করিম তার আত্মজীবনী “জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্যু গ্রন্থে বর্ণিত অভিজ্ঞতার কথা এখানে তুলে ধরা খুবই জরুরী বলে আমরা মনে করি। ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসের দিকে তাকে কুষ্টিয়া জেলার ডিসি বানিয়ে পাঠানোর প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান বাসভবনে ডেকে নিয়ে বলেন যে, “তোমাকে বাবা অনেক আশা করে আমি কুষ্টিয়া পাঠাচ্ছি। সেখানকার আখ চাষীরা নাকি সুগারমিলে আখ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়াতে কুষ্টিয়া জগতি সুগার মিলটি বন্ধ হয়ে গেছে। ওখানকার প্রশাসনিক কর্মকর্তারা কিছু করতে পারছেন না। তুমি গিয়ে সেটা আবার চালু করবে। কুষ্টিয়া বদলি হলে পরে সেখানে তখনকার বিদায়ী ডিসি জনাব আব্দুল হাই সাহেবের কাছ থেকে এ ব্যাপারে যা জানতে পারেন তা নি¤œরূপ, “কুষ্টিয়া সুগার মিল কর্তৃপক্ষ তাঁকে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আখ মাড়াই উদ্বোধন করান ঠিকই কিন্তু তারা সে পরিমাণ আখ সংগ্রহে যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন, তা ডিসি সাহেবকে জানাননি।
ফলে উদ্বোধনের ১৫ মিনিট পর সত্যি আখ মাড়াই বন্ধ হয়ে যায়। বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলামের কানে চলে যায়। তিনি তার পি এস (ও শ্যালক) ইনকাম ট্যাক্স সার্ভিসের কর্মকর্তা আব্দুস সোবহানকে এ ব্যাপারে ডিসির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে বলেন। ডি সি সাহেব ফোনে আমাকে বলেন পি.এস নাকি তার সঙ্গে উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন। তিনিও নাকি তাকে দু’কথা শুনিয়ে দেন। তার দুলাভাই সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নাকি বলেন, এই ডিসি তো আখ চাষীদের পক্ষে, ইনি থাকলে মিল চালানো যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী টু.পি.এস; পি.এস.টু সাইদ হোসেন এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাই সাহেব আউট আমি ইন”। “সার্কিট হাউজের গেটেই দেখা হল কুষ্টিয়া (জগতি) সুগারমিলের জেনারেল ম্যানেজার আর আর খানের সঙ্গে। মিলের খবর জানতে চাইলে সবার সামনেই তিনি আখ চাষীদের বয়কটের কথা, তার ও তার সহকর্মীদের আপ্রাণ চেষ্টার কথা, জেলার ভয়াবহ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নিত্যদিনের জ্বালাও পোড়াও লুট পাটের একটা বয়ান দিয়ে বুঝাতে চাইলেন, এ পরিস্থিতিতে আপাতত: মিল চালানো সম্ভব নয়”। তাহলে কবে নাগাদ চালু হবে মিল? আমি সরাসরি জানতে চাইলাম। তাতো বলতে পারছি না, মৃদু হেসে জবাব দিলেন, জি এম সাহেব। শুনে- ‘আমার পিত্তি জলে গেল।” হঠাৎ মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল একটা রুঢ় উক্তি, “মিল কবে চালু হবে জানেন না, আর এদিকে লাঞ্চ খেয়ে বেড়াচ্ছেন। আপনি খাওয়ার পর সোজা মিলে যান এবং তিন দিন পর যাতে মিল আবার চালু হয় সে ব্যবস্থা করুন। জেনে রাখুন, আমি এখানে এসেছি আপনারই কারণে লাঞ্চ ডিনার খেয়ে ফুর্তি করতে নয়”।
এ লেখারই পরবর্তী বর্ণনা মতে, “সারাদিন ঘুরে ঘুরে কয়েকটি থানা, অনেকগুলো ইক্ষু ক্রয় কেন্দ্র, কিছু ইউনিয়ন পরিষদ অফিস দেখে এবং লোকজনের সাথে কথা বলে আমার ধারণা হলো, আখের ন্যায্য মূল্য না পাওয়াই হচ্ছে চিনিকলে আখ চাষীদের আখ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার মূল কারণ। চিনি কলগুলোও পর্যাপ্ত আখ সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষে আমি দায়িত্বভার নিয়েই আখের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠালাম। সরকার তাৎক্ষণিকভাবে আখের দাম মনপ্রতি একটাকা না দুটাকা জানি বাড়িয়ে দিল। এতে এক মণ আখ বিক্রি করে বোধ হয় পাওয়া যেত আট টাকা। তাতেও চাষীর পোষাত না। তার চাইতে আখ মাড়াই করে গুড় বানানোতে বেশী লাভ ছিল। কিন্তু সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মিল এলাকাতে আখ মাড়াই আইনত নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু চাষীরা নিষেধ অমান্য করে লুকিয়ে চুপিয়ে চালতো মাড়াই কাজ। এসব বেআইনী কাজ বন্ধের জন্য সরকারের কাছে প্রশাসনের উপর প্রবল চাপ ছিল। কিন্তু প্রশাসন ও পুলিশের কিছু কিছু কর্মচারীর কর্তব্যে অবহেলার কারণে মাড়াই চলছিল মোটামোটি অবাধে। কুষ্টিয়ার যজ্ঞেশ্বর কোম্পানী নামে সে সময়ের এক নামকরা কোম্পানী ছিল এর প্রস্তুতকারক। চাষীদেরকে এরা গুড়, উৎপাদনের জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে নানাভাবে উৎসাহ প্রদান করত।
চূড়ান্তভাবে লেখকের সার বক্তব্যটি হচ্ছে এই যে, সেই অবৈধ কর্মযজ্ঞটি সরাসরি ডিসি সাহেবের হস্তক্ষেপে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দিলে তিনদিনের মাথার সুগার মিলটি ঠিকই উৎপাদনে যেতে সক্ষম হয়।
অনভিজ্ঞ, অপরিপক্ষ ও দুর্নীত পরায়নদের হাতে প্রাতিষ্ঠানিক নির্বাহী ক্ষমতা অর্পিত হলে লাভের পরিবর্তে লোকসান হয়। আধুনিক বিশ্বের সভ্যতার সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য চাহিদা অনুযায়ী কলকারখানা গড়ে উঠছে না বরং প্রতিষ্ঠিত শিল্প কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে আমাদের দেশের নীতি নির্ধারকেরা শিল্প কারখানা স্থাপনে মনোযোগী না হয়ে ইংরেজদের অনুকরণে বিদেশী পণ্য আমদানী এবং দেশীয় পণ্যের উপর বিভিন্ন করারোপ করে এদেশকে বিদেশী বাজারে পরিণত করেছেন। সেই সাথে শুরু হয়েছে চাল, ডাল, পিয়াজ রসুনের মতো নিত্যদিনকার সরাসরি ভোগ্য পণ্য উৎপাদনে চাষীদের নিরুৎসাহিত করার নতুন আত্মঘাতী কৌশল।
জাপানের প্রায় অর্ধেক অরণ্যময়। এখানে অক, তুঁত এবং প্রচুর বেত জন্মে। পর্বতময় বলে কৃষিযোগ্য ভূমির পরিমাণ খুবই কম। সমগ্র জাপানের মাত্র পাচভাগের একভাগ অংশ আবাদযোগ্য সমতল ভূমি। এজন্য অনেক পর্বতপাত্রে ধাপকেটে তারা কৃষি কাজ করে।
আর আমাদের দেশে প্রতি ইঞ্চি ভূমি কৃষিযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র দেশপ্রেম ও স্বাজাত্যবোধের অভাবে এখানে কোন কৃষিজাত শিল্প গড়ে উঠছে না কিংবা যে টুকুই আছে চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।
ইক্ষুর ন্যায় মৌসুমে টমেটো, আলুর দাম না পেয়ে লক্ষ লক্ষ টন তাদের কষ্টার্জিত পণ্যগুলো চাষীরা সড়ক মহাসড়কে ফেলে দেয়ার মতো হৃদয় বিদারক ঘটনাও প্রতি মৌসুমেই এদেশে অহরহ ঘটছে।
পৃথিবীর এমন কোন অঞ্চল নাই যেখানকার মানুষেরা কোন না কোনভাবে টমেটো না খায়। আমাদের উৎপাদিত এই টমেটো, আম, কাঠাল, আনারস এগুলো রকমারী পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত করে পৃথিবীর নানা অঞ্চলে রপ্তানী করা যেত। এদেশে শতশত ফুড প্রসেসিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ লোকের রুটি রোজগারের পথ খুলে যেত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংস্তুপে পরিণত হওয়া দেশ জাপান আজ বিশ্বে সর্বোন্নত শিল্প সমৃদ্ধ দেশ। দৃঢ়তা, একাগ্রতা অসাধারণ দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অতি অল্প সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়ে তারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়।
বিশ্বব্যাংক, আই.এম.এফ, আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী পাশের কিংবা দূরের কোন বন্ধুরাষ্ট্র কখনো চায় না আমাদের অর্থনীতির স্থায়ী ভিড় সৃষ্টি হোক। তাই আজ দেখা যায় আমাদের গৌরব, আমাদের ঐতিহ্য ভারী শিল্পগুলোকে ধ্বংস করে হাস, মুরগী ছাগল ও মাছ চাষের পরামর্শ দেয়। এনজিও রা মাইক্রো ক্রেডিট চালু করে। এসব করে ভিক্ষাবৃত্তি রোধ করা যায়। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটানো যায় না। আমাদের রপ্তানি ও বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে রুগ্ন শিল্পগুলোর পুন:স্থাপন ও পুনরায় চালুর বিকল্প নাই।