সাতক্ষীরা হয়ে সুন্দরবন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৬:২২:৪০ অপরাহ্ন
মুশাহিদ বিন মুছাব্বির:
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে সজ্জিত জেলা সাতক্ষীরা। নদ-নদীর আঁকাবাঁকা গতি, সুন্দরবনের সাজানো গাছের সারী আর বেশ কিছু পুরাতন স্থাপনা সহজেই মুগ্ধ করে যেকোন পর্যটককে। জেলার মোট আয়তনের এক তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে ‘সুন্দরবন’। যা বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের এক অপার লীলাভূমি এই ম্যানগ্রোভ বন। বঙ্গোপসাগরের উপকূল এবং ভারতীয় সীমান্তে অবস্থিত এই সাতক্ষীরা নামক অঞ্চলে মানব বসতি গড়ে উঠার আগে ছিল এক বিস্তীর্ণ জলাভূমি। অনেক পরে মানব বসতি গড়ে উঠেছে। যদ্দুর জানা গেছে, কোন এককালে ‘সাত মনীষী’ সাগর ভ্রমণে এসে একান্ত শখের বসে ‘ক্ষীর’ রান্না করে খেয়েছিলেন। পরবর্তীতে এই “সাত ব্যক্তির ক্ষীর” খাওয়াকে কেন্দ্র করে “সাতক্ষীরা” নামকরণ হয়। কেউ কেউ মনে করেন, জমিদার বিষ্ণু রায়ের ছেলে প্রাণ নাথ রায় ‘সাতঘর’ ব্রাহ্মণ এনে তার পরগনায় বসবাস করতে দেন। এই সাতঘর থেকে সাতঘরিয়া, এবং সাতঘরিয়া থেকে সাতক্ষীরা নাম ধারণ করে। সেই সুবাধে ১৮৬১ সালে যশোর জেলার অধীনে এই সাতঘরিয়ায় ৭টি থানা নিয়ে মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮২ সালে খুলনা জেলা প্রতিষ্ঠিত হলে সাতক্ষীরাকে খুলনা জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এবং সর্বশেষ ১৯৮৪ সালে সাতক্ষীরাকে মহকুমা থেকে জেলায় উন্নিত করা হয়। ঢাকা থেকে সড়কপথে এ জেলার দূরত্ব ৩৪৩ কিমি। আর আয়তন হলো ৩৮৫৮ বর্গকিমি। ছিমছাম এই শহরটাকে দেখার জন্য ভ্রমণপ্রেমী মানুষ সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন দূর থেকে আরো দূরে। এমনই একজন ভ্রমণপ্রেমী মানুষ আলমাছ ভাই। আমরা দুজনই সিলেটের বাসিন্দা। সাতক্ষীরা ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিতে একটু দেরি করে ফেললাম। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করলো সুন্দরবনের ভিতরে খুব সুন্দর একটি রিসোর্ট। ওখানে দুই রাত কাটিয়ে রিসোর্টে নিজস্ব লঞ্চে করে সুন্দরবনে বেড়ানোর সুযোগটা হাতছাড়া করতে নারাজ। সে এক অন্যরকম আনন্দ। বাগেরহাটের মংলা দিয়ে সুন্দরবন ঘুরেছি কিন্তু সাতক্ষীরা হয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ নি:সন্দেহে এক নতুন মাত্রা যোগ করে দিল। পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী রাত ৮টায় খুলনাগামী বাসে চেপে বসলাম। পুরো রাত জার্নি করে যখন আমরা সোনাডাঙ্গায় নামলাম তখন ঘড়িতে ৮ টা ছুঁই ছুঁই। সেখান থেকে নাস্তা সেরে সাতক্ষীরার গাড়িতে উঠলাম। টার্গেট মুন্সিগঞ্জের ভরসা রিসোর্ট। অনেক সময় নিয়ে পোঁছলাম গন্তব্যে। মোটামুটি দিনের সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলান দিয়ে ফেলেছে। রাতে দুজন মিলে রিসোর্ট ঘুরে ঘুরে দেখলাম। টানা ২৪ ঘন্টার জার্নিতে কিছু দুর্বল হয়েও পড়লাম। হেব্বী একটা ডিনার করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে প্রস্তুতি নিলাম। তাড়া দিতেই আলমাছ ভাই প্রস্তুত। কারণ রিসোর্টের কূলঘেঁসে চুনা নদীতে নোঙর করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে নির্ধারিত লঞ্চ। আজকে আমরা এই লঞ্চের যাত্রী। সকলের সাথে আমরাও উঠে পড়ি লঞ্চে। চুনা নদীতে যাত্রা করে পেটুয়া নদীতে পড়লো। অনেক বড় নদী। ডানে সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য এবং এরই মাঝে গাছপালায় উড়ে বেড়াচ্ছে নানান জাতের পাখি। হালকা রোদের আলোয় চিকচিক করছে নদীর পানি। মৃদুমন্দ বাতাসে মনটা প্রফুল্ল। এই মনোরম পরিবেশে আমাদের সাথে আরো অনেকেরই মনে এক ভালো লাগার অনুভূতি। সকলেই অধীর আগ্রহে দেখছেন ঘন জংগল। কেউ কেউ মোবাইলের ক্যামেরা অন করে উপর্যুপরি ছবি তোলায় ব্যস্ত। অবশ্য অনেকের সাথে উঝখজ ও আছে। হরিণের পাল প্রায়ই দেখা মিলে। কিন্তু বাঘ নয়। ভাগ্যে থাকলে হয়তো দেখতে পারেন। চলন্ত লঞ্চে আর বাতাসের সাথে চলছে গপ্প, আড্ডা, গান। এমন করে আমাদের বহনকারী লঞ্চ কলাগাছী নদীতে। আগের চেয়ে অনেক স্বচ্ছ পানি এখানে। এভাবেই চলছে তো চলছেই। ঘন্টা খানেক পরেই দিল যাত্রা বিরতি। এখানে ফরেস্ট রেঞ্জের ভিতরে আছে বিশাল পুকুর। নদীর পানি লবণাক্ত থাকায় স্থানীয়রা ব্যবহার করে। এবং এটাও শুনা গেছে, বাঘ নাকি গভীর রাতে এই পুকুরে মিষ্টি পানির জন্য আসে। বাঘ দেখার জন্য কেউ কেউ অবস্থান করেন এখানের ওয়াচ টাওয়ারে। সে এক আলাদা অনুভূতি। সময় ফুরিয়ে এলে আবার সকলের সাথে লঞ্চে উঠলাম। আলমাছ ভাই এট্টু ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলেন। লঞ্চ যখন সাঁইরেন বাজালো তখনই আলমাছ ভাইর ভোঁ-দৌড়। চলছে আমাদের লঞ্চ। বিশাল নদীর পানিকে দু-পাশে টেলে সাদা ফেনা তৈরি করে মন্থর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ধূ-ধূ বাতাসে ক্লান্ত শরিরে চোখে ঘুম-ঘুম ভাব করছিলো। বহুদিন পরে যেনো নির্মল বাতাসের ছোঁয়া পেলাম। কিছুক্ষণ পরেই চলে গেলাম কলাগাছী। এক লাফেই তীরে নামলাম। বানরের দল আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেও একটু ভয় লাগছিলো। কারণ আমাদের লাফের সাথে তারাও লাফাচ্ছিলো। অনেক অনেক দর্শনার্থীদের সমাগম এখানে। কাউকে আপন করে নিতে কোন বাধা বিপত্তি নেই। যে কাউকেই আপন করে নিতে সময় লাগবেনা। শুধু ইচ্ছেটাই যথেষ্ট। যে কারো সাথে সম্পর্ক গড়া যায়। ক্ষনিকের এই ভালোবাসা ধরে রাখতে চাইলেও পারা যায়। এমন অনেক সম্পর্ক আমাদের জীবনে কাকতালীয় হয়ে আছে। ভ্রমণ থেকে এটাই বেশি শিক্ষা পেয়েছি। আসলে ভ্রমণ মানেই ভালোবাসা। ভাবলাম এই সুন্দরবন থাকবে কিন্তু আমরা আর আসতে পারবো কিনা কে জানে? সুতরাং আলমাছ ভাইকে নিয়ে বন বিভাগের তৈরী করা কাঠের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলাম অনেক দূর। নির্জন এলাকা। মনে মনে ভয় বিরাজ করছিলো। এখানেই প্রথম হরিণের দেখা পেলাম। আরো কিছু ঘুরাঘুরি করে ফিরে এলাম লঞ্চে। দেরি না করে খাবার খেতে বসলাম। দুপুর গড়িয়েছে অনেক আগেই। পরিবেশের সঙ্গে মিল রেখে খাবারও ছিল চমৎকার। আলমাছ ভাই মাংস না খাওয়ায় আমি একটু বেশি খেলাম। আসলে এটা মুরগীর নয় পাখির মাংস ছিল। আমি বুঝতে পেরে আর বলিনি। একা একা সব গলারতল করলাম। তারপর আবার সেই জার্নি। আড়াই ঘন্টা মালঞ্চ নদীর উপর লঞ্চ ভ্রমণ শেষে আমরা এসে পৌঁছলাম যাত্রার স্থানে। অসাধারণ এক ভালোলাগার অভিজ্ঞতা ধারণ করে চিৎকার করে বলতে চাই, এদেশ আমার অহংকার।
পর্যটন সমৃদ্ধ সাতক্ষীরা জেলার জনপ্রিয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে ; মান্দারবাড়ি সমুদ্র সৈকত, দেবহাটা জমিদার বাড়ি, ইছামতী নদী, নীলকূটি, তেঁতুলিয়া জামে মসজিদ,বন বিবির বটগাছ, আকাশলীনা ইকো পার্ক, মোজাফফর গার্ডেন, আব্বাস গার্ডেন, জোড়া শিব মন্দীর ও বৌদ্ধ মঠ। এত্তো সব দেখার পরেও আবার এবং বারবার ফিরে যেতে চাই এই সাতক্ষীরায়।।