সিলেটে জ্বালানী তেলের সংকট: হার্ডলাইনে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৭:২৬:৪৭ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার: সিলেটের পেট্রোল পাম্পগুলোতে জ্বালানী তেলের সংকট কাটছেই না। বাধ্য হয়ে হার্ডলাইনে যাচ্ছেন পেট্রোল পাম্প ব্যবসায়ীরা। অনেকটা লাগাতার ধর্মঘটের পথে হাটঁছেন তারা। গেল বছর ২৭ ডিসেম্বর থেকে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসকের সাথে বৈঠক করে সংকট সমাধানের আশ^াসে সেই ধর্মঘট স্থগিত করা হয়। সোমবার সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আ.ন.ম বদরুদ্দোজার সাথে সাক্ষাৎ করে জ্বালানী তেলের সমস্যা ও সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন সিলেট বিভাগ পেট্রোল পাম্প অ্যান্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ। ২৮ ফেব্রুয়ারী রোববারের মধ্যে সংকট সমাধান না হলে সিলেট বিভাগের ১১৪ টি পেট্রোল পাম্পে একযুগে লাগাতার ধর্মঘটে যাওয়ারও হুশিয়ারী দেন তারা। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ব্যবসায়ীদের কথা শুনেন এবং এব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিলেট জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জ্বালানী মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) কে বিস্তারিত অবহিত করার আশ^াস প্রদান করেন।
এসময় উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলারস ডিস্ট্রিবিউটরস এজেন্ট অ্যান্ড পেট্রোলিয়াম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিলেটের সভাপতি মোস্তফা কামাল, অর্থ সম্পাদক সিরাজুল হুসেন আহমদ, সহ সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল ইসলাম, সদস্য শাহেদ মোশফিকুর রহমান চৌধুরী শাহেদ, এনামুল হক রুবেল, জুবের আহমদ চৌধুরী খোকন, রিয়াদ উদ্দিন, ইউনুস মিয়া, সানওয়ার আলী, আব্দুস কুদ্দুস তালুকদার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে তেলের মান ভালো নয় জানিয়ে সিলেটের গ্যাস ফিল্ডসমূহের খনি থেকে উত্তোলিত কনডেনসেট থেকে জ¦ালানি তেল উৎপাদন একেবারে বন্ধ করে দেয়া হয়। একসাথে সিলেটের গ্যাসফিল্ড থেকে উৎপাদিত পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিন ক্রয় বন্ধ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। এরপর থেকে চট্রগ্রাম থেকে রেলপথে ওয়াগনের মাধ্যমে সিলেট বিভাগের ১১৪ টি পাম্পে পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিন সরবরাহ শুরু হয়। কিন্তু রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় মাসে একাধিকবার বন্ধ হয়ে যায় সিলেট-চট্রগ্রাম রেলযোগাযোগ। ফলে সংকটে পড়েন সিলেটের পাম্প ব্যবসায়ীগণ। বর্তমানে রেলপথ স্বাভাবিক থাকলেও ওয়াগন কমিয়ে দেয়ায় তীব্র সংকটে পড়ছে সিলেটের পাম্পগুলো। কারণ সিলেটের গ্যাসফিল্ড থেকে জ্বালানী তেল সরবরাহ বন্ধ করার পর প্রথম পর্যায়ে সিলেট বিভাগে প্রতিদিনি ২৪টি ওয়াগন দিলেও পরে তা কমিয়ে ২০টি ওয়াগনে তেল সরবরাহ করা শুরু হয়। ফেঞ্চুগঞ্জের রেল দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রাম থেকে বর্তমানে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ পর্যন্ত রেলের ২০টি ওয়াগন আসছে। শায়েস্তাগঞ্জে আসার পর ১০টি করে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এতে পর্যাপ্ত পরিমাণ তেল সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এ কারণে তেল পরিবহণে বেশি সময় লাগছে। সিলেটের পাম্পগুলোর রিজার্ভ ফুরিয়ে যাচ্ছে। ২৮ ফেব্রুয়ারীর মধ্যে এর সুষ্ঠু সমাধান না হলে পাম্প বন্ধ করা ছাড়া সিলেটের জ¦ালানী তেল ব্যবসায়ীদের বিকল্প পথ খোলা নেই।
সূত্রে জানা যায়, সিলেটের সম্ভাবনাময় জ¦ালানী তেলের খাতকে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিতে একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে সিলেটের গ্যাসফিল্ড সমূহ থেকে তেল সরবরাহ বন্ধ করিয়েছে। আর সিলেটের পাম্প ব্যবসায়ীদের সংকেটর দিকে ঠেলে দিয়েছে। কারণ সিলেট গ্যাস ফিল্ড থেকে গ্যাসের সাথে উত্তোলিত কনডেনসেট বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ক্রয় না করায় এসব বিক্রি করা হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আবার নিজস্ব প্ল্যান্টে এই কনডেনসেট পরিশোধন করে জ¦ালানী তেল (পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন) বিক্রি করছে বিপিসি’র কাছে। আর বিপিসি পুনরায় এই তেল পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা’র মাধ্যমে ওয়াগনে করে সিলেট সহ সারাদেশে সরবরাহ করছে। অথচ সিলেটের গ্যাসফিল্ড থেকে উত্তোলিত কনডেনসেট সরকারীভাবে রিফাইনিং করতে পারলে সরকার যেমন কোটি কোটি টাকা রাজস্ব লাভ করতো, সিলেটের ব্যবসায়ীরাও জ¦ালানী তেল সংকট বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পেতো।
জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন গ্যাস ফিল্ড থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার ব্যারেল (১৫ লক্ষ ৯০ হাজার লিটার) কনডেনসেট উত্তোলিত হয়। এর মধ্যে শুধু সিলেট বিভাগের গ্যাস ফিল্ড গুলোতে থেকে উত্তোলিত হতো প্রায় সাড়ে ৯ হাজার ব্যারেল এবং বাকি ৫শ’ ব্যারেল উৎপাদিত হয় দেশের অন্য গ্যাস ক্ষেত্র গুলোতে। সিলেট গ্যাস ফিল্ডের আওতাধীন বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড থেকে ৭ হাজার ৭শ ৬১ ব্যারেল, সিলেটের জালালাবাদ গ্যাস ফিল্ড থেকে ১ হাজার ব্যারেল এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ডের আওতাধীন হরিপুর এবং কৈলাশটিলা গ্যাস ফিল্ড গোলাপগঞ্জ থেকে উৎপাদিত হয় ৭৩০ ব্যারেল কনডেনসেট। সিলেট গ্যাস ফিল্ডের আওতাধীন গোলাপগঞ্জের কৈলাশটিলা গ্যাস ফিল্ডে প্রতিদিন ৩শ’ ব্যারেল কনডেনসেট থেকে জ¦ালানি তেল উৎপাদন ক্ষমতার ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট আছে। এছাড়া রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডে ৩ হাজার ৮শ’ ব্যারেলের ফ্রাকশনেশন প্লান্টসহ প্রতিটি গ্যাস ফিন্ডে ছোট আকারের ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট রয়েছে।
অবশিষ্ট কনডেনসেট দেয়া হতো দেশের অন্যান্য স্থানের সরকারি ও বেসরকারি ফ্রাকশনেশন প্লান্টগুলোকে। ৬ মাসেরও অধিক সময় থেকে বিপিসি তেল না নেয়ায় সিলেটসহ দেশের ১২টি ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে এবং সব কনডেনসেট দেয়া হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে।
পেট্রোল পাম্প অ্যান্ড ওনার্স এসোসিয়েশন সিলেট বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সিলেটে প্রতিদিন ১০ লাখ লিটারেরও বেশি জ্বালানি তেলের চাহিদা থাকলেও প্রতিদিন সরবরাহ হচ্ছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ লিটার তেল। ফলে প্রতিদিনের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে রিজার্ভ থেকে। এখন রিজার্ভও শেষ হওয়ার পথে। কারণ সিলেটে পূর্বে সপ্তাহে ৩ রেক তেল আসলেও এখন আসে ১ রেক তেল। যা সিলেটের চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সিলেট নগরী ও সিলেট জেলায় প্রতিদিন সাড়ে ৫ লাখ লিটার জ¦ালানী তেলের চাহিদা থাকলেও পাম্পে বিতরণ করা হয় মাত্র ১লাখ লিটার তেল। এভাবে পেট্রোল পাম্প ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে জানান সিলেটের পাম্প মালিকগণ। আগামী রবিবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) মধ্যে সিলেটে তেল সংকটের সমাধান না হলে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর আগে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার্স, ডিস্ট্রিবিউটার্স এজেন্টস অ্যান্ড পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর ধর্মঘটের ডাক দিলেও জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ২৬ ডিসেম্বর ধর্মঘট স্থগিতের ঘোষণা দেন অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। কিন্তু জেলা প্রশাসন ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি।
এ ব্যাপারে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আ.ন.ম বদরুদ্দোজা দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, জেলা প্রশাসনের কাজের সীমাবদ্ধতা আছে। জ¦ালানী তেল সরবরাহের বিষয়টি জ¦ালানী মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এর এখতিয়ারভুক্ত। সোমবার সিলেট বিভাগ পেট্রোল পাম্প অ্যান্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ আমার সাথে দেখা করে সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। সংকট সমাধানে আমাদের চেষ্টার কথা জানিয়েছি। বিষয়টি সমাধানের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে জ¦ালানী মন্ত্রণালয় ও বিপিসি কে লিখিতভাবে জানানোর প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া রেলের বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে।