কোম্পানীগঞ্জে ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং, ৩ মাসে দুটি হত্যাকান্ড
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৭:৩০:০৫ অপরাহ্ন
আব্দুল জলিল, কোম্পানীগঞ্জ: উঠতি বয়সী কিশোরদের নিয়ে গঠন করা হয় ‘গ্যাং টিম সাদ্দাম’। যাদের বয়স ১০ থেকে ১৮ বছর তাদেরকে রাখা হতো দলের সদস্য হিসেবে। তাদেরকে দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঘর-বাড়ি, ক্রাশার মিলের অফিস ও রাস্তা-ঘাটে চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপকর্ম করানো হতো। বিভিন্ন সময় চুরি, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পরলেও কারো নাম বলত না এসব কিশোরেরা। ভুক্তভুগীরাও ছোট্ট ছেলে, না বুঝে এসব করছে ভেবে পুলিশে না দিয়ে ছেড়ে দিত। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গ্যাং লিডাররা চালিয়ে যাচ্ছিল তাদের ভয়ঙ্কর সব অপকর্ম। গ্যাং লিডারদের কাজে বাঁধা বা কোন সদস্যের সাথে বনিবনা না হলে হত্যা করার মত ঘটনাও ঘটে। আর এই সব কিছুই হতো কিশোর গ্যাংয়ের লিডার সাদ্দাম হোসেন এর নির্দেশে। মাঠ পর্যায়ে কাজের তদারকি করতো সাদ্দামের সহযোগী সুমন। তাদের কাছ থেকে চোরাই মোবাইল ক্রয় ও টাকা দিয়ে সহযোগিতা করতো আরেক সহযোগী মিজান। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার টুকেরগাঁও ও বউ বাজার এলাকায় গড়ে উঠেছে এমন একটি গ্যাং। সম্প্রতি এই টিমের সদস্য হৃদয় (১৫) কে হত্যার পর এমন লোমহর্ষক তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদীর নয়াগাঙ্গের পাড় থেকে ৩১ জানুয়ারী বিকালে একটি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করে কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশ। এসময় লাশের হাত পেছন দিকে বাঁধা ও গলায় ফাঁস দেওয়া দেখা যায়। প্রাথমিক সুরতহালে এমন আলামত দেখে এটি যে পরিকল্পিত হত্যা তা আর বুঝতে বাকি ছিল না পুলিশের। লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে বিভিন্ন এলাকার মসজিদে মাইকিং করান কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি কেএম নজরুল। মাইকে জানতে পেয়ে থানায় গিয়ে টুকেরগাঁও গ্রামের আউয়াল মিয়া লাশের শরীরের কাপড় ও শারীরিক গঠন দেখে শনাক্ত করেন এটি তার ষষ্ঠ ছেলে হৃদয়। শনাক্তের পর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। ঐ দিন রাত ১২টার পর হৃদয়ের বাবা বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে কোম্পানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, হৃদয় ২৭ জানুয়ারি সকাল ১১টা থেকে নিখোঁজ ছিল। মামলার তদন্তভার পান কোম্পানীগঞ্জ থানার এসআই হীরক সিংহ। মামলার তদন্তভার পেয়েই খুঁজতে শুরু করেন হত্যার কারণ। হৃদয়ের পরিবারের দেয়া তথ্য মতে তার বন্ধু রুহুল আমিন (১৩)কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে আসেন থানায়। রুহুল আমিনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মিলে কিশোর গ্যাংয়ের তথ্য। তার দেয়া তথ্য মতে এই গ্যাংয়ের সদস্য নয়ন (১২)কে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নয়ন বলে ২৭ জানুয়ারি তাদের আরেক সদস্য সফর (১৩) এর সঙ্গে ছিল হৃদয়। এরপর সফরের খোঁজে নামেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হীরক সিং। প্রযুক্তির সহায়তায় ও সোর্সের মাধ্যমে জানতে পারেন সফর ছাতকের দোলার বাজার অবস্থান করছে। সেখান থেকে তাকে নিয়ে আসা হয় কোম্পানীগঞ্জ থানায়। জিজ্ঞাসাবাদে সে বলে হৃদয়, সাদ্দাম ও সুমন মিলে রাত ১১ টায় নয়াগাঙ্গেরপাড় গ্রামে সুপারি চুরি করার জন্য যায় তারা।
এ সময় সফরকে গাছে উঠে সুপারি পাড়ার কথা বলে সাদ্দাম ও সুমন। সফর গাছে উঠতে পারে না জানালে সাদ্দাম ও সুমন তাকে তাড়িয়ে দেয়। এর আগে ঐদিন বিকালে সাদ্দামের নেতৃত্বে একটি মোবাইল চুরি করে হৃদয়, সফর ও সুমন। তাদের এই চোরাই মালামাল ক্রয় করে ঐ এলাকার মিজান। পরবর্তীতে মিজান ও সুমনকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও গা-ঢাকা দেয় তাদের গ্যাং লিডার সাদ্দাম হোসেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই হীরক সিং মিজানের মোবাইল সার্চ করে বুঝতে পারেন সাদ্দামের সাথে তার যোগাযোগ রয়েছে। মিজানকে কিছু বুঝতে না দিয়ে খুঁজতে থাকেন সাদ্দামকে। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় জানতে পারেন ৩১ তারিখ লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে রাতেই কোম্পানীগঞ্জ ত্যাগ করে সাদ্দাম। সে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বড়াইল মাঝহাটি গ্রামে অবস্থান করছে। নিজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি চালু রেখে স্ত্রী এবং বড়াইল এলাকার আরো একজনের সাথে কথা বলতেন সাদ্দাম।
সিলেটের পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিনের নির্দেশে ও কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি কে.এম নজরুল এর পরামর্শে ১৫ ফেব্রুয়ারী রাতে নবীনগরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই হীরক সিংহ। সেখানে সহায়তা নেন স্থানীয় থানা পুলিশের। বড়াইল গ্রামের যে নাম্বারে সাদ্দাম একাধিকবার কথা বলেছিলেন সেই নম্বরে ১৭ ফেব্রুয়ারী সকালে কল দেন তিনি। ফোনের ওপার থেকে জানায় এটি ঘোষাইপুর। পরবর্তীতে নাম্বার পরিবর্তন করে বিকেলে স্থানীয় নেতা সেজে আবারো কল দেন এসআই হীরক। কলটি রিসিভ করেন এক নারী। এসআই হীরক ওই নারীকে ইউনিয়ন অফিস থেকে একটি জরুরি কাগজ এসেছে বলে জানান এবং সেটি সংগ্রহ করার জন্য একটি মুদি দোকানের ঠিকানা দেন। এ সময় ওই নারী জানান, তার স্বামী কাগজটি সংগ্রহ করবেন। কিছুক্ষণ পর সেই দোকানের দিকে লুঙ্গী পরা একজন আসতে দেখে হীরক সিং দোকানিকে জিরজ্ঞস করেন কে এই লোক? দোকানি বলেন তার বাড়ি সিলেট। এরপর সাদ্দাম দোকানে আসামাত্র গ্রেপ্তার করেন তিনি। এসআই হীরক ঐ মুদি দোকানির কাছ থেকে জানতে পারেন বড়াইল এলাকায় সাদ্দামের শশুরবাড়ি। ওই নম্বরটি ছিলো তার স্ত্রীর। এরপর জিজ্ঞাসাবাদে হত্যা ও কিশোর গ্যাংয়ের লোমহর্ষক বর্ণনা দেয় সাদ্দাম।
সে পুলিশের কাছে বলে ২৭ জানুয়ারি তার নেতৃত্বে একটি মোবাইল ফোন চুরি করে হৃদয়, সফর ও সুমন। এরপর রাতে তারা নয়াগাঙ্গেরপাড় গ্রামে যায় সুপারি চুরি করার জন্য। এসময় সফর তাদের সাথে থেকে চলে আসে। রাত ১১টায় চুরি করা সুপারি এবং মোবাইল বিক্রির জন্য নয়াগাঙ্গেরপাড়ের মিজানের বাড়ির পাশে যায় তারা। মিজান তাদের কাছ থেকে সুপারি ও মোবাইল ফোনটি নিয়ে যায় টাকা আনার জন্য। কিন্তু টাকা না এনে খালি হাতে ফিরে মিজান জানায়, হৃদয় চোরাই মোবাইল বিক্রির কথা বলে আগেই তার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়েছে, কিন্তু মোবাইল দেয়নি। তাই সে আগের টাকার জন্য মোবাইল ও সুপারি রেখে দিয়েছে। মিজানের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা গোপন করায় হৃদয়ের উপর চরম ক্ষিপ্ত হয় সাদ্দাম ও সুমন। এ নিয়ে শুরু হয় তাদের মধ্যে মারামারি। এক পর্যায়ে সুপারি চুরির জন্য আনা রামদা দিয়ে হৃদয়ের মাথায় আঘাত করে মিজান। তার সাথে যোগ দেয় সাদ্দাম এবং সুমন। হত্যার পর হৃদয়ের পায়ের মোজা দিয়ে হাত পা বেঁধে ও সাদ্দামের পরনের চাদরের অংশ দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে নয়াগাঙ্গেরপার গ্রামের পাশের ধলাই নদীতে ফেলে দেওয়া হয় হৃদয়ের লাশ।
এ ঘটনার ৪ দিন পর ৩১ জানুয়ারি ধলাই নদীর তীরে ভেসে উঠে অর্ধগলিত হৃদয়ের মরদেহ। স্থানীয়রা দেখতে পেয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশকে খবর দেয়। সাদ্দাম হোসেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার টুকেরগাঁও ভাংতি গ্রামের মৃত হেফজু মিয়ার ছেলে। তার জবানবন্দি অনুযায়ী ১৮ ফেব্রুয়ারী সকালে হৃদয় হত্যায় জড়িত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নয়াগাঙ্গেরপাড় গ্রামের আব্দুস ছত্তারের ছেলে মিজান আহমদ ও একই উপজেলার টুকেরগাঁও গ্রামের শামসুল ইসলামের ছেলে সুমন মিয়াকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ছাড়াও আরো বেশ কয়েকজন সদস্য রয়েছে ‘গ্যাংটিম সাদ্দাম’র দলের। যারা চুরি, ছিনতাই, নেশাদ্রব্য ব্যবহার সহ সব ধরনের অপকর্মে লিপ্ত। গ্যাং টিম সাদ্দামের লিডার সাদ্দামের নামে ছাতক থানায় একটি হত্যা মামলা রয়েছে বলেও জানায় পুলিশ। হৃদয় হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের আরো টিমের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ।
১৮ ফেব্রুয়ারী সাদ্দাম ও তার দুই সহযোগীকে আদালতে হাজির করা হলে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে হত্যার কথা স্বীকার করে সাদ্দাম। জবানবন্দি গ্রহণ শেষে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এর আগেও গত বছরের ২ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় মোবাইল ও বিশ হাজার টাকার জন্য কোম্পানীগঞ্জের টুকেরগাঁও তৈমুর নগরে ছুরিকাঘাতে বিক্রয় প্রতিনিধি জাকারিয়া নামে এক যুবককে খুন করে আশিক মিয়া ও সাহাব উদ্দিন সিহাবসহ ৩জন। ক্লু-লেস এই ঘটনার ৫ দিনের মধ্যে পুলিশ তাদেরও গ্রেফতার করে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সংঘবদ্ধ কিশোর অপরাধী তথা কিশোর গ্যাং এর অপকর্মের সংবাদ ইতোপূর্বে দৈনিক জালালাবাদসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। উক্ত সংবাদ প্রকাশের পর স্থানীয় কিশোর অপরাধীদের পক্ষ নিয়ে স্থানীয় একটি মহল এলাকায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়। কোম্পানীগঞ্জে কিশোর অপরাধ নেই বলে ওরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক অপপ্রচার চালায় এবং সংশ্লিষ্ট সংবাদকর্মীদের নাজেহালের চেষ্টা করে।