পঞ্চাশের প্রিয় স্বদেশ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ মার্চ ২০২১, ৮:২৩:৪৩ অপরাহ্ন
সালেহ আহমদ খসরু
অথচ আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, ব্রিগেড কমান্ডার, সেক্টর কমান্ডার, মহান স্বাধীনতার ঘোষক থেকে শুরু করে প্রায় সকল বীরদের বিদেশি এজেন্ট আখ্যা দিয়ে তুলোধুনো করি, অপরদিকে বঙ্গবন্ধু যার ক্যারিশমাটিক রাজনৈতিক বক্তৃতা প্রাণে উদ্দামতা ছড়িয়েছে তাকেও নানান অনাহুত বিতর্কে জড়িয়ে ক্রমাগত ছোট করে দিচ্ছি নিজে নিজ ঘরেই!
স্বাধীনতা কি কেবল মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত জমিনে জন্ম নেয়া বিজয়ের একমুঠো লাল সুর্য! না-কি ১৯০৫ এর প্রথম কদম ফুল যা ঝরে পড়ে আবার ফুটে, আবার ঝরে গিয়ে অত:পর একাত্তর। আজও তা বিষন্ন পথিক হ্যাঁ, প্রথম বঙ্গভঙ্গ অতঃপর রদ আবার সাতচল্লিশ এইসবই প্রিয় স্বদেশের গোড়াপত্তন বলে মন সায় দেয় এবং তা দেশপ্রেমিক হৃদয়কে কেবলই ভাবায়-ভীষণ দোলা দিয়ে হাসায় কাঁদায়।
অত:পর একাত্তরের মুক্তির পথে বীর শ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর বিক্রম, বীর প্রতিক, বীরাঙ্গনা এবং হাজারো যুদ্ধাহত ও বেঁচে থাকা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান কি এমন স্বাধীনতা চেয়েছিলেন! তাই নিয়ে মন আজ পঞ্চাশের প্রহরে অশান্ত, দারুণ স্বেচ্ছাচারী হতে চায়!
প্রথমেই বুঝতে চেষ্টা করি স্বাধীনতা কি বা কেমন স্বাধীনতা পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন লক্ষকোটি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। এর উত্তরে অনেকেই বলে বসবেন উদাম হাওয়ায় মুক্ত মনে ভেসে বেড়ানো নয়তো পাখির কলরবে সবুজ-নীল বিলের ধারে ইচ্ছেমতো ঘুরে ফিরে বেড়ানো অথবা যা খুশি তার নাম স্বাধীনতা, না হয় যত্রতত্র যেমন খুশি তেমন সেজে নর্তনশালা বানিয়ে যা ইচ্ছে তা করার নামই স্বাধীনতা! কিন্তু মোটেই তা এমন নয়। হ্যা আমরা পাখির কলরব শুনতে চাই এবং তার জন্য হতে হবে পাখিদের অভয়ারণ্য, সবুজ-নীল বিলের ধারে হবো সমর্পিত কিন্তু তার জন্য চাই পরিবেশ বান্ধব প্রকৃতি, আর এসবই গড়ে উঠে স্বাধীনতার মুক্ত পরশে। এতো গেল সাদামাটা সরল সমীকরণ ব্যাখ্যা, কিন্তু এটিও স্বাধীনতার মূল সংজ্ঞা নয়।
মুলতঃ একটি জাতিসত্বার অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, নৈতিক, মৌলিক ভাষা প্রকাশ, গণতান্ত্রিক অধিকার, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা সর্বোপরি মানচিত্রের নিরাপত্তা তথা সার্বভৌমত্ব বিধানের অপর নাম স্বাধীনতা।
আমরা যদি ইংরেজদের দালিলিক প্রমাণ খুঁজে দেখি তবে সেখানে ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকে তাঁরা বলছে- সাতচল্লিশে ছিল transfer of power বা ক্ষমতার বদল, অপরদিকে ভারত এটিকে স্বাধীনতা বলছে আবার অন্যদিকে বেশকিছু ঐতিহাসিক এটিকে Partition of India যাকে দেশ বিভক্তি বলা হচ্ছে! (রেফারেন্সঃ ফিলিপ সেন্ট নিকোলাস মানসেরে, বৃটিশ সরকার কতৃক নিয়োজিত ইতিহাসবিদ)। যিনি দশ খন্ডে ভারতীয় ট্রান্সফার অব পাওয়ার নিয়ে রিপোর্ট করেছেন- যার প্রত্যেকটা এক হাজার পাতারও বেশী এবং সেইসব হাজার পাতায় সরদার বল্লব ভাই প্যাটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, নেহেরু, নেতাজী, সরদার বলদেব সিং, মাউন্ট ব্যাটেন, আগা খান, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, ওয়াভেল, গান্ধী-জিন্নাহসহ আরও আছেন, কারণ এদের বাদ দিয়ে কি পাক ভারত ইতিহাস লিখা যায়? যায়না, তাই নির্মোহ দৃষ্টিতে তাঁরা আছেন এবং transfer of power বা স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়ে মুসলিম হিন্দু শিখ সহ বিভিন্ন ধর্মবর্ণের প্রায় দশ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। যারমধ্যে মুসলমান প্রায় সত্তর শতাংশ এবং এক দেশ থেকে অপর দেশে অথবা বলা চলে স্থানান্তরিত হয়েছেন কমপক্ষে এক কোটি বিশ লক্ষ মানুষ।
প্রকৃতপক্ষে ইংরেজ বিরোধী আজাদী লড়াই শুরু হয় ১৮০৩ সালে। সাইয়িদ আহমদ শহীদের নেতৃত্বে ১৮৩২ সালে প্রত্যক্ষরুপ ধারণ করে। মুসলমানদের শৌর্যবীর্য অনেক গৌরব-গাথা, মাওলানা বলে যাদের আমরা কেউ কেউ তাচ্ছিল্য করি তাঁরাই মুলতঃ ইতিহাসের বরপুত্র। এসব নিয়ে আরেকদিন লিখার ইচ্ছে আছে। (রেফারেন্সঃ Catherine Admay, Professor University of Sheffield UK)
এমতাবস্থায় ভারতের কি ইংল্যান্ডের সরকারকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ নয় যে, তোমাদের প্রায় দশ হাজার পাতার দলিল দস্তাবেজ থেকে ভারতের স্বাধীনতার স্বীকৃতি মিলছেনা কেন! তবে কি এটি ইংরেজ জাতি আজও মানতে নারাজ। যদি তা-ই হয় তাহলে ভারতের উচিত হবে ইংল্যান্ডের স্বীকৃতি পুনর্বিবেচনা করা! এখন সেটি ভারত করবে কি-না তা সময় বলে দিবে অথবা নিতান্তই তা ভারতীয় নাগরিকদের চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ হবে। তা নিয়ে আমার ভাবনা আছে বটে, মাথাব্যথা নেই।
কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে আমার মাথাও আছে ব্যাথাও থাকবে এবং সেই চিত্রটি আঁকতে গেলে ১৯০৫ যদি বীজ রোপন হয়ে থাকে তবে চারাগাছ ধরতে হবে সাতচল্লিশের দেশ বিভক্তি, কারণ এটি না হলে বায়ান্ন হতোনা, ছাপ্পান্ন বাষট্টি উনসত্তরতো নয়ই-একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধও নয়। এখন কেউ এতে আবার বেঁকে বসে চেতনা বাণিজ্যের পসরা সাজিয়ে বসবেন না যে, গেল গেল সব গেল একাত্তরের আগে কেন সাতচল্লিশ এলো! এখানেই সমস্যা একদল লোক মনে করে একটি জাতিগোষ্ঠীর মুক্তি একলহমায় হয়ে গেছে বা এমনি একমাত্র সঞ্জিবনী সুধা যা পান করে একেকজন তিন চাহিদার দৈত্য হয়ে পড়েছিল, জাতি যাতে করে কেবল চাওয়া মাত্র দৈত্য সব হাজির করে দিয়ে লাল-হলুদ-সবুজের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিয়ে গেছে। স্মরণ করা উচিৎ প্রথম বিজয় পতাকা তিন রঙে রঙিন ছিল।
এই তিন রঙে যে কতো লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম রাঙিয়ে আছে তা এ দেশের সাদামাটা মানুষ জানে বোঝে, আর মনে লালন করে বলেই এখনো আশায় বাসা বেঁধে আছে দেশপ্রেমিক জনতা এবং একটি হুইসেলের অপেক্ষায়- একটি বাঁশীর সুর যেন কাঁপিয়ে দিবে অবিচারের অট্টালিকা, ধ্বসে পড়বে সব অন্যায় ও আহাজারির প্রাসাদ। সেই আগামী প্রত্যাশিত গল্পের পাত্রপাত্রী নায়ক ভিলেন ইতিহাসের বিচারে কে কোথায় যাবেন সেই কথা আগামী ইতিহাস তার সব সত্যাসত্য বলবে। এবং এটিও জানান দেবে আজটাই সত্য নয়, গতকালও সব সত্যের মুর্ত প্রতিক ছিলো না। তাই সেদিকে না গিয়ে বরং এই অবধি কি পেলাম, আর কোথায় এবং কেন আজ হারানোর সুর বেজে ওঠে সেদিকে একটু দৃষ্টি ফেরাই।
সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং তার আগে সত্তরের নির্বাচন আবার কালো রাতের গণহত্যার আগে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের আসা-যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বৈঠকের পর বৈঠক, ভুট্টো সাহেবের ফিরে যাওয়া আর ইয়াহিয়া খানের সাথে সমঝোতা না হওয়া এ সবইতো transfer of power বা ক্ষমতা বদলের জলজ্যান্ত সত্য কাহন বা এখনো অনেকের স্মৃতি রোমন্থনে কলমের কালির চিহ্ন দেখে পড়ে মানুষের মনকে দোলায় ভাবায় এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য করে যে, সেই দিন পঁচিশ তারিখ অবধি কেউ ভাবেনি কি হতে পারে বা ঘটতে যাচ্ছে! তাই যত কথাই বলি না কেন একলহমায় কেউ কবিতা পড়ে বা ঘোষণা দিতেই তিন চাহিদার দৈত্য এসে প্রিয় স্বদেশ দিয়ে যায়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বায়ান্ন যেমন অবিচ্ছেদ্য অংশ তেমনি সাতই মার্চ, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র, আম্রকাননে প্রবাসী সরকার গঠন, তেলিয়াপাড়ায় সেক্টর গঠন, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ব্রিগেড-দ্বিতীয় ব্রিগেড এবং ব্রিগেড কমান্ডার, মুজিবনগর সরকার, ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ- আনসার, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক সর্বোপরি সাদাসিধা জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতার অংশগ্রহণের সব চিরসত্য বাদ দিয়ে এ ইতিহাস অসম্পূর্ণ, অযৌক্তিক ও মিথ্যা বলে পরিত্যক্ত হতে বাধ্য। বহু গুণীজন এসব নিয়ে হাপিত্যেশ করছেন, লিখছেন বা বলতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সেখানেই বলতে হয় স্বাধীনতা অসমাপ্ত, ভিষম যন্ত্রণা দেশকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
কারণ আজকের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে হতে পারতো মওলানা ভাসানীর বেতের টুপি মাথায় ওয়ালাইকুম সালাম এর গল্প জানানো, হওয়া উচিত সাতই মার্চের ভাষণের উচ্চকিত শব্দ শুনে প্রাণ জুড়ানো হাসির ফোয়ারা আলোকিত করা, জরুরী ছিল আজকের দিনে মহান স্বাধীনতার ঘোষণার সেই অমোঘ বিধানের বাণী ছড়িয়ে দেয়া, সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের বীরত্ব গাঁথা যুদ্ধ যা জেনারেল মন্টিগোমারি ও জেনারেল রুমেল’র যুদ্ধের সাথে তুলনা করা হয় (রেফারেন্স : O General my General) সেই বীরত্বের কথা বলা।
মেজর জিয়াউর রহমানের কালুরঘাট যুদ্ধের কথা শুনেনি বাংলাদেশের এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর, বীর শ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের ধলই সীমান্তে অসীম সাহসিকতা, মেজর মঈনুল ও মেজর হাফিজের নেতৃত্বে কামালপুরের যুদ্ধের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হতে শিক্ষা নিয়ে আবার ঝাপিয়ে পড়া, একই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনসহ বহুবীরের শাহাদাত বরণ করা এবং পাগলপারা এগারো সেক্টর কমান্ডারদের অবিচল অকুতোভয় পথচলা, অত:পর পুনরায় সবুজের বুকে রক্তিম সুর্যের উদয় সেইসব আরও শত ইতিহাস, বীরত্বের চকমকে শৌর্যবীর্য এবং সেই বীরদের বীরত্বের চাইতে আর কি বড় হতে পারে! অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীর নয়মাসের রণকৌশলের পরম স্বীকৃতি দিয়ে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলকে এক সুতোয় বাঁধা! কিন্তু তার একটিও না করে কে কাকে কতটা ছোট আর তাচ্ছিল্যের শিকার করা যায়। তাই নিয়ে ব্যস্ত প্রায় সকলে, প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত। ত্রিশ লক্ষ মানুষ আর মহাবীর হতে বীর শ্রেষ্ঠ-বীর উত্তম-বীর বিক্রম-বীর প্রতিক যে-ই হোন তারা যেন কিছুই করেন নি! এ দেশ কি এমন রক্তের ফোঁটার সাথে প্রতারণা করে তৈরি হবার কথা ছিল!!! এ কথা আসছে এজন্য যে, সীমান্ত হতে শেরে বাংলা নগরের আইন প্রণয়ন কেন্দ্র অথবা রাজারবাগ হতে রাজদরবার, নয়তো মানচিত্র হতে দরবার হল কোনকিছু আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা বিশ্বাসে নয় বরং দৃষ্টিকটু বাণিজ্যে আর অনাহুত স্তবগানে রুপান্তরিত হয়ে গিয়েছে সবখানে সব দলে।
মাঝেমধ্যে প্রাণ কাঁদে এই ভেবে, তবে কি সবুজ গালিচা আজ কোন কুঠি বাড়ি! না-কি লখণৌর মহলের ঝংকৃত নৃত্য পটিয়সির ঘুঙুরের আর্তনাদ! নাহলে আমার কথা বলিবার তরে ওহে মম-প্রাণ তুমি কেন শঙ্কিত! এইযে কলম ধরেছি, কোথায় তার ফলগুধারার স্রোত ভাসাবে হৃদয়! কিন্তু তা নয় বরং সেখানে কেবল চেপে ধরা- কি যেন কি হয় কে জানে কে শুনে, পাছে জিজ্ঞেস করে বসে – তুমি কে? তখন বলতে ইচ্ছে হয়- আমি সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর, আমাকে আজও চেননি তাই একাত্তরের পর ভাসানীকে করতে হয়েছে লংমার্চ, বঙ্গবন্ধুকে বলতে হয়েছে সাড়ে সাত কোটি কম্বলের আমারটি কই অথবা রণাঙ্গনের ময়দানে ব্রিগেড কমান্ডার জেড ফোর্স অধিনায়ক জিয়াউর রহমানকে বলতে হয়েছে- পাকিস্তানী তাড়ালাম প্রায়, এখন না ভারতীয়দের তাড়াতে হয়! (রণাঙ্গনের দিনগুলি)
একেবারে যৌক্তিক কারণেই মুজিব শতবর্ষ পালন হচ্ছে ঘটা করে- মহান স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে। এটি হতে পারতো চুল চেরা বিশ্লেষণের অবারিত মঞ্চ, যা থেকে অনায়াসে নতুন প্রজন্ম জানতে পেত কেমন করে মানুষ ওপার বাংলায় ঠাঁই নিতে ছুটে গেল, আবার একদল বিশাল জনগোষ্ঠী এপারেই রয়ে গেল বনজঙ্গল সহ একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং সেখান হতেই যুদ্ধের ময়দানে নিজেদের নিয়োজিত করলো, এমন আরও বহু টকঝাল মিষ্টি এবং তাই হতে পারতো এক অনাবিল তৃপ্তি! থাক যা হয়নি তা নিয়ে বিতর্ক করা অশোভন হয়ে যেতে পারে। কেবল মনে পড়ে গেল অক্টোবর বিপ্লবের শতবার্ষিকী পালনে এ দেশের কমিউনিষ্ট পার্টির সিদ্ধান্ত, যেখানে অক্টোবর বিপ্লবের প্রশংসা করতে বলা হয়েছিল, কিন্তু দোষ বলা যাবে না (ঊদ্ধৃতি-সাংবাদিক নুরুল কবির)।
সুবর্ণ জয়ন্তী পালনে কত কথা মনে হয় তাই লেখা দীর্ঘ হচ্ছে, তবুও সব আপাতঃ অসমাপ্ত থেকে যাক অসমাপ্ত স্বাধীনতার মতো, কারণ যে সাধারণ মানুষ আজ ৬০ টাকায় চাল কিনতে গলদঘর্ম হচ্ছেন, একশো চল্লিশ টাকায় ভোজ্য তেল ক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছেন, পেঁয়াজ এই দুইশো তো আবার চল্লিশ অথবা আলু হয়ে উঠে পঞ্চাশের উপর সেই জাতি কান্নাকাটি করে কারে শোনাবে তার জীর্ণ গাত্র আর শীর্ণ কন্ঠের ফিসফিসানি! কেউ নেই, এটিই আজ স্পষ্ট তাই সব চুপ একেবারেই শান্ত, অথচ ক্লান্ত দেহ ক্ষুব্ধ মন।
সীমান্ত হাট বাজার থেকে মানচিত্রের সীমারেখায় মানুষ হত্যা যেন এক নিয়মিত বিষয় হয়েছে, মনে হয় এই ছিল মোর ভালে! অথচ একাত্তরের নয়মাসে পরাক্রমশালী পাকিস্তান আর্মির নুইয়ে পড়া জানান দেয় কতটা দুর্দান্ত ছিল আমাদের ইস্ট বেঙ্গল ইপিআর আর দামাল ছেলেগুলো। অবাক হই পঞ্চাশের প্রহরে এই আমরাই তাদের উত্তরাধিকার!
সঙ্গতিপূর্ণ হবে হয়তো যদি যুক্তরাজ্যে সামরিক প্রশিক্ষণের সময় মেজর হাফিজ উদ্দিন বীর বিক্রম এর স্মৃতি তর্পণ করি এইমুহূর্তে- ‘ঐতিহ্য অনুযায়ী টেবিলের এক প্রান্তে সিনিয়র মোষ্ট, অর্থাৎ কমান্ডিং অফিসার বসেন। অপর প্রান্তে তাঁর উল্টোদিকে বসে জুনিয়র মোষ্ট লেফটেন্যান্ট, যাঁকে বলা হয় মিষ্টার ভাইস। — আমি লক্ষ করলাম, মিস্টার ভাইসের জন্যে নির্দিষ্ট চেয়ারটি খালি। সিওকে জিজ্ঞেস করলাম, কর্নেল, মিষ্টার ভাইসকে দেখছি না কেন? উত্তরে উল্লেখ করলেন ‘আজ থেকে ১৫০ বছর আগে ১ম কুইন্স একটি যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, যুদ্ধে সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জনসন এই পল্টনে যোগ দেন। যোগদানের কয়েক ঘন্টা পরই তাঁকে ছয়জন সৈনিকসহ র্যাকি পেট্রলে পাঠানো হয়—-জনসনের দায়িত্ব ছিল শত্রুর অবস্থান জানা, তাকে আক্রমণ করা নয়। কিন্তু দুঃসাহসী তরুণ জনসন একটি সুবিধামতো স্থানে তিনি শত্রু বাহিনীকে অ্যামবুশ করার সিদ্ধান্ত নেন। শত্রু বাহিনীকে অতর্কিত অ্যামবুশ করে প্রায় ৫০ জনকে হত্যা করেন। শত্রুসেনারাও পাল্টা আক্রমণ তীব্র করে জনসনের পার্টিকে ঘেরাও করে এবং এই অসম যুদ্ধে জনসন ও তাঁর সঙ্গীরা নিহত হন। তাই সেদিনের সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত সেকেন্ড লে. জনসনের বীরত্বগাথার প্রতি সন্মান প্রদর্শন করে ১ম কুইন্স ব্যাটেলিয়নের ডাইনিংরুমে তাঁর জন্যে নির্ধারিত মিস্টার ভাইসের চেয়ারটি ১৫০ বছর ধরে অব্যবহৃত রেখে আসছে।”(রেফারেন্স ঃ সৈনিক জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর)
এটি আজও অব্যাহত বৃটেনে কারণ গুণের কদর করতে জানে বলেই, এখনো বিশ্ব মানচিত্র দখলে না রেখেও বিশ্ব দরবার তাঁকে ছাড়া অচল।
অথচ আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, ব্রিগেড কমান্ডার, সেক্টর কমান্ডার, মহান স্বাধীনতার ঘোষক থেকে শুরু করে প্রায় সকল বীরদের বিদেশি এজেন্ট আখ্যা দিয়ে তুলোধুনো করি, অপরদিকে বঙ্গবন্ধু যার ক্যারিশমাটিক রাজনৈতিক বক্তৃতা প্রাণে উদ্দামতা ছড়িয়েছে তাকেও নানান অনাহুত বিতর্কে জড়িয়ে ক্রমাগত ছোট করে দিচ্ছি নিজে নিজ ঘরেই!
অথচ এই প্রহরে এই সবকিছু হতে পারতো সুখ স্মৃতি আর নতুন করে উজ্জীবিত হবার প্রাণ সুধা।
মন জানান দিচ্ছে কি বিভ্রম আর বিভ্রান্তির শিকার হয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন দেশে সিরাজ সিকদার, একই ধারায় নুর হোসেন, ডা. মিলন, দিপালী সাহা, জেহাদ, জনি, সাতান্ন সেনা কর্মকর্তা শহিদ হয়েছেন। সেই একই পথে আজকের কার্টুনিস্ট মুশতাক এবং আগত সময়ে যদি আরও শত প্রাণ ঝরে পড়ার শঙ্কা থাকে তবে কি এই স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করেছেন আমাদের লক্ষ প্রাণ! তাহলে কি সুবর্ণ জয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণ আজও অসমাপ্ত রয়ে গেল! এমন অনেক প্রশ্ন মনকে বিচলিত করে তুলছে অবিরত। তাই কলম চলছেই, কিন্তু পত্রিকার পাতায় সব কথার স্থান হবেনা পরিধির কারণে এবং হয়তো বলাও যায়না বহু কথা।
যারা শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ তারা এই সুবর্ণ জয়ন্তী লগ্নে কোনভাবেই বলতে চাইনা রফিক আজাদের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘ভাত দে——নইলে মানচিত্র খাবো’ এবং আমিতো এই কথা বলতেই পারি না। কারণ মানচিত্র খেতে যারা মরিয়া তাদের উদর যাতে অশান্তি ও ঢেকুরের আর্তনাদ হয় তার জন্য সব বিলিয়ে দিতে আজও প্রস্তুত অজানা সব দেশপ্রেমিক আমজনতা, যারা প্রাণ বাজি রেখে একাত্তরে ইস্ট বেঙ্গলের সাথে জোরকদম ফেলে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল যে সাহসী সূর্যসন্তান। এরা তারই উত্তরাধিকার এই জাতি, হয়তো চিনতে পারছি না তাঁরা কে কোথায়! হয়তো সব অনাচার আত্মম্ভরিতা অবিচার রোধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে। পঞ্চাশের প্রিয় স্বদেশ যাতে বৃদ্ধ না হয়ে যায় সেই পথে সকল তরুণ প্রাণ এক হোক, তাঁদের প্রজ্জ্বলিত মশাল জ্বালিয়ে আলোকিত হোক অমানিশার ঘোর অন্ধকার।
“উষার দুয়ারে হানি আঘাত আমরা আনিব রাঙা প্রভাত” বিদ্রোহী কবির সেই স্বপ্ন যেন রাঙিয়ে দেয় আগামী বাংলাদেশ, আমি আমরা যেন দেখে যেতে পারি। লিখে যেতে চাই অসমাপ্ত স্বাধীনতার সমাপ্তি যাত্রা, আর গেয়ে যেতে চাই নতুন প্রভাতের রাগ ভৈরবী।
লেখক: কলামিস্ট