অসহায় রোগী ও ঠিকানাহীন মানুষদের বন্ধু মঞ্জু
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ এপ্রিল ২০২১, ৭:৫৪:৫৬ অপরাহ্ন
রাত, ১১টা ৩৫। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ঝরছে শহরজুড়ে। ব্যক্তিগত কাজ সেরে কদমতলী থেকে বাসায় ফিরছি। সঙ্গে থাকা মাসুমকে বললেন মোবাইলের ফ্লাশ লাইট জ্বালাও। কে যেন রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে। লাইট জ্বালাতেই কিছু দূরে দেখি এক বৃদ্ধা অস্পষ্ট আবছা আঁধারের ফুটপাতে পড়ে আছেন। সত্তরোর্ধ্ব ওই নারীর শীর্ণ খর্ব দেহ। কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম কিছু খাবেন? প্রতিউত্তরে দুই ঠোঁট নাড়িয়ে শুধু বললেন খাব।
বৃদ্ধার জন্য কদমতলী মোড় থেকে অল্প খাবার নিয়ে দ্রæত ফিরে এলাম। যেভাবে দেখে গেছি সেভাবেই শুয়ে আছেন, একটি পুরনো শাড়ি আর পলিথিন মুড়িয়ে। উঠে বসার শক্তিটুকু নেই। তাই নিজ হাতেই তুলে বসালাম। নাড়াচাড়া করতেই বেরিয়ে এলো ভয়াবহ দুর্গন্ধ। প্রস্রাব-পায়খানায় লেপ্টে আছে পুরো গা। হাতে খাবারটা দিয়ে খেতে বললাম। কিন্তু কোনো রকমে মুখে দিতে পারলেও গিলতে পারছেন না। জিজ্ঞেস করলাম কী সমস্যা? তিনি কিছুই বলতে পারছিলেন না। মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে দেখলাম পেট ফাঁপা। যেন বাতাসে ভর্তি। অবস্থা দেখে বুঝতে আর বাকি রইলা না মৃত্যু যন্ত্রণায় ভুগছেন বৃদ্ধা। দেরি না করে পরিচিত এক বড় ভাইকে ফোন করে কিছু পুরনো কাপড় নিয়ে আসতে বলি। মেজবা ভাইয়ের বাসা কাছেই, মাদারবাড়ী। খুব দ্রæতই তিনি কিছু কাপড় নিয়ে এলেন। কোনোরকম বৃদ্ধার গায়ে সেগুলো জড়িয়ে নিয়ে উঠলাম সিএনজিতে। গন্তব্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল। তখন দুর্গন্ধ আরও তীব্র হয়। পায়খানা আমার গায়েও লেগে আছে। সঙ্গে থাকা মাসুম ভাই ও মেজবা ভাই আসছেন মোটরবাইকে। রাত তখন সাড়ে ১২টা। বৃদ্ধাকে মেডিকেলে ভর্তি করানো হয়। সকালে শুরু হবে চিকিৎসা। কিন্তু তার জন্য তো কিছু টাকা দরকার। তাই বড় দুই ভাই চলে গেলেন অর্থের সন্ধানে।
সারারাত আমি বসেছিলাম বৃদ্ধার পাশে। আমার শরীর থেকেও এবার দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে অবশ্য তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না। বিষয়টি টের পাই পাশের একজন বলায়। বৃদ্ধার চিকিৎসা শুরু হল সকাল ৮টায়। পেট ফেঁপে থাকায় নিঃশ্বাস নিতে পারছিলেন না। অবস্থা ভালো না ঠেকায় অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। আনুষঙ্গিক অন্যান্য চিকিৎসাও চলছে এর মধ্যে। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে সবই ব্যর্থ, চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকাল ১০টা ১০ মিনিটে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তার এই মৃত্যুটা আমার হৃদয় ভেঙেছিল। কেঁদেছিলাম ঢুকরে ঢুকরে।
চলার পথে জীবনের একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন সাঈদ ইসলাম মঞ্জু। যিনি মূলত বøাড ডোনেশনের কাজ করেন, ২০১৫ সাল থেকে। এর মধ্যে বছর তিনেক আগে মাসুম নামে এক ব্যক্তির ফেসবুক পোস্টে দেখতে পানÍ অজ্ঞাত রোগীকে রাতে দেখভালের জন্য একজন সহায়ক প্রয়োজন। আগ্রহ নিয়ে সেদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন মঞ্জু। ষাটোর্ধ্ব রোগীটি মানসিক ভারসাম্যহীন। কদমতলীর মোড় থেকে উদ্ধার করে চমেক হাসপাতলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নাম আনোয়ারা বেগম।
সারারাত ধরে ওই নারীর পাশে বসেছিলেন মঞ্জু। আর ভাবছিলেন রাস্তায় পড়ে থাকা এমন অজ্ঞাত ব্যক্তিদের অসহায়ত্বের কথা। বুঝতে শুরু করেন তাদের মনের বেদনা। বুকে পাথর চাপা দিয়েই তো পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয় এই মানুষগুলোকে। মূলত ওই রাত থেকেই তার অজ্ঞাত ব্যক্তিদের সেবা দেওয়ার পথচলা শুরু। মাত্র ৭ থেকে ১০ দিনের সেবাতেই বৃদ্ধা আনোয়ারাকে মোটামুটি সুস্থ করে তুলেছিলেন। তার কাছ থেকে নেওয়া কিছু তথ্যের ভিত্তিতেই বৃদ্ধাকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মঞ্জুরা।
মঞ্জু বলেন, ‘আমি এ পর্যন্ত ৪০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে চিকিৎসাসেবা দিয়েছি। এর মধ্যে আনুমানিক ২০ জনকে ঢাকার চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার নামের এক বৃদ্ধাশ্রমে হস্তান্তর করেছি। ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার সাড়া মানবিক বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছি পাঁচজনকে। চিকিৎসাকালে মৃত্যু হয়েছিল দুজনের। আর তাদের মৃত্যু ছিলো আমার জন্য খুবই কষ্টের।’
‘আমি মূলত অসুস্থ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে চিকিৎসাসেবা দেই। বিভিন্নজন এ জন্য আর্থিক সহায়তা করেন। অনেকে আবার সহায়তা করে নাম গোপন রাখতে বলেন, যার কারণে সেই টাকার হিসাব আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় দিতে পারি না। তবে আমি ডোনেশন নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে একদম আগ্রহী নই এবং সোশ্যাল মিডিয়াতেও এসব বিষয়ে আপডেট দেওয়া পক্ষে না। এসব কাজ মন থেকে করি’ বলছিলেন অসহায়ের এই বন্ধু।
বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মঞ্জু বলেন, ‘চমেক হাসপাতালে যে অজ্ঞাত ব্যক্তিগুলোর চিকিৎসাসেবা দিয়েছি সবার অভিভাবক হিসেবে আমার নাম ছিল। এই হাসপাতালে অন্য সিস্টেম আছে। অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করে। ঠিক তেমনি আমার সেবাকালে মারা যাওয়া দুজনকে ওই সংগঠনটিই দাফন করেছিল।’
অন্য এক ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘করানোয় লকডাউনের সময়ও আমি ২৩ দিন চমেক হাসপাতালে ছিলাম, পঞ্চাশোর্ধ্ব অজ্ঞাত জাকির হোসেনের সেবায়। তাকেও কিন্তু কদমতলী মোড় থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। তবে সাত-আট দিন চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পর তিনি হঠাৎ একদিন হাসপাতাল থেকে চলে যান। অনেকদিন তার কোনো সন্ধান মেলেনি। এদিকে অন্য এক ব্যক্তির চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সময় ডাক্তার রাকিব এসে আমাকে জানালেন, জাকিরকে কারা যেন আবার হাসপাতালে এনে রেখে গেছে। দ্বিতীয়বারের মতো লকডাউনের মধ্যেই তাকে সেবা দেই। অথচ করোনার ভয়ে তখন হাসপাতালের আশপাশেই কোনো মানুষ আসতো না। পরে তাকে একটু সুস্থ করে ঢাকার বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাই।’
বেশিরভাগ রোগী কদমতলীতে কেন উদ্ধার হয় জানতে চাইলে মঞ্জু বলেন, ‘এই এলাকাটা চট্টগ্রাম রেল স্টেশনের পার্শ্ববর্তী। ফলে হারিয়ে যাওয়া কিংবা বিভিন্ন স্থান থেকে আসা অজ্ঞাত ব্যক্তিরা এই এলাকার ফুটপাতে অবস্থান নেন।’
সাঈদ ইসলাম মঞ্জুর সহযোদ্ধা ছয়জন কাউছার আহমেদ, মেজবাহ উদ্দিন, জিহাদ হোসেন, আজাদ, মেহেদি হাসান ও সাজ্জাদ হোসেন। হাসপাতালেও যাদের ঠাঁই হয় না, সেই সব রোগীদের জন্য তারা ব্যবস্থা করেন চিকিৎসা, খাবার আর পোশাকের। সহযোদ্ধাদের নিয়ে মঞ্জু বললেন, ‘এ ব্যাপারে অনেকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। অনেকে মাঝে মধ্যে সাহায্য-সহযোগিতার জন্য।