পাথরে পড়লে পাকা বীজও নষ্ট হয়ে যায়
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ এপ্রিল ২০২১, ৮:৫৬:২১ অপরাহ্ন
খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘পাথরের উপর পড়লে পাকা বীজও নষ্ট হয়ে যায়, অর্থাৎ বাস্তবায়ন না হলে বা বাস্তবায়নের পরিবেশ না থাকলে অনেক ভালো পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য।
গতকাল দৈনিক জালালাবাদে ‘ভাড়া বাড়লেও উপেক্ষিত নির্দেশনা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, করোনা থেকে সুরক্ষার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়। এই নির্দেশনায় গণপরিবহন চলাচল ও যাত্রী ধারন সীমিত করাকে গুরুত্ব দিয়ে ৬০ ভাগ ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু ভাড়া কার্যকর হলেও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। বাস ও রেলকর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত মানলেও লেগুনা ও সিএনজি অটোরিকশা চালকেরা উক্ত সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করছে। কিছু কিছু চালক অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করলেও স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে নিয়মের অতিরিক্ত যাত্রী বহন করছে। এ নিয়ে চালকের সাথে যাত্রীদের বাকবিত-া হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬০ ভাগ ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে কোনভাবেই মানতে চাইছেন না যাত্রী সাধারণ। তাদের মতে, সবকিছু খোলা রেখে শুধুমাত্র গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধি করে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এতে করোনার থাবা থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করাও সম্ভব নয়। তাদের মতে, এতে শুধু যাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়ছে। অনেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পরিবহনে চলতে গিয়ে পড়ছেন বেকায়দায়।
বলা বাহুল্য, ইদানিং দেশের অন্যান্য স্থানের মতো সিলেট অঞ্চলেও করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে বহু লোক আক্রান্ত হয়েছেন। বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে করোনাভাইরাসে। এ অবস্থায় সরকার স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলার নির্দেশনা জারি করেছেন। অন্যান্য স্থানের মতো গণপরিবহনেও কিছু নির্দেশনা জারি করা হয়েছে এ ব্যাপারে। শুরুতেই এ ব্যাপারে বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনার অপব্যবহার কিংবা এর প্রতি উপেক্ষা ও উদাসীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বলা বাহুল্য, এদেশে আইনের অভাব নেই। নেই নিয়ম-কানুন ও দিকনির্দেশনার অভাব। কিন্তু অভাব যে জিনিসটির সেটা হচ্ছে বাস্তবায়নের। ফলে পাকা বীজরূপী এসব আইন কানুন ও নিয়ম-নির্দেশনা থেকে গাছ হচ্ছে না, ধরছে না কোন ফলমূল। অর্থাৎ বাস্তবায়নের অভাবে এগুলো অকার্যকর ও অর্থহীন বিষয় হয়ে আছে। এর একটি উদাহরণ দেয়া যায়, দেশে প্রকাশ্যে ধূমপান বিরোধী একটি আইন রয়েছে। এটা লংঘন করলে রয়েছে শাস্তির বিধান। কিন্তু বাস্তবে এই আইন এখন মৃত আইনে পরিণত হয়েছে। এর কারণ এটা বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ নেই। এটা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যর্থতা। ব্যর্থতা এটা মনিটরিংয়ের, দায়িত্বপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন প্রশাসন এবং কিছুটা হলেও বিচার বিভাগে। বিচার বিভাগ অনেক সময় অনেক বিষয়ে ‘সোয়ামোটো’ অর্থাৎ স্বপ্রণোদিত হয়ে রুলিং দেন, আদেশ জারি করেন। এক্ষেত্রেও উচ্চ আদালত রুলিং বা আদেশ জারি করতে পারতেন। কিন্তু করছেন না। আর মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের তো ধূমপানের মতো সাধারণ বিষয়ে নজর দেয়ার সময়ই নেই। অথচ এই ভয়ংকর অনুশীলন ও বদঅভ্যাস প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। আক্রান্ত করছে আরো কয়েক লাখ মানুষকে।
আইন বাস্তবায়নে অবহেলা ও উপেক্ষার এটা একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। করোনাকালীন সময়ে কিংবা বর্তমানে করোনার দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ বৃদ্ধির মুহূর্তে লোকজনের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে অনীহা পুরোমাত্রায় লক্ষা করা যাচ্ছে। মাস্ক পরিধান কিংবা সামাজিক বা ব্যক্তিগত দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনার প্রতি যেনো কারো কোন তোয়াক্কা বা আগ্রহ নেই। সত্যি বলতে কি, এদেশে আইন থাকা সত্ত্বেও বাস্তবায়ন না করার যে সংস্কৃতি গড়ে ওঠেছে, এরই ভয়াবহ পরিণতি এটা। এদেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতির কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয়। এর সাথে এখন আইন বাস্তবায়ন না করার সংস্কৃতির কথাটিও বলা উচিত। বিচারহীনতার সংস্কৃতি মূলত: আইন বাস্তবায়ন না করার বা না মানার সংস্কৃতিরই অংশ।
শুরুতে আমরা কিছু যানবাহনের চালকদের সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের ক্ষেত্রে উদাসীনতা ও উপেক্ষার বিষয়ে আলোকপাত করেছি। ভাড়া বাড়ালেও স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না অনেক চালক। এভাবে চললে সরকারের এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও জনহিতকর পদক্ষেপ অকার্যকর হতে বাধ্য।
বলা হয়েছে এ ব্যাপারে কঠোর নজরদারি করা হবে, পরিচালনা করা হবে ভ্রাম্যমাণ আদালত। আমরা চাই এই গুরুত্বপূর্ণ বিধিমালা ও নির্দেশনা যেনো সুষ্ঠু ও যথাযথভাবে অনুসরন ও পালন করা হয়। দেশ ও জনগণের স্বার্থেই এটা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের মনিটরিংয়ের পাশাপাশি সকল স্তরের মানুষের নির্দেশনা পালন ও সচেতনতা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।