শিক্ষার করুণ অবস্থা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ এপ্রিল ২০২১, ৭:০৭:৪৫ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ শামছ উদ্দিন
পৃথিবীর সবচেয়ে আক্রান্ত দেশ সমূহের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সহ অন্যান্য দেশেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাঝে মাঝে খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই বিপরীত ও প্রশ্নবিদ্ধ।
সামাজিক ও মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠছে। যে পরিমাণ আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে তার ভিত্তি কোথায়।
ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আজ দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। অধিকাংশ প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। হাতেগোনা যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান টিকে আছে নিজ যোগ্যতাবলে তাদের অবস্থা ও নিভু নিভু।
…………………..
বাংলাদেশের সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। বিগত এক বছরে দেশের সবকিছুই কার্যত: খোলাই ছিল। ওয়াজ মাহফিল, মেলা, লাখো দর্শক ভর্তি মাঠ ও স্টেডিয়াম, শিশুপার্ক, উদ্যান, শপিংমল, মিটিং, মিছিল, মাদরাসা (কওমী), সিনেমা হল-বলা যায় সবকিছুই। অপরাধী শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। প্রায় এক বছর থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। আমরা উপহার দিতে যাচ্ছি এক মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ পরবর্তী জেনারেশন। পৃথিবীর সবচেয়ে আক্রান্ত দেশ সমূহের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সহ অন্যান্য দেশেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাঝে মাঝে খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই বিপরীত ও প্রশ্নবিদ্ধ।
সামাজিক ও মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠছে। যে পরিমাণ আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে তার ভিত্তি কোথায়। দীর্ঘদিন কওমি মাদরাসাগুলো খোলা ছিল। কই, সেখানকার স্ট্যাটিসটিকতো অন্য কথা বলছে। সে বিষয়টি মিডিয়া সচেতনভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে। আজ পর্যন্ত মিডিয়ার পক্ষ থেকে ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে কি থাকবে না’ এ ব্যাপারে কোন জনমত জরিপ করা হয়নি। অভিভাবকদের মতামত জরিপ করা হয়নি। আমি ব্যক্তিগতভাবে সুনিশ্চিত যে বেশীরভাগ অভিভাবকই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে রায় দেবেন। এটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতো। কিন্তু সরকার সেটা কাজে লাগাতে পারেনি।
আজ পর্যন্ত শিক্ষক এসোসিয়েশনগুলোর পক্ষ থেকে কোন জোরালো পদক্ষেপ ও দাবি উত্থাপিত হয়নি। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীদের তেমন তাৎপর্যপূর্ণ ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছেনা। কারণ উনাদের মাসিক বেতন, বোনাস ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক প্রণোদনা ও সুযোগ-সুবিধা সাংবিধানিক ভাবে সুরক্ষিত। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আজ দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। অধিকাংশ প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। হাতেগোনা যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান টিকে আছে নিজ যোগ্যতাবলে তাদের অবস্থা ও নিভু নিভু। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লক্ষ লক্ষ কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে শতকরা ৯৫% এর অধিক শিক্ষার্থীরা Digital Hangover নামে এক দুরারোগ্য মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধির শিকার হতে যাচ্ছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলে দেওয়া হলে ও বহুবছর লাগবে ছাত্র-ছাত্রীদের এই ঐধহমড়াবৎ থেকে বেরিয়ে আসতে। কারন তাদের মন ও মানসিক জগতে ডিজিট্যাল ডিভাইস গুলোর প্রভাব এত গভীরভাবে প্রোথিত যে এই প্রভাব মাদকাসক্তির চেয়ে ও ভয়াবহ। উন্নত বিশ্বের দেশসমূহে মাদকাসক্তি থেকে নিরাময়ের জন্য যে রকম Rehabilitation Center এ পাঠিয়ে দেয়া হয়, তেমনি Digital Hangover থেকে মুক্তির জন্য বিশেষ Rehabilitation Center খোলা হচ্ছে। আর আমরা কি করছি? পুরো শিক্ষাব্যাবস্থা, শিক্ষকসমাজ ও লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছি। ঐ একটি ব্যাপারে সবাই মুখে তালা মেরে বসে আছি।
এখন সময় এসেছে মুখ খোলার। অধিকাংশ ব্যবসায়ী ঐকমত্যভাবে লকডাউনকে প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেছেন। সকল প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ ও এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দের উচিত সরকারের নিকট যুক্তিসংগত প্রস্তাবনা তুলে ধরা এবং সরকারের উচিত রাষ্ট্রযন্ত্রের অধীনস্থ সকল প্রতিষ্ঠানের মতো প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে একই নীতিতে বিচার করা। সময় থাকতে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নতুবা প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোকে সরকার চাইলে ও রক্ষা করতে পারবে না, যদি সেটা ‘Point of no return state’-এ পৌঁছে যায়। সেটা কিন্তু বেশি দূরে নয়। আল্টিমেটলি, সরকারকে এ দায়ভার নিতে হবে। এটা এড়ানোর সুযোগ থাকবে না। কারণ এর রয়েছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব। শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সাথে সাথে বেকার হয়ে যাবে হাজার হাজার শিক্ষক। ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত হবে হাজার হাজার পরিবারের লাখ লাখ সদস্য।
ইউনেস্কোর তথ্যানুযায়ী সমগ্র বিশ্বের ১.২ বিলিয়ন শিক্ষার্থী কোভিডের প্রভাবে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। বাংলাদেশ ও তার ব্যতিক্রম নয়। দেশের প্রায় ৩৬.০ মিলিয়ন শিক্ষার্থী আজ শিক্ষা কার্যক্রমের বাহিরে। অর্থমন্ত্রী এএইচএম মোস্তফা কামাল নিজেই গত বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন , “Covid-19 has essentially caused discontinuation of the regular academic curriculum of around 40.0 million students across the country.”
এর সাথে যোগ হবে ‘school drop out’ এর সংখ্যা, ডিজিট্যাল ডিভাইড, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যগত ও মানসিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতা, অপুষ্টি, মানুষের বেকারত্ব, অভিভাবক ও ছাত্র-ছাত্রীদের ডেমোগ্রাফিক ডিসলোকেশন, ইত্যাদি জটিল সমস্যা যা সরকারের দ্বারা মোকাবেলা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
দীর্ঘ মেয়াদি অধ্যয়ন-শূন্যতা শিক্ষার্থীদের মনোবৈকল্যের ঝুঁকিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাবে যেখান থেকে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনার যে সাইকোলজিক্যাল দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, তা আমাদের শিক্ষক সমাজের নেই।
SANEM এর একটি জরিপে উঠে এসেছে যে মাত্র তিন মাসের লকডাউনে ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবারের দারিদ্র্য সীমার হার ২৩.৯০% থেকে ৪৩.৯০% হয়েছে।
সরকারের ভুলে গেলে চলবেনা, এ হাজার হাজার অভিভাবক, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক এ দেশের জনগণ। এ দেশের ভোটার ও বটে। ব্যাপারটা সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দিতে পারে। এ মধ্যবিত্ত মানুষগুলোই সরকারের অক্সিজেন। এরাই দেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে। পরিশ্রমী এ মানুষগুলোর জন্যই অর্থনীতির চাকা সচল। এদের পেটে এবার প্রচ- আঘাত পড়েছে। বুঝতে হবে পৃথিবীর তাবৎ বড় বড় বিপ্লবের উৎসমূল হল পেট। তাই সরকারের উচিত সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সঠিক ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়া এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার নিরাপদ ব্যবস্থা করা। শিক্ষা বাঁচাতে দল মত নির্বিশেষে সকলের ঐক্যমত পোষণ করা এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয়।
লেখক: শিক্ষাবিদ-কলামিস্ট