লকডাউন না প্রহসন?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ এপ্রিল ২০২১, ৮:৫৩:৪৯ অপরাহ্ন
নিজাম উদ্দিন সালেহ:
দেশব্যাপী এক সপ্তাহের লকডাউন জারির পর একদিন যেতে না যেতেই ঢাকাসহ সকল সিটি করপোরেশন এলাকায় গণপরিবহন সার্ভিস চালুর কথা ঘোষণা করেছে সরকার। এ কথা অনস্বীকার্য যে, গণপরিবহনের মাধ্যমেই করোনাভাইরাস ছড়ায় সবচেয়ে বেশী। এটা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ করোনা পীড়িত সকল দেশেই প্রমাণিত। তাই দেশের প্রত্যন্ত তথা মফস্বল এলাকায় গণপরিবহন বন্ধ রেখে সিটি করপোরেশন এলাকায় গণপরিবহন সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্তে অনেকেই হতবাক। বাংলাদেশের মফস্বল এলাকায় করোনা সংক্রমণের হার অত্যন্ত কম। গ্রামাঞ্চলে প্রায় শূন্যের কোঠায়। কিন্তু এসকল স্থানে গণপরিবহন বন্ধ রেখে সবচেয়ে করোনা প্রবন সিটি কর্পোরেশন এলাকায় তা চালু রাখা একটি হঠকারি সিদ্ধান্ত, এমন মন্তব্য অনেকের। এতে সংক্রমণ ঠেকানো যাবে না বলে তাদের অভিমত। সম্প্রতি করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির পর এই মহামারি প্রতিরোধে গৃহীত ব্যবস্থা ও পদক্ষেপের ক্ষেত্রে এক ধরণের জগাখিচুড়ি বা বিশৃঙ্খল অবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
গতকাল দেশে করোনায় মারা গেছেন রেকর্ডসংখ্যক ৬৬ জন এবং আক্রান্ত ৭ সহস্রাধিক। বিষয়টি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। অনেকের মতে, সরকারের এই লকডাউনের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। আন্দোলন ঠেকাতে হঠাৎ করেই লকডাউনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সিলেটী ভাষায় একটি প্রবাদ হচ্ছে, ‘চেনানির সময় ছাগী ধরতে অয়’ অর্থাৎ মূত্রত্যাগকালে ছাগল ধরতে হয়। যথাসময়ে যথার্থ কাজটি করতে হয়। অন্যথায় পরে পস্তাতে হয় ব্যর্থতার জন্য। তাই কারোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতে অর্থাৎ মার্চের শুরুতে যদি কঠোর স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়ন কিংবা লকডাউনের মতো পদক্ষেপ নেয়া হতো, তবে বর্তমানে করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণ রেকর্ডভঙ্গ করতো না।
রমজান ও ঈদ আসন্ন। এ সময়ে হঠাৎ করেই দেশব্যাপী লকডাউনের ঘোষণা ব্যবসায়ীসহ সকলস্তরের মানুষের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কারণ গত রমজান ও ঈদে করোনা মহামারির কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারেননি। এছাড়া ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দাবস্থা গেছে গত প্রায় এক বছর। এ অবস্থায় কোন কিছু না ভেবে লকডাউনের ঘোষণায় তারা যুগপৎ হতাশ ও ক্ষুব্ধ। ইতোমধ্যে সিলেটসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ব্যবসায়ীরা তাদের এই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং এখনো তা অব্যাহত আছে। তাদের অনেকের বক্তব্য হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত সময়ের জন্য হলেও দোকানপাঠ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে ব্যবসা করতে চান। আবার অনেকের মতে, স্বাস্থ্যবিধি পালনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ বা বাধ্য করতে কর্তৃপক্ষ যখন ব্যর্থ, তখন লকডাউেেনর ঘোষণা কতটুকু কাজে আসবে? বাস্তবে তা-ই দেখা যাচ্ছে, শুরু থেকেই লকডাউন ঢিলেঢালা কর্মসূচীতে পরিণত হয়েছে। অনেক দোকানপাঠ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও অনেকগুলোই খোলা। রাস্তাঘাটে প্রায় স্বাভাবিক সময়ের মতোই লোকজনের ভিড়, অনেক স্থানে রীতিমতো যানজট দেখা যাচ্ছে।
এ অবস্থায় শুধু জনদুর্ভোগ বেড়েছে। যে সব যানবাহন চলছে সেগুলো দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া আদায় করছে অসহায় যাত্রীদের নিকট থেকে। দোকানপাট বন্ধ থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা, বিশেষভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও তাদের কর্মচারীরা। অফিস ব্যাংক ইত্যাদি খোলা থাকায় অনেক কষ্টে, সময় নষ্ট করে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে কর্মচারীদের অফিসে যাতায়াত করতে হচ্ছে।
হঠাৎ করেই এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করা হলো। লকডাউনের সময় এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষভাবে দিনমজুর তথা ‘যারা দিন আনে দিন খায়’ তাদের অবস্থা কী হবে, তারা কীভাবে খেয়ে বাঁচবে সে কথা একটিবারও কাউকে ভাবতে বা বলতে দেখা যায়নি। যেনো গরীব মানুষ মানুষই নয়, তারা না খেয়ে মরলেও কিছুই যায় আসে না। বিষয়টি জাতি হিসেবে অত্যন্ত লজ্জার, অত্যন্ত দুঃখের। বিশ্বের কোন সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে এমনটি কল্পনাও করা যায় না।
ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। জনগণ সরকারের লকডাউনের নির্দেশনা না মেনে রাস্তায় নেমে আসছে। ইতোমধ্যে এ নিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। যন্ত্রণা ও ক্ষোভে ফুঁসছে মানুষ, ফুঁসছেন ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতিতে মন্ত্রী পরিষদ সচিব বলেছেন, দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ও সংক্রমণরোধে সরকারী নির্দেশনা লকডাউন নয়, কঠোর নিষেধাজ্ঞা। অথচ ক্ষমতাসীন নেতানেত্রী ও মন্ত্রীরা এটাকে লকডাউন বলেই ঘোষণা করেন। এ যেনো এক হবুচন্দ্রীয় আশ্চর্য প্রহসন।
প্রশ্ন হচ্ছে, অদূরদর্শিতা সমন্বয়হীনতা ও সাধারণ জনগণের জীবন নিয়ে এমন নাটক ও প্রহসনের অবসান হবে কবে? নাকি লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধির মাধ্যমে এই প্রহসন বা নাটকের আরেকটি অংক অভিনীত হবে আগামী সপ্তাহে? করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এই সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন, এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে তা হতে হবে বাস্তবধর্মী ও সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা মাথায় রেখেই।