হাওরে বিকল্প জ্বালানী
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ এপ্রিল ২০২১, ৫:৪২:২২ অপরাহ্ন
তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ, সুনামগঞ্জ : ‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলে পাইতে পার অমুল্য রতন’ কবির এমন ছন্দটি এবার প্রতিফলিত হচ্ছে হাওরের দরিদ্র মানুষদের জন্য। সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, দিরাই-শাল্লা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, তাহিরপুর হাওর এলাকার নিচু জমি ও নদী থেকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার উপযোগী হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে একধরনের কয়লা সদৃশ কালোমাটি।
হাওর এলাকার গ্রামে-গ্রামে পরিবেশবান্ধব এই কালোমাটি প্রক্রিয়াজাত করে রোদে শুকিয়ে জ্বালানী হিসেবে রান্নার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এতে করে বনজ সম্পদ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে এই কালোমাটি। বিল, ধানী জমি, কিছুটা খনন করে ও নদীতে পানির নিচে এই মাটি পাওয়া যাচ্ছে। এই কলোমাটি দিয়ে তৈরি জ্বালানী ব্যবহার করে দরিদ্র ও শ্রমজীবী নারী-পুরুষ বাড়তি আয়সহ পরিবারের জ্বালানী আয় সাশ্রয় করছেন। জেলার জামালগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী তাহিরপুর, দিরাই, ধরমপাশা, দিরাই-শাল্লা ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার অনেক পরিবারের লোকজন বিকল্প জ্বালানী হিসেবে এই মাটি ব্যবহার করে আসছেন।
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির শেষের দিক থেকে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত বৃষ্টিপাত না হলে হাওর এলাকায় বসবাসকারী লোকজন এই মাটি সংগ্রহ করে থাকেন। সুরমা, বৌলাই, রক্তি নদীসহ বেশ কয়েকটি নদীতে ও কাই হাওর, সাংহাই হাওর, সেফটি হাওর, ভরাম হাওর, নলুয়ার হাওর, পাকনা হাওর, হালির হাওর, ধারাম হাওর, ধানকুনিয়া হাওরসহ বেশ কয়েকটি নিচু এলাকার হাওরে এই কালোমাটি পাওয়া যাচ্ছে। শুষ্ক নদী ও হাওরের তলদেশ ৭ থেকে ১০ ফুট গভীরতায় এই কালোমাটি পাওয়া যায়। নদী বা হাওর থেকে এই মাটি সংগ্রহের পর প্রক্রিয়াজাত করে রোদে শুকিয়ে জ্বালানী তৈরি করা হয়। মাটি জ্বালানী উপযোগী করতে ১০ থেকে ১২ দিন সময় লাগে। প্রক্রিয়াজাত প্রতিমন মাটি দিয়ে একটি পরিবারের এক সপ্তাহ রান্না করা যায়।
আবার অনেকেই এই মাটি আহরণ করে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে সারাবছর জ্বালানী হিসেবে ব্যবহারের জন্য মওজুদ করছেন। কেউবা বাজারজাত করে বাড়তি আয়ের মাধ্যমে পরিবারের খরচ মেটাচ্ছেন। এ জ্বালানী হাওরাঞ্চলে তৈরি করছে এক ধরণের লাকড়ি (জ্বালানী) বাজার। কালোমাটি সাশ্রয়ী, সহজলভ্য ও কাঠসহ অন্যান্য জ্বালানীর চেয়ে দীর্ঘক্ষণ জ্বলার কারণে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আর এগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। কালোমাটি ব্যবহারের ফলে গাছপালা ও বনজসম্পদ উজার করা থেকে রক্ষা পাচ্ছে পরিবেশ।
জামালগঞ্জ উপজেলার পাকনা হাওরের বাসিন্দা নয়ন মিয়া জানান, প্রতি বছর আমাদের হাওরের নিচু জমিগুলো ৭-৮ হাত মাটি খুঁড়ে কালো মাটি উত্তোলন করে অনেক পরিবারই সারা বছরের জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করেন। বেগম বানু বলেন, আগে গাছের ডালপালা কেটে রান্নার কাজে ব্যবহার করতাম। এখন কালো মাটি পাওয়ায় গাছ কাটতে হয়না। মনু মিয়া বলেন, আমাদের এলাকায় নদী ও হাওরের নিচু জায়গায় কিছু মাটি খুঁড়লেই কালো মাটি পাওয়া যায়। এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে রোদে শুকিয়ে প্রায় সারা বছরই জ্বালানী ব্যবহার হয়। আগুন হয় খুব ভালো, ধোয়া হয়না। রান্না করা তরিতরকারীতে কোন গন্ধও হয়না।
গজারিয়া গ্রামের আকলিমা আক্তার সখী জানান, কালো মাটি দিয়ে রান্না করার জন্য লোহার রড দিয়ে নেট জালের মতো একটি বিশেষ ধরনের চুলা তৈরি করতে হয়। রান্না শেষে ছাই গুলো নেটের নিচে পড়ে থাকে এতে ঝামেলা পোহাতে হয়না। কালো মাটি পাওয়ায় বনায়ন সঠিকমতো বাড়ছে। সরকারীভাবে সার্ভের মাধ্যমে এর প্রয়োজনীয়তা নিরুপণ করে এই কালো মাটি একটি সাশ্রয়ী জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে এমনই অভিমত ব্যক্ত করেছেন এলাকার লোকজন।