জম্মু-কাশ্মীরে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ এপ্রিল ২০২১, ৯:০৯:০৩ অপরাহ্ন
আব্দুর রহমান খান :
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংঘটন আমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে ভারতে বিশেষ করে জম্মু-কাশ্মীরে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে । বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সংস্থাটি ৭ এপ্রিল তাদের ২০২০-২১ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনের ভারতের অংশে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, জম্মু-কাশ্মীরে কোভিড ১৯ মোকাবেলার নামে শাস্তিমূলক লকডাউন বলবৎ করা হয়েছে, বিক্ষোভ থামাতে চরম দমন-নিপীড়নের পথ বেছে নেওয়া হয়েছে, নিবর্তনমূলক আইন জারী করে মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও হয়রানী করা হচ্ছে। কাশ্মীরে ৭ জন মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তার এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করে দিয়ে ভারতে সংস্থাটির কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে।
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সংখ্যালঘু মুসলমান, শিখ, আদিবাসী ও দলিতদের দমনে গুলি, টিয়ারগ্যাস ও দলীয় গুন্ডাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। মিছিলে লাঠি-গুলি ছাড়া বাড়িঘরে হামলা এবং অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন ও নিবর্তনমূলক আইনে জেলে ভরা হচ্ছে।
নাগরিকত্ব আইন বা কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য চরম নির্যাতনের পথ অবলম্বন করেছে ভারতের মোদী সরকার। দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে এসব নির্যাতন নিপীড়ন বা হত্যাকাণ্ডর ঘটনায় দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ।
জম্মু কাশ্মীর প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে পুলিশ অন্যায়ভাবে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আর্মড ফোর্সেস (স্পেশাল পাওয়ারস) অ্যাক্ট বলে তারা বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েও দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার খর্ব করার পর থেকে সেখানে কার্যত অবরোধ অবস্থা বিরাজ করছে। নাগরিক অধিকার, চলাচলের অধিকার নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়েছে।
নতুন আইন করে সংবাদ প্রচার বা প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমন নিবর্তনমূলক আইন দিয়ে সংবাদ মাধ্যমকে টুটি চেপে ধরা হয়েছে। অন্ততঃ ১৮ জন সাংবাদিককে পুলিশ রাস্তায় লাঠিপেটা করেছে এবং থানায় ডেকে নিয়ে শাসিয়ে দিয়েছে।
কাশ্মীর টাইমস পত্রিকার সম্পাদক অনুরাধা ভাষিন কাশ্মীরে ইন্টারনেট ও টেলিফোন সেবা বন্ধ করার সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টের দ্বারস্থ হন। আর সে কারণে তার পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
নাগরিক অধিকার নিয়ে আন্দোলন করার দায়ে তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ দিয়ে অধিকার কর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে সরকারি বাহিনী।
এদিকে, কাশ্মীরিদের অধিকার হরণের সাথে সাথে তাদের জমি কেড়ে নেবার কৌশল নিয়েছে ভারত সরকার। এর আগে কাশ্মীরের বাইরের কেউ সেখানে জমি কিনতে পারতোনা, সরকার আইন করে সে ধারা বিলোপ করে দিয়েছে। বাইরের লোকদের কাশ্মীরে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দেবার মাধ্যমে জনসংখ্যাগত পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে এর মূল উদ্দেশ্য। এমনটিই মনে করছেন কাশ্মীরবাসীরা। এ ছাড়া, সেনানিবাসের পরিধি বাড়াতে বা নতুন স্থাপনা নির্মাণের নামে পার্শ্ববর্তী এলাকার মুসলমানদের জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। এর ফলে কাশ্মীরীদের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম প্রভাব, সংস্কৃতি, সামাজিকতা, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি এবং পরিবেশগত পরিবর্তন ঘটছে দ্রæতভাবে।
ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার খর্ব করার পর সেখানকার খনিজসম্পদ আহরণের জন্য বাইরের ঠিকাদার নিয়োগ করা হচ্ছে। ফলে বঞ্চিত হচ্ছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
সম্প্রতি নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্বিন্যাসের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা বাড়িয়ে তাদের মধ্য থেকে বেশী সংখ্যক প্রতিনিধি বের করে মুসলিম প্রধান কাশ্মীরে হিন্দু নেতৃত্ব স্থাপন করা। তাছাড়া, জম্মু কাশ্মীরে ৫০ হাজার হিন্দু মন্দির স্থাপনের পরিকল্পনাটিও এখন আর গোপন কিছু ব্যাপার নয়। ভারত সরকার ইতোমধ্যে অনেকগুলি ঐতিহাসিক মসজিদ এবং মাজারকে চিহ্নিত করেছে যেখানে তারা মন্দির নির্মাণ করবে। ভারতের বিজেপি সরকার দাবি করছে, এসব স্থানে একদা হিন্দুদের মন্দির ভেঙে ওসব মসজিদ মাজার নির্মাণ করা হয়েছিল।
ভারতীয় সামরিক শাসনে অবরুদ্ধ হয়ে কাশ্মীরিরা প্রত্যক্ষ করেছে যে, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট তাদের বিশেষ অধিকার কেড়ে নেবার পর থেকে জঙ্গি আস্তানার নাম করে তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিবাদী শিক্ষিত যুবকদের হত্যা করা এখন নিয়িমত ঘটনা হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে দশজন এমফিল বা পিএইচডিধারী বিদ্বান, ১৫ জন স্নাতকোত্তর, ৪৭ জন স্নাতক এবং আরও অনেককে বিভিন্ন ঘটনায় হত্যা করা হয়েছে। কাশ্মীরের গোটা জনগোষ্ঠী এখন একটা সার্বক্ষণিক আতংকের মধ্যে বাস করছে। তাদেরকে একরকম পাইকারি শাস্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিদিন। এক চরম অস্তিত্বের সঙ্কটে রয়েছে কাশ্মীরবাসী। বিশ্ব গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংগঠন এটা এখন অনুধাবন করতে পারছে যে শোকসন্তপ্ত কাশ্মীরে বিরাজ করছে কবরস্থানের নীরবতা।