ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের পাথর লুটকালে ডুবে শ্রমিকের মৃত্যু
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ এপ্রিল ২০২১, ৯:০৫:১৯ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার :
সিলেটের ভোলাগঞ্জে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে এক কিশোর শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোরে রেলওয়ে বাঙ্কারের সরকারী জায়গায় পাথর উত্তোলনের সময় এ ঘটনাটি ঘটে।
নিহত জহির আলম (১৭) সদর উপজেলার মানসিনগর (নোয়াগাঁও) গ্রামের মৃত ইউনূস আলীর ছেলে। বর্তমানে সে দয়ার বাজারের একটি কলোনিতে বসবাস করতো।
নিহত শ্রমিক জহিরের সাথে থাকা এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, প্রতিদিনের মতো বুধবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে প্রায় একশটি নৌকা বাংকারে পাথর আনতে যায়। তাদের সাথে জহিরসহ আমরা ৫ জন একটি নৌকা নিয়ে বাঙ্কার থেকে পাথর আনতে যায়। বাঙ্কারের উত্তর পূর্ব সাইড থেকে পাথর উত্তোলনকালে ভোর ৪টার দিকে ঝড়ের পূর্বাভাস দেখতে পেয়ে তাড়াহুড়ো করে পাথর দিয়ে নৌকা বোঝাই করে বাংকের তীর থেকে ৫০ গজ দূরে যেতেই ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকাটি। প্রবল কালবৈশাখী ঝড়ে নৌকাটি পানির নিচে তলিয়ে যায়। নৌকায় থাকা বাকি ৪ জন সাঁতার কেটে তীরে উঠলেও জহির আলম তীরে উঠতে সক্ষম হননি। ঝড় থামার পর স্থানীয়রা অনেক খোঁজাখুঁজির পর ১১ টার দিকে নদী থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশ উদ্ধারের পর রাসেলসহ স্থানীয় পাথর খেকোরা লাশ লুকিয়ে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
এ ব্যাপারে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি কে. এম. নজরুল ইসলাম বলেন, ওই এলাকার বিভিন্ন গর্তে থাকা বালুর ভেতর থেকে জহির পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে। পরে একটি চক্র লাশ তার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেও পুলিশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য ওসমানী হাসপাতালে প্রেরণ করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জানা যায়, করোনা ভাইরাসের কারণে সরকার ঘোষিত লকডাউনকে পুঁজি করে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মহল সংরক্ষিত রোপওয়ের দায়িত্বরত আরএনবি সদস্যদের সাথে যোগসাজশ করে প্রায় ১৫ দিন থেকে প্রতি দিনে ও রাতে পাথর লুট করত। পর্যটনকেন্দ্র সাদা পাথরের পাশে এই রোপওয়ের জায়গাটি হওয়ায় পর্যটকদের আনাগোনার কারণে এতোদিন তারা পাথর লুটপাট করতে পারেনি। করোনার কারণে সরকার লকডাউন দেয়ায় সাদা পাথর পর্যটকশূন্য হয়ে পরে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাথরখেকো চক্রের মূল হোতা রাসেলের নেতৃত্বে চলে বাংকার থেকে পাথর লুটপাট। প্রতিদিন প্রায় একশ থেকে দেড়শ নৌকা করে পাথর লুটপাট করা হতো। ৫০-৮০ ফুটের এসব নৌকা থেকে ৩ হাজার টাকা চাঁদাবাজি করতো রাসেলের নেতৃত্বে মীর হোসেন সহ চাঁদাবাজ চক্রের সদস্যরা। রাসেল কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উত্তর কলাবাড়ি গ্রামের মখলিছুর রহমানের ছেলে। রাসেল উত্তর কলাবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা হলেও দিনের প্রায় অর্ধেকের বেশি সময়ই সংরক্ষিত রোপওয়েতে (বাঙ্কার) অবস্থান করে। এজন্য বাঙ্কার রাসেল নামেও এলাকায় পরিচিত।
এদিকে বাঙ্কার রাসেল দিনের বেশিরভাগ সময় রোপওয়েতে থাকার কারণে সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আরএনবি’র সদস্যসহ তাদের উর্ধ্বতন কর্মকতাদের সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। স্থানীয় বিজিবির এফএস এর সাথেও রয়েছে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক। যে কারণে সীমান্ত ঘেঁষা রোপওয়েতে তার একক আধিপত্য চলে। এখানে বাহির থেকে কেউ যেতে চাইলে নিতে হয় তার অনুমতি। এমনকি আরএনবি সদস্যদের সাথে বনিবনা না হলে এখান থেকে ট্রান্সপারও করাতে পারে সে। তার এই কাজের মাঠ বাহিনীর নেতৃত্ব দেয় পাড়ুয়া উজান পাড়া গ্রামের মূসা মিয়ার ছেলে মীর হোসেন।
বাঙ্কারের ইতিকথা : ৩৬০ একর জায়গা নিয়ে বিস্তৃত ছিল কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে বাংকার এলাকা। যাতে একটি স্কুল, একটি মসজিদ, কর্মকর্তা কর্মচারীদের থাকার জন্য দালানকোঠা, বিদ্যুৎ (জেনারেটর) ক্রেইন বাকেটসহ সবধরনের আধুনিক যন্ত্রাংশ ও সুযোগ-সুবিধা ছিল এখানে। কিন্তু প্রভাবশালী পাথরখেকো ও রেলের অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের কারণে বাঙ্কার বিলীনের পথে।
৩৬০ একর জায়গার মধ্যে এখন অবশিষ্ট আছে প্রায় ১০০ একর জায়গা। এই জায়গায়ও বর্তমানে পড়েছে পাথর খেকোদের খপ্পরে। পাথর খেকোদের দৌরাত্মের কারনে কালাইরাগ, কালিবাড়ি, দয়ারবাজার ও ভোলাগঞ্জ গুচ্ছগ্রামের সংযুক্তি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় সেখান থেকে স্কুলটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
জেনারেটরটিও অনেকদিন না চালানোয় নষ্ট হয়ে গেছে। এটি এতই শক্তিশালি ছিলো যে পুরো বাঙ্কার এলাকার সমস্ত যন্ত্রাংশ এই জেনারেটরের বিদ্যুৎ দিয়ে চালানো যেত। এই জেনারেটর তদারকি করার জন্য আবার ২ জন কর্মচারীও সেখানে রাখা হয়েছে। সেখানে তাদের কাজ কি জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, জেনারেটরটি নষ্ট থাকায় এখানে বর্তমানে আমাদের কোন কাজ নেই। বেশীরভাগ দালানের দর্জা জানালা নেই, যেগুলো রেলের কর্মচারীরা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে পুড়িয়ে ফেলেছেন।
পুরো বাংকারকে লতাপাতায় এতটাই ঘিরে রেখেছে যা দেখলে মনে হবে বর্তমান সভ্যতার কোন ছিটেফোঁটাও বুঝি পৌছায়নি এখানে। এ যেন এক প্রাচীন যুগের হাজার বছর আগের পুরোনো নিদর্শন। লতা পাতায় আচ্ছন্ন ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে হয়। দিনের বেলায় চলাচল করতে গেলেও ভয়ে আতঁকে ওঠে শরীর। আবার এসব বন জঙ্গল কাটার জন্য কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ কিন্তু তারাও খেয়ে শুয়ে দিন কাটাচ্ছে।
পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বাঙ্কার এলাকায় রেলওয়ের ভূমি কেটে পাথর উত্তোলনের অভিযোগটি সত্য নয় জানিয়ে সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর ও মিডিয়া) মো: লুৎফর রহমান বলেন, তবে পুলিশের এ রকম কোন অভিযোগ পাওয়া গেলে সেটি খতিয়ে দেখা হবে।