ইলিয়াস আলী গুমের ৯ বছর: রহস্য উদঘাটন হয়নি আজো!
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ এপ্রিল ২০২১, ৯:২৮:৩২ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল: এম ইলিয়াস আলী নিখোঁজের ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও তার গুম হওয়ার রহস্য আজও উদঘাটন হয়নি। শুধু ইলিয়াস আলী নয়, দেশের অন্যান্য গুম বা নিখোঁজের ঘটনাগুলোর প্রায় কোনোটিরই কূল-কিনারা হয়নি। অথচ আজো ফেরার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছেন ইলিয়াস আলীর বৃদ্ধা মা সূর্যবান বিবি, সহধর্মিনী তাহসীনা রুশদীর লুনা ও তার ছেলে মেয়েরা। তার সাথে গুম হওয়া ইলিয়াস আলীর গাড়ী চালক আনসার আলীর পরিবারও আজো প্রতীক্ষায় আছে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি ফিরে আসবেন। গুমকৃতরা ফিরবে কি ফিরবেনা? এর কোন নিশ্চয়তা না থাকলেও স্বজনের অনন্ত কালের অপেক্ষার প্রহর কখনো শেষ হবেনা। যতক্ষণ পর্যন্ত না এসব গুম রহস্যের উদঘাটন হবে।
রাজধানীর বনানী থেকে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে ব্যক্তিগত গাড়ি চালক আনসার আলীসহ নিখোঁজ হন সাবেক এমপি, বিএনপির কেন্দ্রীয় সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সিলেট জেলা সভাপতি এম ইলিয়াস আলী। গুমের দুই দিন পর তার স্ত্রী তাহমিনা রুশদীর লুনা হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। তিনি সেসময় অভিযোগ করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবৈধভাবে তার স্বামীকে আটক করেছিল। তখন দলের নেতারাও একই অভিযোগ তুলেছিলেন। ইলিয়াস আলীকে আদালতে হাজির করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশ চেয়েছিলেন ইলিয়াস পত্নী লুনা। তার রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ১০ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা চেয়ে রুল জারি করে বলেছিলেন, ইলিয়াস আলীকে অবৈধভাবে আটক করা হয়নি এই মর্মে সন্তুষ্ঠ হওয়ার জন্যে কেন তাকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হবে না। যাই হোক, ৯ বছর পেরিয়ে গেছে। আবেদনকারী বা সরকার রিট আবেদনের শুনানির বিষয়ে কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় রুলের শুনানি আজও হয়নি। ফলে অমীমাংসিত রয়ে গেছে ইলিয়াস গুমের বিষয়টি। এর ওপর কোনো রায় দেওয়া হয়নি।
জানা যায়, ২০১২ সালের ১৯ এপ্রিল রুল জারির পর মে মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাঁচটি সংস্থা হাইকোর্টে পৃথক পৃথক প্রতিবেদন জমা দেয়। তখন এটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছিল, সংস্থাগুলো নিজ নিজ প্রতিবেদনে দাবি করেছে, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী তাদের হাতে আটক নেই। তারা তাকে ‘তুলে নিয়ে আসেনি বা আটক করেনি’। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), র্যাব, সিআইডি, বিশেষ শাখা (এসবি) ও বনানী থানার প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ইলিয়াস আলীর খোঁজ পেতে তারা সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গুমের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হাইকোর্টের নির্দেশনা চেয়ে ইলিয়াস আলীর মামলার পর আরও অনেক মামলা করা হয়েছে। কিন্তু, সেগুলোর সুরাহা চেয়ে আদালত থেকে কোনো নির্দেশ আসেনি।
ছাত্র রাজনীতি দিয়ে নেতৃতে¦র সূচনা হলেও ইলিয়াস আলী পর্যায়ক্রমে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিএনপির মতো একটি বড়ো দলে। এমপি নির্বাচিত হয়ে সংসদে কথা বলেছেন নিজের জন্মস্থান বিশ^নাথ-বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগরের মাটি ও মানুষের পক্ষে। ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় সে সময় লাগাতার হরতাল সহ রাজপথের আন্দোলনে কার্যত অচল হয়ে পড়ে দেশ। তার নিজ উপজেলা বিশ্বনাথে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন দলীয় নেতাকর্মীরা। আন্দোলনরত নেতাকর্মীদের উপর পুলিশ গুলি চালালে ৩ জন নিহত এবং শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। ইলিয়াস আলী নিখোঁজের পর থেকেই তার পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে গুমের সাথে জড়িত বলে দাবি করা হয়ে আসছে। বিএনপির এই শক্তিমান নেতা ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় দেশে-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হলে শুরুর দিকে গুম রহস্য উদঘাটনে কিছুটা তোড়জোড় থাকলে আস্তে আস্তে তা ঝিমিয়ে পড়ে। প্রতি বছর এই তারিখে ঢাকা ও সিলেটে ব্যাপকভাবে কর্মসুচি পালন করে বিএনপি ও এর অংগ সংগঠন। গুমের ৯ বছর পূর্তির দিনে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় দেশে কঠোর লকডাউন চলছে। এর কারণে ঢাকা ও সিলেটে কোন দলীয় কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়নি। তবে বিশ^নাথ ও ওসমানীনগরের বিভিন্ন মসজিদে মসজিদে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে বলে ইলিয়াস আলীর পরিবার সূত্রে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে ইলিয়াস আলীর খুব বিশ^স্তজন হিসেবে পরিচিতি সিলেট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কামরুল হুদা জায়গীরদার দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সিলেটের কোটি জনতার হৃদয়ের স্পন্দন এম ইলিয়াস আলী গুমের ৯ বছরেও তার সন্ধান দিতে না পারা সরকারের জন্য চরম ব্যর্থতা। ইলিয়াস আলী ও অন্য যেকোন নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইলিয়াস আলীকে গ্রেফতার করেনি বলেই থেমে গিয়েছিল। কিন্তু তারা তাকে খুঁেজও বের করতে পারেনি। তবে আমরা মনে করি সরকারের কোন বাহিনীই ইলিয়াস আলী সহ নিখোঁজ দলীয় নেতাকর্মীদের গুম করেছে। আজ হোক কাল হোক এই গুম রহস্যের উদঘাটন হবেই। কর্মসুচীর ব্যাপারে তিনি বলেন, করোনা মহামারীর কারণে এই বছর প্রিয় নেতার গুম হওয়ার তারিখে জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে কোন কর্মসুচী হাতে নেয়া হয়নি। তবে স্ব স্ব উদ্যোগে পরিবার পরিজন নিয়ে ইলিয়াস আলীর সন্ধান কামনায় বিশেষ মোনাজত করার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি।
এ ব্যাপারে ইলিয়াস আলীর সহধর্মিণী তাহমিনা রুশদীর লুনা দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, এক এক করে ৯টি বছর হয়ে গেলো ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হলো। আমাদের চোখে যতক্ষণ জল আছে ততক্ষণ শুধু প্রিয়জনের অপেক্ষায় অশ্রুবিসর্জন করবো। সরকারের দ্বারস্থ হয়েছি। কিন্তু সরকারের কর্মকান্ডে প্রমাণিত হয়েছে যে ইলিয়াস আলী গুমে সরকার নিজেই জড়িত। তাই তারা ইলিয়াস আলীর সন্ধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা আল্লাহর আদালতেই বিচার দিলাম। এই ফ্যাসিস্ট সরকারের বিদায় হলে, জনতার সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ইলিয়াস রহস্যের উদঘাটন হবে। তিনি ইলিয়াস আলীসহ নিখোঁজ নেতাকর্মীদের অক্ষত অবস্থায় সন্ধান কামনার জন্য দলীয় নেতাকর্মী তথা সিলেটবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা: সাখাওয়াত হাসান জীবন দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আমরা বিশ^াস করি সিলেটবাসীর প্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলী সরকারের গুম নামক কারাগারে আছেন। আমরা অবিলম্বে ইলিয়াস আলী সহ সারাদেশে গুম হওয়া ৫ শতাধিক নেতাকর্মীদেরকে অক্ষত অবস্থায় তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবী জানাচ্ছি। আদর্শিক রাজনীতিকে আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করা উচিত, গুম খুন নিপীড়ন চালিয়ে নয়। গুমের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি কারো জন্য কল্যানজনক হবেনা। আমরা মনে করি সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে, নিখোঁজ জননেতা এম ইলিয়াস আলী, ছাত্রদল নেতা ইফতেখার আহমদ দিনার ও জুনেদ আহমদ, গাড়ী চালক আনসার আলী সহ গুমকৃত নেতাকর্মীদের তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিবে।