আহলান সাহলান মাহে রমজান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ এপ্রিল ২০২১, ১০:৪৪:৩৮ অপরাহ্ন
সাঈদ আল মাদানী :
আজ ৪ রমজান, ১৪৪২ হিজরী। কেবল খাবার ও পানীয় গ্রহণ ও বৈধ যৌনবৃত্তি থেকে বিরত থাকলেই রোযার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রয়োগ হয় না। আল্লাহর ইচ্ছার সামনে নিজের বৈধ ইচ্ছা-চাহিদাগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে পরকালমুখী নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের দীক্ষা নিয়ে একজন ব্যক্তি যাতে তাকওয়া অর্জনে সক্ষম হতে পারে সে উদ্দেশেই ফরয করা হয়েছে মাহে রমযানে রোজা পালনের বিধান। মহান আল্লাহ বলেন: ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর; যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার’। (সূরা আল-বাক্বারা : ১৮৩)। আয়াতে আল্লাহ বলেছেন: ‘সম্ভবত তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে’। এখানে সম্ভবতঃ শব্দটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। রোযার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া। কিন্তু রোযা রাখলেই সবাই তাকওয়া অর্জন করতে পারে না। রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ ছাড়ল না, তার খাবার ও পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (সুনানে ইবনে মাজাহ)। রাসূল (সা.) আরো বলেন, অনেক রোজাদার এমন রয়েছে যাদের রোজায় ক্ষুধার্ত থাকা ছাড়া অন্যকিছু অর্জিত হয় না এবং অনেক রাত্রি জাগরণকারী এমন রয়েছে যাদের রাত্রী জাগরণের কষ্ট ব্যতীত আর কিছুই অর্জিত হয় না। [মুসনাদে আহমাদ]। এর কারণ কি? কারণ হচ্ছে, তারা না তাকওয়ার অর্থ বুঝেন, আর না বুঝেন রমযানের উদ্দেশ্য। বুঝেন না বলেই রোযা শেষ হওয়ার পর কিংবা রমযানের মধ্যেই তারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করেন এবং নিষিদ্ধ কাজ করে থাকেন। রোযা তাদের জীবনকে বিশুদ্ধ বা সংশোধিত করতে পারেনি। রোযার মাধ্যমে তাদের জীবন এবং আমলের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই তারা রোযার আকাংখিত ফল লাভ করতে সক্ষম হননি। সে জন্য রোজা পালন করার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরূরি।
এক. আপনি যখন সিয়াম পালন করবেন তখন আপনার অন্তর যেন রোজা পালন করে: অন্তরের হেদায়াত সকল ইবাদতের মূল কথা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তরের রোযা বলতে কি বুঝায়? অন্তরের রোযা বলতে বুঝায় অন্তরকে শির্ক থেকে মুক্ত, বাতিল আকীদা বিশ্বাস থেকে দূরে এবং খারাপ ও নিকৃষ্ট ওসওয়াসা মনোভাব ও নিয়ত থেকে খালি রাখা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, আল্লাহ তার অন্তরকে সৎপথে পরিচালিত করেন’। (সূরা আত্ ত্াগাবুন-১১)
দুই আপনি যখন সিয়াম পাল করবেন তখন আপনার চোখ যেন রোজা পালন করে: মহান আল্লাহ বলেন, মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত।” (সূরা আন নূর-৭৯)। দীনদার মুসলিম রোজাদার ভাই ও বোনেরা, টেলিভিশন ও দৈনিক পত্রিকার অশ্লীল বিষয়গুলো থেকে দূরে থাকুন। কারণ এদুটো জিনিস আপনার দৃষ্টিকে অপবিত্র করবে, হৃদয়কে কলুষিত করবে এবং আপনার দৃষ্টি ও আত্মার সিয়াম ধ্বংস করবে।
তিন: আপনি যখন সিয়াম পাল করবেন তখন আপনার পেট যেন রোজা পালন করে: পেটের রোযা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর উপর দেহের রোযার বিশুদ্ধতা নির্ভর করে। মানুষের জীবন, কাজ-কর্ম, চরিত্র ও আচরণের উপর হালাল ও হারাম খাদ্যের প্রভাব পড়ে। তাই হালাল খাবার খেলে ভাল ও নেক কাজ করার প্রেরণা জাগে। পক্ষান্তরে হারাম খাবার খেলে গুনাহ ও নিষিদ্ধ কাজ করার প্রেরণা জাগে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে দেহের গোশত হারাম মালে গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। হারাম মালে গঠিত দেহের জন্য জাহান্নামই সমীচীন’। (সুনানে তিরমিযি)।
চার: আপনি যখন সিয়াম পাল করবেন তখন আপনার জিহবা যেন রোজা পালন করে: ইসলামে মুখের কথার গুরুত্ব অনেক বেশী। জিহবা হচ্ছে কথা বলার বাহন বা হাতিয়ার। তাই জিহবাকে সংযত করা প্রয়োজন। বিশেষ করে রোযার ক্ষেত্রে এই সংযম আরো বেশী দরকার। আল্লাহ কুরআন মাজীদে বলেছেন: ‘কোন কথা উচ্চারণ করার সাথে সাথে অপেক্ষমান পর্যবেক্ষক প্রস্তুত থাকে।’ (সূরা ক্বাফ: ১৮)। অর্থাৎ মানুষের উচ্চারিত সকল শব্দের তদারক করা হয় এবং সেজন্য হিসেব দিতে হবে। তাই কথা বলার সময় বিবেচনা করতে হবে ও ভালো কথা ছাড়া খারাপ কথা বলা যাবে না। সাহাল ইবন মু‘আয থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যে আমাকে তার দুই ঠোঁট ও দুই উরুর মধ্যবর্তী স্থানের নিশ্চয়তা দেবে, আমি তার জান্নাতের নিশ্চয়তা দেবো’। (সহীহ আল বুখারী)।
পাঁচ: আপনি যখন সিয়াম পাল করবেন তখন আপনার কান যেন রোজা পালন করে: কান শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কানের মাধ্যমে বাইরের উদ্দীপক ভেতরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, নবজাত ভূমিষ্ঠ শিশু প্রথমে কানে শুনে। চোখ থাকা সত্ত্বেও সে কিছু দেখতে পায় না। অবশ্য ২/১ দিন পর কিংবা একটি নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পর শিশুর চোখে দেখার কাজ শুরু হয়। সম্ভবতঃ কুরআন নিম্নোক্ত আয়াতে চোখের আগে কানের উল্লেখ করে এই সৃষ্টি রহস্য এবং কানের গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন: ‘নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তরকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।’ (সূরা বনী ইসরাঈল: ৩৬)। কানের রোযা বলতে বুঝায় বাজে গান-বাজনা না শুনা এবং মন্দ, খারাপ ও অশ্লীল কথা যেন কানে প্রবেশ না করে সে জন্য চেষ্টা করা। নেক লোকেরা ভাল কথা ভালভাবে শুনেন এবং খারাপ কথা কিংবা আল্লাহর অসন্তোষজনক কথা তারা শুনেন না। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সিয়ামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য উপলব্দি করেই সিয়াম পালন করার তাউফীক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।
লেখক, ইমাম ও খতীব কুদরত উল্লাহ মসজিদ, সিলেট।