দৃষ্টি নন্দন পাগলা রায়পুর বড় মসজিদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ এপ্রিল ২০২১, ৭:২১:১২ অপরাহ্ন
তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ, সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জ-সিলেট আঞ্চলিক সড়কের পাশে মহাশিং নদীর কুল ঘেঁষে পাগলাবাজার রায়পুর গ্রামে আপন মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে পাগলা রায়পুর বড় মসজিদ। মসজিদটি নির্মাণে মূল্যবান পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। সে জন্য দৃষ্টিনন্দন এই প্রাচীন নিদর্শনটির আজও সৌন্দর্যের কমতি নেই। প্রথম দেখায় যে কেউ এর প্রেমে পড়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবেন। মসজিদটিকে এক নজর দেখতে মানুষের ভীড় জমে চোখে পড়ার মত।
শত বছরের ঐতিহ্য দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পশ্চিম পাগলার রায়পুর গ্রামে অবস্থিত এই মসজিদটি। স্থানীয়ভাবে বড় মসজিদ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক এ মসজিদটি নির্মণের পিছনে রয়েছে নানান ঘটনা। দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকলা ও প্রবাহমান মহাশিং নদীর এক বাক সংলগ্ন ক‚লে দাঁড়িয়ে যেনো সভ্যতার ক্রমবিকাশ পর্যবেক্ষণ করছে এই মসজিদ। মসজিদের সামনে বিশাল ঈদগাহ ময়দান ও উত্তরপার্শ্বের গেট দিয়ে প্রবেশ করে সামনেই দেখবেন মহাশিং নদী। এই মসজিদের ভিতরের রূপ দেখার জন্য প্রতিদিনই মানুষ ছুটে আসেন। ভিতরে প্রবেশ করা মাত্রই ফ্লোর ও তার আশপাশের কারুকার্য দেখলে আশ্চর্য প্রায় তাজমহল ভেবে নিবেন যে কেউ। তবে নামাজের জন্য নির্ধারিত মূল স্থান দু’তলায়। মসজিদের মেহরাব অংশে জমকালো পাথর কেঁটে আকর্ষণীয় ডিজাইন তোলা হয়েছে। পুরো মসজিদের চারপাশে তিনফুট উচ্চতা পর্যন্ত যে কারুকার্য খচিত টাইলস লাগানো হয়েছে সেটাও উঁচুমানের স্থাপত্যশৈলীর ইঙ্গিত দেয়। টাইলস গুলো আনা হয়েছিল ইতালি, জার্মানি ও ইংল্যান্ড থেকে। প্রত্যেকটা প্রবেশদ্বারে পাথরখচিত খিলান মসজিদটিকে বেশ দৃষ্টিনন্দন করে তোলেছে। মসজিদের নিচতলার ছাদ ঢালাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে রেলের ¯িøপার। ছাদ ও গম্বুজের চারপাশে পাথর খোদাই করা পাতার ডিজাইন গ্রামীণ ঐতিহ্যের জানান দেয়। মসজিদের দু’তলার মেঝেতে রয়েছে দুর্লভ শ্বেতপাথর, তার চারপাশে বøকে দেয়া বø্যাক স্টোন বা কালোপাথর যেটি আরো বেশি দুর্লভ। এগুলো আনা হয়েছিল ভারতের জয়পুর থেকে। তখনকার অবিভক্ত ভারতের সাথে নদীপথের যোগাযোগই সহজ ছিল। মসজিদে ব্যবহৃত এই জাতের পাথর একমাত্র তাজমহলে ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানা যায়।
মসজিদটি নদীর ক‚ল ঘেঁষে নির্মিত হওয়ায় ডেকার হাওরের পূবালী বাতাস সবসমই মসজিদের ভিতর প্রবেশ করে। এবং মুসল্লিরা সবসময়ই একটা তাপমাত্রাবান্ধব অনুভ‚তি পান নামাজের সময়। যেন স্বর্গীয় অনুভূতি অনুভব করা যায়। তাছাড়া আশ্চর্য্যরে বিষয় হচ্ছে দ্বি-তলা বিশিষ্ট এই স্থাপনাটিতে কোনো ধরনের রডের ব্যবহার ছাড়াই সম্পূর্ণ ইটের উপর নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদটি ৬৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও বারান্দাসহ ২৫ ফুট প্রস্থের গম্বুজসহ মোট উচ্চতা ৪০ ফুট ও ছয়টি স্তম্ভের উপর ছয়টি মিনার, তিনটি বিশাল গম্বুজ এবং ছোট সাইজের আরও বারটি মিনার রয়েছে। মসজিদের ভ‚মিকম্প নিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে ভ‚মি খনন করে বেশ মজবুত পাতের উপর স্থাপনাটির ভিত নির্মিত হয়েছে। ফলে অনেকগুলো বড় মাপের ভ‚মিকম্পও এখন পর্যন্ত মসজিদটিতে ফাটল ধরাতে পারেনি। মসজিদ নির্মাণের পর এখনও বড় ধরনের কোনো সংস্কারের প্রয়োজন পড়েনি। অবশ্য কেবল গম্বুজের এক জায়গায় খানিকটা লিকেজ দেখা দিয়েছিল আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে। তখন গম্বুজের উপরের দিকের কিছু পাথর পরিবর্তন করতে হয়েছিল। বিশেষজ্ঞ স্থপতিদের তত্বাবধানে বেশ সতর্কতার সাথে সংস্কার কাজ সম্পাদন করা হয়েছে, যাতে মূল গঠনে কোনরূপ পরিবর্তন না ঘটে।
মসজিদের নির্মাণ সালের কথা ও রহস্যে: ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ৫ই আশ্বিন শুক্রবার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদের। মসজিদের মূল প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসিন মির্জা ও তাঁর ভাই ইউসুফ মির্জা মিলে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। নির্মাণকাজে মূল মিস্ত্রিসহ জোগালিরা ছিলেন ভারতীয় ও মূল স্থপতির নাম ছিল মুমিন আস্তাগার। যার পূর্বপুরুষ ভারতের তাজমহলে কাজ করেছেন বলে জানা যায়। এই মসজিদে প্রায় দশ বৎসর যাবত নির্মাণকাজ চলে। মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসিন মির্জা ও তাঁর ভাই ইউসুফ মির্জা বেশ বিত্তবান এবং ধর্মপরায়ণ ছিলেন। পাশাপাশি চাষাবাদ ও খামারের বিশাল সম্পত্তির মালিক ছিলেন তারা। মসজিদ নির্মাণের পিছনে মূল কারণ কী ছিলো? এ সম্পর্কে জানতে চাইলে লোকমুখে নানান জনশ্রæতি রয়েছে। কেউ বলছেন, মহাশিং নদী থেকে অলৌকিকভাবে ৭টি গুপ্তধন পানিতে ভেসে উঠেছিলো। আর এগুলো ইয়াসিন মির্জা ও তাঁর ভাই ইউসুফ মির্জা ধার্মিক হওয়ার কারনে সেগুলো দেখেছিলেন। এবং নিজেদের কাছে সেগুলো রাখেন। পরে স্বপ্নের মাধ্যমে দেখতে পেলেন এগুলো দিয়ে যেন তারা নদীর পাড়ে মসজিদ নির্মাণ করেন। তাই আনেকে মনে করছেন এখান থেকেই এই মসজিদের সূচনা হতে পারে। তবে ইয়াসিন মির্জার পরিবারের সূত্রে জানা যায়-ইয়াসিন মির্জার পিতা আদিল হাজী ছিলেন বেশ ধার্মিক। তখনকার সময়ে এই এলাকায় মুসলমানরা ছিলেন সংখ্যায় কম। পুরো পরগনার মধ্যে তিনিই একমাত্র হাজী ছিলেন। আদিল হাজীকে সবাই পায়ে হেঁটে হজ্বপালনকারী হিসেবে জানতো। ধর্ম-কর্মের প্রতি তাঁর অগাধ মনোনিবেশ থেকে তিনি বর্তমান মসজিদের জায়গাটিতে একটি টিনশেড ঘর তৈরি করেন। নামাজের জন্য। আশপাশের গ্রামের মুসলমানরাও এখানে এসে নামাজ আদায় করতেন। পরম্পরাগত ঐতিহ্যের সূত্র ধরেই ইয়াসিন মির্জার মসজিদ নির্মাণের স্বপ্ন জাগে। যে ব্যাপক স্থাপত্য নকশা তিনি হৃদয়পটে এঁকেছিলেন, তাতে মসজিদের নিচতলায় হিফজখানা আর উপরের তলায় নামাজের স্থান নির্ধারিত ছিলো। মসজিদের বাহিরের অংশকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় করার অভিপ্রায় ছিল ইয়াসিন মির্জার। বাহিরের অপরূপ শৈলী যেনো সর্বসাধারণকে মসজিদে আসতে উদ্বুদ্ধ করে এমন প্রত্যাশা ছিলো তাঁর মন-মগজে। কিন্তু সে স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়নের মুখ দেখার আগেই তার সময় চলে আসে পৃথিবী থেকে বিদায়ের। আর এতেই আটকে যায় মসজিদের পরবর্তী সকল কাজ। এ কারণে বাইরের নকশা আর বাস্তবায়িত হয়নি। তবে তিনি ওসীয়ত করে যান তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী মসজিদের কাজ পুরোপুরি বাস্তবায়িত করার আগে যেন তাঁদের কবর, এমনকি ঘরবাড়ী পর্যন্ত পাকা করা না হয়। কিন্তু সেটুকু আর হয়ে ওঠেনি। দু’ ভাইয়ের কবরও আজ পর্যন্ত কাঁচা বেড়া-বাউন্ডারীহীন রয়ে গেছে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনটি এখনও সরকারের প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তরের দৃষ্টিতে আসেনি। স্থাপত্য কীর্তিটি এখনও উল্লেখযোগ্যভাবে সরকারী আনুক‚ল্য পায়নি।
মসজিদের উদ্যোক্তা ইয়াসিন মির্জার প্রপৌত্র মনজুর হায়দার বলেন, প্রাচীন এই নিদর্শনটি অবহেলিত ও সরকারের নজরহীন। যদি এই প্রতœতাত্তি¡ক ও ঐতিহাসিক নিদর্শনটি সরকারের দৃষ্টিগোচর হয় তাহলে এই মসজিদটি পর্যটকদের জন্য অন্যন্য স্থান হতে পারে। সরকার যেন অতিদ্রæত এর সৌন্দর্য্য ধরে রাখতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন সে জন্য তিনি সরকাররের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে আহবান জানান।