দারিদ্র্য গ্রাস করছে কোটি মানুষকে
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ এপ্রিল ২০২১, ৮:৩৫:১০ অপরাহ্ন
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর যৌথ গবেষণায় জানা গেছে, মহামারির এ সময়ে দেশে নতুন করে আরো দেড় কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে।
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, করোনা দুর্যোগের সময় ৩ শতাংশ শ্রমিক চাকরী হারিয়েছেন। শহর অঞ্চলে ইনফরমাল ইকোনোমি থেকে ৬.৭৮ শতাংশ মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে। এছাড়া উচ্চ পর্যায়ে ১ কোটি ১১ লাখ থেকে ২ কোটি ৫ লাখ মানুষ চাকরী হারিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী চাকরী হারিয়েছেন এসএমই এবং ইনফরমাল সেক্টর থেকে। এতে আরো বলা হয়েছে, দেশে দারিদ্র ক্রমশ: বাড়ছে। যেখানে শ্রমনির্ভর দারিদ্র্য বেশী। এ হার ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৩ শতাংশ হয়েছে। অতিমারির প্রভাবে এ তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ।
বলাবাহুল্য, মহামারির তা-বে বিশ্বের উন্নত ও শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলো যখন অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রাণপন চেষ্টা চালাচ্ছে তখন বাংলাদেশ সরকারকে এ ব্যাপারে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না। দেশে সুনামীর মতো দারিদ্র যখন আঘাত হানতে উদ্যত হয়েছে, তখন অনেকটা নিরোর মতো বাঁশি বাজাতে দেখা যাচ্ছে।
সরকার যে দেশের মানুষের আর্থিক দুর্ভোগের ব্যাপারে উদাসীন, এর জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে, দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের আর্থিক দুর্ভোগের কথা বিবেচনা না করে কিংবা তাদের আর্থিক সহায়তার কোন ব্যবস্থা না করেই লকডাউন ঘোষণা। গত ক’দিনের লকডাউনে দরিদ্র মানুষ যখন অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে তখন আরেক দফা লকডাউনের চিন্তাভাবনা করছে সরকার।
এখানে একটা কথা বলে রাখা আবশ্যক, অর্থনীতির ওপর যখন কোন আঘাত আসে তখন সেটা পুরোমাত্রায় অনুভূত হতে কিছুটা সময় লাগে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমানে লকডাউনের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি অনুভূত হতে কিছু সময় লাগবে। আরো কিছুদিন পর বুঝা যাবে কী ক্ষতি হয়ে গেলো কিংবা ক্ষয়ক্ষতি কতোটা গভীর ও সুদূর প্রসারি। উপরের গবেষণায় মহামারির দরুণ এসএমই অর্থাৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বেশী ক্ষয়ক্ষতির কথা বলা হয়েছে। দেখা গেছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা, যাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে হয়, তাদের ঋণের বোঝা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে লকডাউন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, রাস্তার পাশে ভ্যানগাড়িতে যে লোকটি আঙ্গুর, কলা কিংবা আপেল বিক্রি করে, সেও ঋণ নিয়ে কিংবা বাকীতে ফলমূল কিনে এনে বিক্রি করে। কিন্তু লকডাউনের ফলে তার বেচাবিক্রি কমে গেছে। এখন প্রতিদিনের অন্য সংস্থানের পাশাপাশি আগের ঋণ পরিশোধ এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে কর্মসংস্থান হারাচ্ছে মানুষ। আয় কমে যাচ্ছে কোটি মানুষের। কিন্তু এদের ব্যাপারে সরকারের কোন পরিকল্পনা নেই। পরিকল্পনা যা হচ্ছে শুধু বড়ো বড়ো কলকারখানা শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের জন্য। সকল সরকারী ঋণ, ঋণ মওকুফ ও প্রণোদনা ওপর পর্যায়েই। অথচ দেশের অধিকাংশ মানুষ অপ্রতিষ্ঠানিক খাত এবং এসএমই-এর সাথে সম্পৃক্ত। আর এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতই এখন সবচেয়ে অবহেলিত।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, বর্তমানে দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং এসএমই খাতে কতো লোক সম্পৃক্ত, তাদের সঠিক কোন তথ্য উপাত্তও সরকারের কাছে নেই। তাই চাইলেও সুষ্ঠু এ মুহূর্তে তাদের কাছে আর্থিক সহায়তা কিংবা প্রণোদনা পৌঁছানো সম্ভব হবে না। এমন অদ্ভুত পরিকল্পনাহীন ও পরিসংখ্যানের দেশ খুব কমই আছে। দেখা গেছে, এশিয়া ও ইউরোপের উন্নত দেশগুলো লকডাউনের আগেই তাদের জনগন এবং ব্যবসায়ীদের কাছে করোনা সহায়তা তহবিলের অর্থ পৌঁছে দিয়েছে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির একাউন্টে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্থ চলে গেছে। এতে এসব দেশের সাধারণ মানুষ যেমন লকডাউনের সময় আর্থিক দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেয়েছে, তেমনি শিল্প উদ্যোক্তারাও তাদের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে। এসব দেশের সরকার দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির স্বার্থেই এমনটি করেছে। এছাড়া মহামারির ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য নানা স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে তারা।
ইতোমধ্যে প্রধান খাদ্যপন্য চালসহ প্রায় প্রতিটি নিত্যপন্যের দাম এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। স্বল্প আয়ের কোটি কোটি মানুষের রীতিমতো নাভিশ্বাস ওঠেছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছেনা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় কিংবা বিভাগগুলোকে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনগুলোতে দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে এমন আশংকা সচেতন মহলের। এ অবস্থায় আশু অবসান প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কে করবে এর সুরাহা?