আহলান সাহলান মাহে রমজান
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ এপ্রিল ২০২১, ১১:৪৮:৪৪ অপরাহ্ন
সাঈদ আল মাদানী: রমজান মাসে ফরজ সালাত ও রোজার পর সর্বোত্তম ইবাদত হলো রাত্রির সালাত এবং নফল নামাজের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতময় নামাজ হচ্ছে কিয়ামুল লাইল, যা তারাবীর সালাত হিসেবে পরিচিত।
রাতের সালাতের গুরুত্ব ও ফজিলত-
এক. রাতের সালাত রাসূল (সা.) নিয়মিত আমল ছিল, আল্লাহ তায়ালা তার রাসূলকে সম্বোধন করে বলেন, ‘আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় কর তোমার অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে। আশা করা যায়, তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।’ [সূরা বনি ইসরাঈল: ৭৯]। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা মওদুদী (র.) বলেন, ‘অর্থাৎ দুনিয়ায় ও আখেরাতে তোমাদের এমন মর্যাদায় পৌঁছে দেবেন যেখানে তোমরা মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়ে থাকবে। তোমাদের অস্তিত্ব দুনিয়ায় একটি প্রশংসনীয় অস্তিত্বে পরিণত হবে। আজ তোমাদের বিরোধীরা গালাগালি ও নিন্দাবাদের মাধ্যমে তোমাদের অভ্যর্থনা করছে এবং সারাদেশে তোমাদের বদনাম করার জন্য তোমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের তুফান সৃষ্টি করে রেখেছে। কিন্তু সে সময় দূরে নয় যখন সারা দুনিয়ায় তোমাদের প্রশংসা শ্রুত হবে এবং আখেরাতেও তোমরা সমগ্র সৃষ্টির প্রশংসার অধিকারী হবে। কিয়ামতের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফায়াতকারীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়াও এ প্রশংসনীয় মর্যাদারই একটি অংশ। (তাফহীমুল কুরআন, খন্ড. ২, পৃষ্টা. ১৫৯, আধুনিক প্রকাশনী)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের সালাতের জন্য খুব পরিশ্রম করতেন, এমনকি তার পা মুবারক ফেটে যেত। তিনি রাতের কিয়ামে প্রচুর কষ্ট করতেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে এত কিয়াম করতেন যে, তার দু’পা ফেটে যেত। আয়েশা তাকে বললেন: হে আল্লাহর রাসূল আপনি কেন এরূপ করেন, অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সব গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন? তিনি বললেন: ‘আমি কি আল্লাহর শোকর গুজার বান্দা হতে পছন্দ করব না!” (সহিহ আল বুখারী)।
দুই. কিয়ামুল লাইল আল্লাহ তাআলা রহমানের বান্দাদের গুণাগুণ। আল্লাহ তায়ালা তাদের সম্পর্কে বলেন: “আর যারা তাদের রবের জন্য সিজদারত ও দ-ায়মান হয়ে রাত্রিযাপন করে।’ [সূরা ফুরকান: (৬৪)]। অন্যত্র তিনি মুত্তাকীদের গুণাগুণ আলোচনায় বলেন: ‘রাতের সামান্য অংশই এরা ঘুমিয়ে কাটাত। আর রাতের শেষ প্রহরে এরা ক্ষমা চাওয়ায় রত থাকত।’ [সূরা যারিয়াত: ১৭-১৮]।
তিন. কিয়ামুল লাইলের বিনিময়স্বরূপ তাদের জন্য জান্নাতে চোখ জুড়ানো নেয়ামত লুকিয়ে রাখা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে বলেন: ‘তাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে আলাদা হয়। তারা ভয় ও আশা নিয়ে তাদের রবকে ডাকে। আর আমি তাদের যে রিযক দান করেছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে। অতঃপর কোন ব্যক্তি জানে না তাদের জন্য চোখ জুড়ানো কি জিনিস লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তারা যা করত, তার বিনিময়স্বরূপ।’ [সূরা সেজদাহ: ১৬-১৭]।
চার. কিয়ামুল লাইল জান্নাতে যাওয়ার একটি উপায়। আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করেন, তখন লোকেরা তার দিকে ছুটে গেল। আর চারদিকে ধ্বনিত হল: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করেছেন তিনবার। আমি মানুষের সাথে তাকে দেখতে আসলাম। আমি যখন তার চেহারা ভালভাবে দেখলাম, পরিষ্কার বুঝলাম তার চেহারা কোন মিথ্যাবাদীর চেহারা নয়। আমি সর্বপ্রথম তাকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: ‘হে লোকেরা, তোমরা সালামের প্রসার কর, খাদ্য দান কর, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখ ও রাতে সালাত আদায় কর যখন মানুষের ঘুমিয়ে থাকে, তাহলে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সুনানে তিরমিযি)।
পাঁচ. রাতে সালাত আদায়কারীদের জন্য জান্নাতের উঁচু প্রাসাদসমূহ তৈরি করা হয়েছে। আবু মালেক আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘নিশ্চয় জান্নাতে কিছু বালাখানা রয়েছে, যার বাইরে ভেতর থেকে ও ভেতর বাইরে থেকে দেখা যাবে। যা আল্লাহ তৈরি করেছেন তাদের জন্য যারা খাদ্যদান করে, বিনয়াবনত কথা বলে, সিয়ামের পর সিয়াম পালন করে, সালামের প্রসার করে এবং রাতে সালাত আদায় করে যখন লোকেরা ঘুমিয়ে থাকে।’ (মাজমাউজ জাওয়াইদ)।
ছয়. রাতের সালাত গুনাহের কাফ্ফারা ও পাপ মোচনকারী। আবু উমামা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমরা রাতের সালাত আঁকড়ে ধর, কারণ এটা তোমাদের পূর্বের নেককার লোকদের অভ্যাস এবং তোমাদের রবের নৈকট্যদানকারী, গুনাহের কাফ্ফারা ও পাপ মোচনকারী।’ (সুনানে তিরমিযি)। তাহলে আসুন আমরা রমজানের প্রত্যেক বরকতময় রজনীতে কিয়ামুল লাইলের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন করি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তাউফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ইমাম কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদ, সিলেট।