করোনাকালীন প্রাসঙ্গিক ভাবনা
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ এপ্রিল ২০২১, ৫:৩১:১৯ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ শামছ উদ্দিন
“সুগভীর তটিনী আমি; / বহে চলার শব্দ মম ক্ষীণ,/ অগভীর প্রমত্তা তুমি; / দু’কূল কাঁপিয়ে বাজাও বীণ।”
বিনয় ও শ্রদ্ধার সাথে বলছি, দীর্ঘ দুই যুগ স্বেচ্ছানির্বাসনের পর লেখালেখির জগতে ফিরে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম জগতটা বদলেছে। এ জগতের মানুষের চিন্তা, চেতনা ও মননে হয়তো পরিবর্তন এসেছে। দেখি আগে যেখানে কিলবিল করতো অসংখ্য ছোট-বড় সাপ, সেখানে এখন প্রকাণ্ড অজগর ও কোবরা বাসা বেঁধেছে। হিংসা, বিভাজন, হীনমন্যতা, আর আত্মশ্লাঘায় ভরপুর স্বঘোষিত রবীন্দ্র-নজরুলে ছেয়ে আছে বাংলার সাহিত্যাঙ্গন।
অপড়ুয়া কিছু জ্ঞানপাপী চর দখলের মতো আগ্রাসী মনোভাব ও শব্দভূক কিছু পদ্য-গদ্য ব্যবসায়ীর বাণিজ্যিক ও ক্ষণস্থায়ী খ্যাতির মোহ ধ্বংস করে দিচ্ছে সাহিত্য জগত। আশার আলো-দুই বাংলার আনাচে কানাচে জেগে উঠেছে সাহিত্য প্রেমিকদের দল। তৈরি হয়েছে অসংখ্য অনলাইন সাহিত্য গ্রুপ। অকুন্ঠ চিত্তে প্রমোট করছে সৃজনশীলতাকে। এ সমস্ত উদ্যোগে সবাইকে সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নাও হতে পারে এবং বাস্তবিকভাবে সেটা সম্ভব ও নয়। লেখালেখির গুণগত মান রক্ষা করা ও কঠিন। তবুও এ সব উদ্যোগ কে সাধুবাদ জানাই।
কারণ লেখালেখির কুক্ষিগত এ জগতে ‘a period of stagnation’ চলছিলো। এরা স্ফুলিঙ্গ জাগিয়ে দিয়েছে। “It is purely the New Restoration Period of Bengali Literature in this ‘Digital Industrial Revolution.” সাহিত্যের মান যাচাইয়ের একটি জায়গা তৈরি হয়েছে। কেউ এখন Plagiarism (চৌর্যবৃত্তি) করে রেহাই পাবে না। অনলাইনের জ্ঞানসমুদ্রে সবকিছুই এখন প্রতুল। যে কথা বলছিলাম, পৃথিবী জুড়ে গঠিত হয়েছে হাজার হাজার কবিতা ও সাহিত্য সংগঠন, অনলাইন ম্যাগাজিন, নিউজ পেপার, যেগুলো জায়গা করে দিচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব মেধাবী ও প্রতিভাবান লেখকদের। এদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে একদিন প্রকৃত ‘কাদা-মাটি-সুধাগন্ধ-মাখা’ বাংলার সাহিত্য।
একদিন আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে এ সব স্বঘোষিত হুতুম পেঁচার দল। মনে রাখতে হবে ক্ষমতার জল উপর থেকে হয়তো গড়ায় কিন্তু বৃক্ষের মূল মাটির নিচেই থাকে। “মানুষের ভাবনার জগতে পচন ধরেছে। ভাবনা পচে গেলে গন্ধ পাওয়া যায়না। সমাজ পচে গেলে গন্ধ পাওয়া যায়না। পচনশীল সাহিত্য, সংস্কৃতি ও কবিতা। পচনশীল আমার প্রিয় স্বদেশ। পচনশীল আমার পৃথিবী। এ সব পচে গেলে গন্ধ পাওয়া যায়না। মানুষ পচে গেলে গন্ধ পাওয়া যায়।” জ্ঞান অন্বেষণ ও চর্চার জায়গাগুলো ও আজ কলুষিত। জ্ঞান অন্বেষণ করবেন? জ্ঞান চর্চা করবেন? বাদ দেন। জ্ঞানের রাস্তার প্রবেশ দ্বারে চেয়ার নিয়ে বসে আছেন
‘জ্ঞানভারে ন্যুব্জ’ একদল জাতীয় ও সুবিধাভোগী কুপমন্ডকের দল। পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞানের উৎস তাদের কর্তৃত্ববাদের ‘Spider Web’ এ আষ্টেপৃষ্ঠে ঘেরা। উৎপাদন যন্ত্র Means of Production) ও ‘Super Structure’ তাদের জালে বন্দি। সুতরাং, হে জ্ঞান পিপাসু, পথ তব বন্ধ। বিশেষ পাস ছাড়া প্রবেশ নিষিদ্ধ। বিশেষ পাস নিয়ে ঢুকেন। দেখবেন ‘Vanity Fair’ !” বেলুনের আবরণে বড়জোর কয়েক গ্লাস পানি আটকে রাখা যায়। নুড়িপাথর আর বালুকণা দিয়ে ছোট্ট জলরেখা কে আটকানো যেতেও পারে। কিন্তু সমুদ্রকে নয়। সে সবকিছু ভাসিয়ে মহাসমুদ্রের দিকে পা বাড়াবেই। বেলুন কিংবা বালুকণার স্তুপ দিয়ে তাকে আটকানো যায়না। যাবেনা। প্রতিভা মহাসমুদ্রের মতো। তাকে দাবিয়ে রাখার অনন্ত ক্ষমতা তোমাকে দেয়া হয়নি, হে মানব।
সে সিন্দুকের ভেতর থেকে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ হয়ে এক লক্ষ বছর পরে হলেও বের হবেই। সুতরাং, হে মানব সন্তান, প্রদত্ত ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার করো। যেমনি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তেমনি ছিনিয়ে নেয়া হতে পারে। জীবনই যদি ক্ষণস্থায়ী হয় তাহলে ক্ষমতার স্থায়িত্ব Tiny Dot এর মতো। পরিমাপযোগ্যই নয়। “বাংলা সাহিত্যের হিমালয় নজরুল-রবীন্দ্রনাথসহ অন্যান্য দিকপাল যারা আছেন তাদের দিয়েই সাহিত্য বেঁচে থাকবে কালান্তর। তাই হিমালয়ের পাদদেশে পাতাকুড়ানী কবিদলকে লিখতে হবে আমরণ। অযথা নিজেকে হিমালয় ভেবে হাস্যকর হওয়া কবি হিসেবে চরম দীণতার পরিচয়।
সাহিত্য-চর্চা-জ্ঞানহীন এ সব হুতুম পেঁচার মহাজ্ঞানী সাজার ভান দেখে সাহিত্য লজ্জা পায়।” “কে কখন কোথায় কিভাবে ফোঁটবে, তুমি তা জানো না। আজকের মহামান্য রাষ্ট্রপতি এম এ হামিদ। যাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি-ফর্ম দেয়া হয়নি। প্রকৃতি তাঁকে দেশের সব কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বানিয়ে দিয়েছে। আত্ম-শ্লাঘায় ভোগা এক দল মহামানুষে ভরে গেছে পৃথিবীর জঙ্গল। হে জ্ঞানী, জ্ঞান কে সম্মান করতে শিখুন প্রথমে। তারপর জ্ঞানী কে। জ্ঞানী বিপথু হয়। জ্ঞান নয়।’
লেখক: ভাষা গবেষক ও কলামিস্ট