আহলান সাহলান মাহে রমজান
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ এপ্রিল ২০২১, ১১:৩৯:৩২ অপরাহ্ন
সাঈদ আল মাদানী: প্রত্যেক ইবাদাত পালনেরই কিছু নিয়ম বা পদ্ধতি রয়েছে। বিশেষ করে কিয়ামুল লাইলের বিশেষ কিছু সুন্নাত বা আদব রয়েছে যা আমল করলে অনেক সওয়াবের আশা করা যায়। কিয়ামুল লাইলের আদাব বা সুন্নাতগুলো হলো-
এক. প্রতিদিন ঘুমের সময় কিয়ামুল লাইলের নিয়ত করা। আর ঘুমের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ইবাদাতে শক্তি অর্জন করা, তাহলে ঘুমেও সওয়াব হবে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এমন কোন ব্যক্তি নেই, যার রাতে সালাত আদায়ের অভ্যাস ছিল, অতঃপর তার ওপর ঘুম প্রবল হল, আল্লাহ তার জন্য অবশ্যই সালাতের সওয়াব লিখবেন, আর তার ঘুম হবে তার জন্য সদকা’। (আবু দাউদ)।
দুই. জাগ্রত হয়ে হাত মলে চেহারা থেকে ঘুম দূর করা, আল্লাহর জিকির করা ও মিসওয়াক করা, কারণ উবাদা ইব্ন সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে ঘুম থেকে আড়মোড়া দিয়ে উঠে বলল: অতঃপর সে বলল: হে আল্লাহ আমাকে মাফ কর, অথবা দোয়া করল, তার দোয়া কবুল করা হবে।’ (সহিহ্ আল বুখারী)। ইব্ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাগ্রত হয়ে হাত দ্বারা চেহারা থেকে ঘুম মুছতে ছিলেন, অতঃপর সূরা আলে-ইমরানের শেষ দশ আয়াত তিলাওয়াত করলেন…’। (সহিহ্ আল বুখারী)। হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে যখন ঘুম থেকে উঠতেন, মিসওয়াক দ্বারা তার মুখ দাঁতন করতেন’। (সহিহ্ আল বুখারী)।
তিন. কিয়ামুল লাইলের সর্বোত্তম সময় রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আদায় করা। রাতের সালাত রাতের শুরু, শেষ ও মধ্যখানে আদায় করা বৈধ, তবে উত্তম হচ্ছে শেষ তৃতীয়াংশ। আমর ইব্ন আবাসা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন: ‘রাতের শেষ ভাগে বান্দা তার রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়, যদি তুমি সে সময়ে আল্লাহর যিকিরকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পার, তাহলে তাদের অন্তর্ভুক্ত হও’। (সুনানে তিরমিযি)। এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিস দ্বারা, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আমাদের রব প্রতি রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন, যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ বাকি থাকে। অতঃপর তিনি বলেন: কে আমাকে আহ্বান করবে, আমি যার ডাকে সাড়া দেব? কে আমার নিকট প্রার্থনা করবে, আমি যাকে প্রদান করব? কে আমার নিকট ইস্তেগফার করবে, আমি যাকে ক্ষমা করব? ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত অনুরূপ বলতে থাকেন”। (সহিহ আল বুখারী ও মুসলিম)।
চার. হালকা দু’রাকাত সালাত দ্বারা তাহাজ্জুদ আরম্ভ করা। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ও কর্ম দ্বারা অনুরূপ প্রমাণিত হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন রাতে সালাত আদায়ের জন্য উঠতেন, তিনি হালকা দু’রাকাত সালাত দ্বারা তার সালাত আরম্ভ করতেন”। (সহিহ্ মুসলিম)।
পাঁচ. ঘরে তাহাজ্জুদ আদায় করা মোস্তাহাব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। যায়েদ ইব্ন সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমরা ঘরে সালাত আদায় কর, কারণ ব্যক্তির উত্তম সালাত হচ্ছে তার ঘরে ফরজ ব্যতীত’। (সহিহ্ আল বুখারী)। কখনো কখনো জামাতের সাথে রাতের নফল আদায় করা বৈধ। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামাতের সাথে ও একলা সালাত আদায় করেছেন, তবে তার অধিকাংশ নফল সালাত ছিল একলা।
ছয়. নিয়মিত কিয়ামুল লাইল আদায় করা, কখনো ত্যাগ না করা। নির্দিষ্ট সংখ্যক রাকাত নিয়মিত পড়া মোস্তাহাব। যদি শরীর চাঙ্গা ও মন প্রফুল্ল থাকে, তাহলে দীর্ঘ কিরাত করবে, অন্যথায় হালকা কিরাতে সালাত আদায় করবে, আর কখনো ছুটে গেলে কাযা করবে। আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন: “হে আব্দুল্লাহ তুমি অমুকের মত হয়ো না, সে রাতে কিয়াম করত, কিন্তু সে তা ত্যাগ করেছে”। (সহিহ্ আল বুখারী)।
সাত. রাতের সালাতের জন্য স্ত্রীকে জাগ্রত করা মোস্তাহাব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে সালাত আদায় করতেন, যখন তিনি বেতের আদায় করতেন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বলতেন: “হে আয়েশা উঠ, বেতের আদায় কর”। [৪৭] আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ সে ব্যক্তিকে রহম করুন, সে রাতে উঠে সালাত আদায় করল, অতঃপর তার স্ত্রীকে জাগ্রত করল। যদি সে উঠতে না চায় তার চেহারায় পানির ছিটা দিল। আল্লাহ সে নারীর ওপর রহম করুন যে রাতে উঠে সালাত আদায় করল, অতঃপর তার স্বামীকে জাগ্রত করল, যদি সে উঠতে না চায় তার চেহারায় পানির ছেটা দিল”। (সহিহ্ আল বুখারী)।
আট. মনোযোগ ও বুঝে বুঝে যে পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত করা যায়, তাহাজ্জুদে সে পরিমাণ পাঠ করা: এক পারা বা তার চেয়ে অধিক বা তার চেয়ে কম। উচ্চ-অনুচ্চ যেভাবে ইচ্ছা পড়ার অনুমতি রয়েছে। হ্যাঁ যদি উচ্চ স্বরে তিলাওয়াত করলে পড়াতে প্রাণ আসে অথবা উপস্থিত লোকেরা শ্রবণ করতে পারে, অথবা অন্য কোন ফায়দা রয়েছে, তাহলে উচ্চ স্বরে পড়া উত্তম। আর যদি নিকটে কেউ তাহাজ্জুদ পড়ে, অথবা তার উচ্চ স্বরের কারণে কারো কষ্ট হয়, তাহলে আস্তে পড়া উত্তম। আর যদি অগ্রাধিকারের কোন কারণ না থাকে, তাহলে যেভাবে ইচ্ছা পড়বে। ( আল মুগনী)।
নয়. লম্বা কিরাতের সাথে অধিক রুকু সেজদা করা উত্তম রাতের সালাতে যদি কষ্ট অথবা বিরক্ত না লাগে। জাবের ইব্ন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:“লম্বা কুনুত বিশিষ্ট সালাত উত্তম”। (সহিহ্ মুসলিম)।
দশ. বেতের সালাত দ্বারা রাতের সালাতের শেষ করা। আব্দুল্লাহ ইব্ন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “বেতেরকে তোমাদের রাতের শেষ সালাত বানাও”। মুসলিমের বর্ণনায় এরূপ এসেছে, (আব্দুল্লাহ ইব্ন ওমর বলেছেন): “যে রাতে সালাত আদায় করে, সে যেন তার শেষ সালাত করে বেতেরকে ‘ফজরের পূর্বে’, কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুরূপ নির্দেশ করতেন”। (সহিহ্ আল বুখারী)। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কিয়ামুলল লাইলের আদাব ও সুন্নাহগুলি পালন করার তাউফিক দিন। আমিন।
লেখক: ইমাম কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদ, সিলেট।