মোবারক হো মাহে রমজান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ এপ্রিল ২০২১, ১১:৩৯:৪১ অপরাহ্ন
সাঈদ আল মাদানী: জাকাত ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির মধ্যে একটি। ঈমান ও সালাতের পরে জাকাত ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। অনেক ইবাদতই কুরআন কারীমে মাত্র ২/৪ বার উল্লেখিত হয়েছে, যেমন রোজা, হজ্জ ইত্যাদি। আবার কিছু ইবাদত অনেক বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। বারবার বলার অর্থ গুরুত্ব বুঝানো। সালাতের পরে সবচেয়ে বেশী জাকাতের কথা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। আজকের প্রবন্ধে জাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
জাকাত এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, পবিত্রকরণ, বৃদ্ধি হওয়া, বরকত ও প্রশংসা। ইসলামে জাকাত ফরজ করা হয় ২য় হিজরীতে। আল্লাহ তা’আলা কুরআনের বহু জায়গায় ইরশাদ করেছেন, ‘আর তোমরা নামাজ কায়েম কর, জাকাত আদায় করো এবং রুকু কর রুকুকারীদের সঙ্গে।’ (সূরা বাকারা : ৪৩)। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘লোকদের ধন-মাল থেকে জাকাত গ্রহণ কর, তার দ্বারা তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ কর এবং তাদের জন্যে কল্যাণের দেয়া কর। নিঃসন্দেহে তোমার এই দোয়া তাদের জন্য পরম সান্ত¡নার কারণ। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’। (সূরা তাওবা ১০৩)। জাকাত আদায়ের ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ সুদের বৃদ্ধিকে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করেন আর ‘সাদাকাহ’ বা জাকাতকে বৃদ্ধি করেন।” (সূরা বাকারা: ২৭৬ আয়াত)। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘এবং তোমরা মানুষের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য যে বৃদ্ধি (সুদ) প্রদান কর তা আল্লাহর নিকট বৃদ্ধি পায় না। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তোমরা যে জাকাত প্রদান কর সেই জাকাতই হল বহুগুণ বৃদ্ধিকারী।’ (সূরা রূম: ৩৯ আয়াত)। পক্ষান্তরে যারা জাকাত আদায়ে বা দিতে অস্বীকার করবে, নবী করীম (স) বলেছেন, ‘ওরা ওদের ধন-মালের জাকাত দিতে অস্বীকার করে আকাশ থেকে বৃষ্টিপাতকে বন্ধ করিয়েছে মাত্র। তারপরও অবশ্য কেবল জন্তু জানোয়ারের কারণেই বৃষ্টিপাত হয়। (ইবনে মাজা, বাজ্জার, বায়হাকী)। আমাদের সমাজে বলা হয়ে থাকে, কালেমা নামাজ রোজা হজ্জ জাকাত। তার মানে জাকাত ৫ নম্বরে! আমরা সাধারণত দ্বীনের সবচেয়ে বড় কাজ বুঝাতে বলি নামাজ-রোজা, কিন্তু কুরআনে কোথাও নামাজ-রোজা বলা হয় নি, সব সময় বলা হয়েছে নামাজ-জাকাত। রোজা হলো যাকাতের পরে। এই যে মিস কনসেপ্ট আমাদের সমাজে প্রচলিত। তার কারণ হল আমরা আসলে জাকাতের গুরুত্ব বুঝিনা। যার কারণে সিয়াম পালন করে কিন্তু জাকাত আদায় করেনা। অথচ আবু বকর (রা.) জাকাত আদায়ে অস্বীকারকারীদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে এখানে ঐতিহাসিক একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ইয়ামার বনু হানিফার লোকেরা রাসূলের ইন্তেকাল হয়ে যাওয়ার পর তারা জাকাত দিতে অস্বীকার করলে এই বলে যে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে জাকাত আদায়ের ব্যপারে রাসুলকে সম্ভোধন করে বলেছেন। সুতরাং তারা আবু বকরকে জাকাত দিবেনা। কারণ আবু বকরের দোয়া তো রাসূলের দোয়ার মত প্রশান্তির কারণ হবেনা। তারা সালাত পড়ত, সিয়াম পালন করত, জাকাত যে আল্লাহ ফরজ করেছেন এটাও বিশ^াস করত। কিন্ত তারা সূরা তাওবার ১০৩ নং আয়াতের অপব্যাখ্যা করে জাকাত দিতে অস¦ীকার করল। তখন আবু বকর বলেছিলেন, আল্লাহ শপথ! আমি অবশ্যিই যুদ্ধ করব সেই লোকের বিরুদ্ধে, যে নামাজ ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে। কারণ রাসূল (সা.) বলেন, ‘লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে আমি আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র সাক্ষ্য দেবে, নামাজ কায়েম করবে ও জাকাত দেবে। তারা যদি তা করে, তাহলে তাদের রক্ত আমার কাছ থেকে নিরাপত্তা পেয়ে গেল। তবে ইসলামের অধিকার আদায়ের জন্যে কিছু করার প্রয়োজন হলে ভিন্ন কথা। আর তার হিসাব-নিকাশ গ্রহণ আল্লাহ কর্তৃত্বাধীন। কেননা জাকাত হল ধন-মালের হক। আল্লাহর কসম, ওরা যদি একটা উষ্ট্রও দিতে অস্বীকার করে, যা রাসূল (স)-এর যামানায় তারা দিত, তা হলে আমি তাদের এই অস্বীকৃতির কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।’ (সহিহ্ আল বুখারী ও মুসলিম)। এ কথা শুনে হযরত উমর (রা) উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন: আল্লাহ শপথ! এ আর কিছু নয়, আল্লাহ তায়ালা আবূ বকরের অন্তরকে যুদ্ধের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। আমি বুঝতে পেরেছি, এটাই সত্য ও সঠিক সিদ্ধান্ত। জাকাতের গুরুত্ব অনুধাবনে এতটুকুই আমাদের জন্য যতেষ্ট। অত:পর জাকাত ফরজ হওয়ার পেছনে অসংখ্য হিকমত রয়েছে। ধনী-গরিবের মাঝে ভারসাম্য আনার জন্য মহান আল্লাহ জাকাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ দেখা যায় কিছু মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ছে, অর্থ-কড়ি ও ভোগ-বিলাসে মত্ত আছে এবং প্রাচুর্যের চূড়ান্ত শিখরে অবস্থান করছে আর কিছু লোক দারিদ্র সীমার একেবারে নিচে অবস্থান করছে। মানবেতর জীবন যাপন করছে। আল্লাহ এ ব্যবধান দূর করার জন্যই তাদের সম্পত্তিতে জাকাত ফরজ করেছেন। যাতে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান কমে যায় এবং ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর হয়। অন্যথায় দেশে বা সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ, ফিতনা-ফাসাদ ও হত্যা-লুণ্ঠন ছড়িয়ে পড়বে। বিঘিœত হবে সামাজিক শৃংখলা ও স্থিতি। ইসলাম সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। একজনের হাতে বিপুল অর্থ-সম্পদ জমা হওয়াকে ইসলাম পছন্দ করে না। ইসলাম চায় ধনী-গরিব সবাই স্বচ্ছন্দে জীবন যাপন করুক। তাই দরিদ্রের প্রতি লক্ষ্য করে যাকাতের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। তাই আসুন আমরা এই বরকতপূর্ণ রমজান মাসে যাকাতের মত অন্যতম ফরজ ইবাদাত পালনে সচেতন হই। আমাদের সম্পদে গরিবদের পাওনা বুঝিয়ে দেই। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তাউফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ইমাম, কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদ, সিলেট।