আল বিদা মাহে রমজান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ মে ২০২১, ১১:৩০:৫৭ অপরাহ্ন
সাঈদ আল মাদানী: ইসলামী ভ্রাতৃত্ব আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া একটি সামগ্রিক নেয়ামত। মাহে রমজানে মুসলিম উম্মাহর এক সাথে সিয়াম, সালাতুত্ তারাবী, সালাতুল ঈদসহ আরো অন্যান্য সকল ইবাদাত মুসলিম উম্মাহর পারস্পারিক ভ্রাতৃত্বেরই বহিঃপ্রকাশ হয়। তাই রমজান মাস আমাদের মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্বের প্রশিক্ষণ দেয়। ইসলাম ভাষা, বর্ণ, ভৌগলিক সীমারেখা, ধনী-গরীবের বৈষম্য ইত্যাদির ঊর্ধ্বে উঠে ইসলামি ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী। পবিত্র কুরআন মুসলমানদেরকে পরস্পরের ভাই বলে উল্লেখ করেছে এবং পরস্পরের মাঝে এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট রাখার আহ্বান জানিয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন কর যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।’ (আল-হুজুরাত: ১০)। আজকের প্রবন্ধে মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্বের সেই নিয়ে অধিকার নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
এক. একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিমকে শুধু আল্লাহর জন্য ভালোবাসবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকট শ্রেষ্ঠ আমল হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালোবাসা এবং শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কারো সাথে শত্রুতা রাখা’। (মুসনাদে আহমদ)। কারণ আল্লাহর জন্য পারষ্পারিক ভালোবাসা আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার মাধ্যম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এক ব্যক্তি তার এক ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে অন্য গ্রামে গেল। পথিমধ্যে আল্লাহ তা‘আলা তার কাছে একজন ফেরেশতা পাঠালেন। ফেরেশতা তার কাছে এসে বললেন, কোথায় চললে তুমি? বললেন, এ গ্রামে আমার এক ভাই আছে, তার সাক্ষাতে চলেছি। তিনি বললেন, তার ওপর কি তোমার কোনো অনুগ্রহ আছে যা তুমি লালন করে চলেছ? তিনি বললেন, না। তবে এতটুকু যে আমি তাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। তিনি বললেন, আমি তোমার কাছে আল্লাহর বার্তাবাহক হিসেবে এসেছি। আল্লাহ তোমাকে জানিয়েছেন যে তিনি তোমাকে ভালোবাসেন যেমন তুমি তাকে তাঁর জন্য ভালোবাসো।’ [সহীহ মুসলিম ও ইবন হিব্বান]। দুই. একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিম ভাইয়ের প্রতি স্বদাচারণ করা। রাসূল (সাঃ) উত্তম চরিত্র সম্পর্কে যতেষ্ট গুরুত্ব ও উৎসাহ প্রদান করেছেন যা সত্যিই একজন মুমিনকে আরও উজ্জিবীত করে তোলে। রাসূল (সাঃ) বলেন: “কেয়ামতের দিন যে সব আমল ওজন করা হবে তার মাঝে সবচেয়ে বেশি ওজনদার আমল হবে সৎ চরিত্র বা উত্তম আচরণ। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির উপর অসন্তুষ্ট যে অশালীন ও অসৎ চরিত্রবান”। (সুনানে আবি দাউদ)। তিন. একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিম ভাইয়ের প্রতি কোন ধরনের অন্যায় অচরণ না করা। মহান আল্লাহ, সুরা হুজুরাত-এর পরপর তিনটি আয়াতে হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হাক্ক সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করছেন। কোন বান্দা যেন কোন পুরুষ বা নারীকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ বা উপহাস না করে: হে মুমিনগণ! কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ না করে; হতে পারে যাদের বিদ্রুপ করা হচ্ছে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম, আর কোন নারী যেন অন্য নারীকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ না করে হতে পারে যাদের বিদ্রুপ করা হচ্ছে তারা বিদ্রুপকারিণীদের চেয়ে উত্তম। (আল-হুজুরাত, ৪৯/১১)। কোন বান্দা যেন অপর বান্দার দোষারোপ না করে এবং বিকৃত নামে না ডাকে: তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ কর না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ (বিকৃত) নামে ডেকো না; ঈমান আনার পর মন্দ নামে ডাকা ফাসেকী (গোনাহের) কাজ আর যারা এ ধরণের কাজ হতে বিরত না হয় তারাই জালিম। (আল-হুজুরাত, ৪৯/১১)। চার. এক মুসলিমের ওপর অপর মুসলিমের আরেকটি হক হলো তাকে সাধ্যমত সাহায্য করা। মুসলমানরা পরস্পরের মান-ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান, দুঃখ-কষ্টে অংশগ্রহণ, গঠনমূলক সমালোচনা, উপদেশ-নছীহত, একত্রে বসবাসসহ সার্বিক বিষয়ে পরস্পরের সহযোগী হবে এটাই স্বাভাবিক। আর এ ধরনের পরিবেশ তৈরীতে ভ্রাতৃত্বের কোন বিকল্প নেই। আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তুমি তোমার মুসলিম ভাইকে সাহায্য করো, চাই সে অত্যাচারী হোক কিংবা অত্যাচারিত। তখন এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, অত্যাচারিতকে সাহায্য করার অর্থ তো বুঝে আসল, তবে অত্যাচারীকে কিভাবে সাহায্য করব? তিনি বললেন, তুমি তার হাত ধরবে (তাকে যুলুম থেকে বাধা প্রদান করবে)।’ [সহিহ্ আল বুখারী ও বাইহাকী]। পারস্পরিক সহযোগিতার পুরস্কার সম্পর্কে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব কষ্টসমূহ থেকে কোনো কষ্ট দূর করবে কিয়ামতের কষ্টসমূহ থেকে আল্লাহ তার একটি কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে দুনিয়াতে ছাড় দেবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে ছাড় দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ তা‘আলা বান্দার সাহায্য করেন যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্য করে।’ [মুসলিম ও তিরমিযী]। তাই আসুন আমরা রমজান মাসে ইসলামি ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা করি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তাউফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ইমাম, কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদ, সিলেট।