পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান হত্যা : সাত মাস পর চার্জশীট : সন্তুষ্ট নন মা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ মে ২০২১, ১:৪৩:০৫ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার :
অবশেষে দীর্ঘ সাত মাস পর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে নিহত যুবক রায়হান আহমদ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। এতে পাঁচ পুলিশ সদস্যসহ মোট ৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া অভিযোগপত্রে ৬৯ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এরমধ্যে ৭ জন পুলিশসহ ১০ জন ১৬৪ ধারায় আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন।
বুধবার সকাল ১১টার দিকে ২২ পৃষ্টার অভিযোগপত্রসহ ১৯৬২ পৃষ্টার কেস ডকেটটি কোর্ট পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইন্সভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
বিষয়টি নিশ্চিত করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান জানান, আকবরের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত ডিভাইসগুলো অ্যানালাইসিস করে প্রাপ্ত তথ্য অভিযোগপত্রে দাখিল করা হয়। অভিযোগপত্রে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবনের দুটি ধারা রয়েছে জানিয়ে পুলিশের প্রসিকিউশন শাখার কর্মকর্তারা মামলাটি ভার্চুয়াল আদালতে উপস্থাপন করবেন।
অভিযুক্ত কারা : মামলার চার্জশিটে দেওয়া অভিযুক্তরা হচ্ছেন, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ বরখাস্ত এসআই আকবর হোসেন ভুঁইয়া, টু-আইসি এসআই হাসান আলী, এএসআই আশেকে এলাহী, কনস্টেবল হারুনুর রশীদ, কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস ও কথিত সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান। এদের মধ্যে কোম্পানীগঞ্জের নোমান ছাড়া বাকি সবাই কারাগারে রয়েছেন। এছাড়া ৫ জন কারাগারে থাকলেও অভিযোগপত্রে নোমানকে পলাতক দেখানো হয়েছে।
কি আছে অভিযোগপত্রে : ২২ পৃষ্টার অভিযোগপত্রে বলা হয়, ১১ অক্টোবর গোলাগঞ্জের প্রতারক সাইদুল শেখ ও রনি শেখ রাত ১টা ৪৫ মিনিটে কাস্টঘর সুইপার কলোনী থেকে ৪ পিস ইয়াবা ক্রয় করে। ক্রয়কৃত ইয়াবাগুলো আসল নয় তারা বুঝতে পারেন। এরপর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রায়হান আহমদ মারপিট করে সাইদুল শেখের কাছ থেকে মোবাইল ও ৯ হাজার ৭০০ টাকা নিয়ে যান। পরবর্তীতে মাশরাফিয়া রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সিয়েরা-৪ ও রোমিও-৪ এর কাছে সাইদুল শেখ ও রনি শেখ মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন।
পরে পুলিশ কাস্টঘরের সুলাই লালের ঘর থেকে রায়হানকে আটক করে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। এরপর পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই, পুলিশের সাথে খারাপ আচরণ করার অভিযোগ এনে রায়হানকে ফাঁড়িতে নিয়ে এসআই আকবর বেতের লাঠি দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে মারপিট করেন। এরপর ১১ অক্টোবর সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে ওসমানী মেডিকেলে রায়হানকে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য আসামীরা ভিকটিম রায়হানকে কাস্টঘরে ছিনতাকালে গণপিটুনিতে মারা গেছেন বলে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে এবং ঘটনার সংশ্লিষ্ট আলামত ধ্বংস করে।
এদিকে, বুধবার দুপুরে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইন্সভেস্টিগেশন (পিবিআই) সিলেটের সদরদপ্তরে চাঞ্চল্যকর রায়হান হত্যার সার্বিক বিষয় নিয়ে প্রেস ব্রিফ্রিং করেন পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান।
তিনি বলেন, পিবিআই রায়হান হত্যা মামলার তদন্তভার পাওয়ার পর মহানগর পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষ্য নেয়া, সাক্ষিদের জবানবন্দিসহ নানা বিষয় পর্যালোচনা করে অভিযোগপত্র প্রস্তুত করে। পিবিআই তদন্ত করার সময় রায়হানের সাথে কোন পুলিশ সদস্যদের শক্রতা ছিলো কিনা সে বিষয়টি তদন্ত করলে সত্যতা মিলেনি। সবার সাক্ষ্যগ্রহণ এবং রায়হান, আকবরসহ সংশ্লিষ্টদের মোবাইল ফোন আলাপ সংগ্রহ করেও আমরা এরকম কোনো প্রমাণ পাইনি। রায়হানকে নির্যাতনের সাথে পূর্ব বিরোধের কিছু পাওয়া যায় নি।
পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান আরো জানান, অভিযোগপত্রে আসামীদের বিরুদ্ধে ৩০২, ৫০১ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ এর ১৫(২), ১৫(৩) ধারায় অভিযোগও আনা হয়েছে। এই দুই আইনের একটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ও অপরটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবনের কথা উল্লেখ আছে। ফলে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের মৃত্যুদন্ডও হতে পারে।
সন্তুষ্ট নয় রায়হানের মা : পিবিআই’র পক্ষ থেকে এ অভিযোগপত্রকে যথাযথ উল্লেখ করা হলেও পুরো সন্তুষ্ট নয় রায়হানের পরিবার। চার্জশিট দাখিলের পর রায়হানের মা সালমা বেগম জানান, ‘আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট না। কারণ, চার্জশিটে যে পাঁচ পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয়েছে এর বাইরেও আরো দু’তিন জন রায়হান হত্যায় জড়িত রয়েছেন। কারণ, ঘটনার দিন রাতে কনস্টেবল তৌহিদ মিয়ার মোবাইল থেকে টাকা চেয়ে ফোনকল আসে। সে যদি জড়িত না থাকে তাহলে কল আসে কিভাবে। এছাড়া আরও পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত আছেন।’
তিনি বলেন, ‘ইয়াবা-ছিনতাইসহ এখন নানা বিষয়কে রায়হানের সাথে জড়ানো হচ্ছে। রায়হান যেহেতু নেই তাই এমন বিষয়ের সত্য-মিথ্যা যাছাই করা সম্ভব নয়। এখন তো সে আর এসবের প্রতিবাদ করতে পারবে না। আমাদের দাবি একটাই, রায়হান হত্যার বিচার চাই।’
এ অবস্থায় চার্জশিটে নারাজি দেবেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি নিহত রায়হানের মা বলেন, ‘চার্জশিট মাত্র দেয়া হলো। এটা আদালতে জমা হবে। চার্জশিটের কপি হাতে পাওয়ার পর আইনজীবীর সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন : যুবক রায়হানের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রায়হানের মরদেহে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এসব আঘাতের ৯৭টি ফোলা আঘাত ও ১৪টি ছিলো গুরুতর জখমের চিহ্ন। আঘাতগুলো লাঠি দ্বারাই করা হয়েছে। অসংখ্য আঘাতের কারণে হাইপোভলিউমিক শক ও নিউরোজেনিক শকে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো কর্মক্ষমতা হারানোর কারণে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে। ভিসেরা রিপোর্টেও এমন নির্যাতনের বিষয়টি উঠে আসে।
ফিরে দেখা রায়হান হত্যা : ১০ অক্টোবর রাতে নগরীর আখালিয়া নিহারিপাড়ার বাসিন্দা রায়হানকে কাষ্টঘর সুইপার কলোনি থেকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যান ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ও তার সহকারীরা। এরপর রায়হানের উপর চলে কয়েক ঘণ্টা নির্যাতন। শেষ রাতে এক পুলিশ সদস্যের মোবাইল থেকে রায়হান তার মা’র মোবাইলে ফোন করে। এ সময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে দ্রুত ১০ হাজার টাকা নিয়ে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে আসার জন্য অনুরোধ করে। ভোরে ফজরের নামাজের পূর্ব মূহূর্তে টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে হাজির হন চাচা। তখন রায়হানের সাথে তাকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। এরপর ১১ অক্টোবর সকালে আবার চাচা ফাঁড়িতে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অসুস্থ হয়ে পড়ায় রায়হানকে ওসমানী হাসপাতপালে পাঠানো হয়েছে। পরে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে রায়হানের মরদেহ দেখতে পায় পরিবার।
ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিতের চেষ্টা : রায়হানের মৃত্যু জানাজানি হওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, কাষ্টঘর এলাকায় ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে মারা গেছেন রায়হান। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করেছে। বন্দরবাজার ফাঁড়ির কর্মকর্তা ও মহানগর পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সকাল থেকে গণমাধ্যমে এমন খবরও প্রকাশ হয়।
অবশেষে অভিযোগপত্র : মামলার তদন্তকাজে দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ে পিবিআই। আদালত রায়হান হত্যা মামলার অভিযোগপত্র ৩০ জানুয়ারীর মধ্যে প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এই সময়ে তদন্ত শেষ না হওয়ায় পিবিআই’র আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৪ ফেব্রুয়ারী ৩০ কার্যদিবস সময় বৃদ্ধি করে। পরে করোনার অজুহাতে এই সময়ের মধ্যেও অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়নি।
তদন্তকারী সংস্থাটির পক্ষ থেকে একাধিকবার অভিযোগপত্র প্রদানের ঘোষণা দিয়েও পরে পিছিয়ে যায়। এ নিয়ে ক্ষোভ দেখা দেয় রায়হানের পরিবারে। অবশেষে হত্যাকান্ডের প্রায় সাত মাস পর এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র প্রদান করা হয়।