ঈদে ঘিরে বেপরোয়া ছিনতাইকারী, টার্গেট নারী
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ মে ২০২১, ১২:৫৯:৫৪ অপরাহ্ন
এ টি এম তুরাব :
ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে শপিংমলগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। বেড়েছে মানুষের চলাচল, বেড়েছে যানচলাচল। আর এ সুযোগেই তৎপরতা শুরু করেছে অপরাধীরা। ঈদ টার্গেট করে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে টানাপার্টির সদস্যরা। বসে নেই পকেট চোর, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরাও।
মানুষ টানাপার্টিদের কবলে পড়ছে হেঁটে কিংবা রিকশায়, বাসে কিংবা অটোরিকশা গাড়িতে চলাচলের সময়। সকালে-দুপুরে-সন্ধ্যায় জনাকীর্ণ কিংবা ফাঁকা রাস্তায়। বিপদের কথা হলো, ছিনতাইকারীরা এখন শুধু লোকজনের টাকাপয়সা, মোবাইল ও মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়েই ভাগছে না, ছুরিকাঘাত করছে, এমনকি খুন করতেও দ্বিধা করছে না। চলতি বছর ও গত বছরের টানাপার্টির কবলে পড়ে বেশকিছু প্রাণঘাতীর ঘটনাও ঘটে। এছাড়া টানাপার্টির কবলে পড়ে প্রয়োজনীয় অনেক কিছু হারানোর ঘটনার পাশাপাশি অনেকেই আহত হচ্ছেন মারাত্মকভাবে।
গত এক সপ্তাহে সিলেট নগরীতে প্রায় দশটিরও বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় নগরীর যতরপুর এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন স্কুল পড়–য়া এক শিক্ষার্থী। একই দিন উপশহর এলাকায় শান্তা বেগম নামের এক কলেজ পড়–য়া ছাত্রীর মোবাইল খোয়া যায়। এই দুই ভুক্তভোগীর কেউই সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করেননি।
🔲 সপ্তাহে ১০টি ছিনতাই 🔲
সুত্র জানায়, আসন্ন ঈদের বাজারকে ঘিরে ছিনতাইকারী, জাল নোট কারবারি, মলমপার্টি-অজ্ঞানপার্টি, চাঁদাবাজ চক্রসহ নানা ধরনের অপরাধী এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নগরে। তবে আগে থেকেই সতর্ক অবস্থানে আইনমৃঙ্খলাবাহিনী। ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় ছিনতাইসহ মৌসুমি অপরাধী ধরতে এরই মধ্যে অভিযান শুরু করেছে ডিবির একাধিক টিম। সেই সাথে কাজ করছে পুলিশ ও র্যাব। বড় অঙ্কের অর্থ বহনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মানি এস্কর্ট সেবা দিচ্ছে মহানগর পুলিশ (এসএমপি)। তবে নগরজুড়ে পুলিশের টহল টিম থাকলেও ছিনতাইয়ের ঘটনার সময় পুলিশের উপস্থিতি খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জনতার হাতে ছিনতাইকারীরা আটক হচ্ছে। আর পুলিশ বলছে, প্রায়ই টানাপার্টির কবলে পড়ে ব্যাগ, টাকা, মোবাইল হারানোর ঘটনার তথ্য আসলেও থানায় অভিযোগ আসে কম। শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, মোবাইল ফোন, সার্টিফিকেট বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু হারালে সেগুলোর জন্য সাধারণ ডায়েরি করে ভুক্তভোগীরা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছিনতাইয়ে জড়িতদের বেশির ভাগই কিশোর, উঠতি তরুণ ও গাড়িচালক। পুলিশ জানিয়েছে, কিছু ভুক্তভোগী মামলা করেন, অনেকেই করেন না। কোনো থানা যদি ছিনতাইয়ের মামলা না নিতে চায়, তবে ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের জানাতে বলেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এ দিকে বিভিন্ন পেশাজীবীর মধ্যে কারা কারা ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাত ৮টার। মো. রফিকুল ইসলাম নামের এক যুবক দক্ষিণ সুরমা থানাধীন ক্বীন ব্রিজের মুখ হতে বিশ্বনাথ যাওয়ার জন্য একটি সিএনজি অটোরিকশায় ওঠেন। অটোরিকশায় চালকসহ ৩ যাত্রী বসা ছিলো। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর চালক অটোরিকশাটিকে সিলেট-সুনামগঞ্জ বাইপাস সড়কের দিয়ে যেতে থাকে। এ সময় যাত্রী রফিকুল চালককে কোথায় যাচ্ছ; প্রশ্ন করলে অটোরিকশায় থাকা ৩ জন তার গলায় এবং পেটে চাকু ধরে দুই হাত পিছন দিকে বেঁধে ফেলে। চোখও একটি কাপড় বেঁধে সাথে থাকা মোবাইল, নগদ ১২ হাজার টাকা ও একটি চা-পাতার বস্তা (যার মূল্য-৫০০০ টাকা) জোরপূর্বক নিয়ে যায়। এছাড়া ভিকটিমকে সিলেট-সুনামগঞ্জ বাইপাস সড়কের খানুয়া গ্রামের রাস্তার মুখে ফেলে দিয়ে অটোরিকশা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দিকে যেতে থাকে।
নগরীতে বিভিন্ন সময় ঘটে যাওয়া ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চলতি পথে কিংবা রিকশায় করে যাতায়াতের সময় আচমকা টান। মুহূর্তেই সবকিছু নিয়ে চম্পট ছিনতাইকারী। ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে নিজেদের ভারসাম্য রাখতে না পেরে ভুক্তভোগীদের অনেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হচ্ছেন। সেই সাথে নিহত হওয়ার ঘটনাও রয়েছে।
অভিযোগ আছে, ছিনতাইকারী চক্রের সঙ্গে ভাড়ায় চালিত প্রাইভেট কার কিংবা সিএনজি চালকদের সাথে যোগসাজশ আছে।
সূত্র বলছে, পরপর আলোচিত বেশ কয়েকটি ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বেশ তৎপর হয়ে উঠেন। বিশেষ অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু টানাপার্টির সদস্যদের গ্রেপ্তারও করেন। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অনেক এলাকায় সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়। বিশেষ করে পুলিশ ও র্যাবের বিশেষ অভিযানের কারণে রাতের বেলায় পথচারীরা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই চলাফেরা করে। কিন্তু ইদানীং হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে এসব ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই শোনা যাচ্ছে কোথাও না কোথাও টানাপার্টির কবলে পড়ার খবর। যেভাবে ঘটনা ঘটছে সে তুলনায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান হচ্ছে না। ঈদকে সামনে রেখে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে টানাপার্টির চক্র। নগরের অন্তত ১৫টি স্পর্টে অর্ধশতাধিক চক্র সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। স্পটগুলোর মধ্যে বন্দরবাজার, তালতলা, রিকাবীবাজার, জিন্দারবাজার, আম্বরখানা, উপশহর, মেন্দিবাগ, সোবহানীঘাট, শিবগঞ্জ, টিলাগড়, কদমতলী, হুমায়ুন রশীদ চত্বর, সুবিদবাজার, মদিনা মার্কেট অন্যতম।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন ঈদকে ঘিরে বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে প্রতারকদের তৈরি কোটি টাকার জাল নোট। জাল টাকা তৈরির সাথে জড়িত চক্রগুলো সারা বছর তৎপর থাকলেও উৎসবে বড় টার্গেট নিয়ে মাঠে নামে তারা। এ সময় মুদি দোকান থেকে শপিংমল সবখানে থাকে উপচে পড়া ভিড়। এ সুযোগে জাল নোটগুলো মাঠে ছাড়ে চক্র। অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ব্যাংকে লেনদেন ও এটিএম বুথেও জাল টাকা ছড়িয়ে দেয়া হয়। তবে জাল নোটের এসব চক্র ধরতে মাঠে সক্রিয় রয়েছে ডিবি। ঈদকে সামনে রেখে জাল টাকা কারবারি চক্রের সদস্যদের ধরতে মাঠে রয়েছে গোয়েন্দারা।
কৌশলী অজ্ঞান পার্টি : কোমল পানীয় কিংবা বোতলজাত খাবার পানির সঙ্গে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইনসুলিন মিশিয়ে তৈরি করা হয় অজ্ঞান করার রেসিপি। আবার গণপরিবহনে সিটের কাছে ক্লোরোফর্ম জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ লাগিয়েও অজ্ঞান করার কাজটি করা হয়। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা এলাকা ভাগ করে ‘অপারেশন’ পরিচালনা করছে। আবার টার্গেট ভিত্তিক এলাকার বাইরে চলে গেলে তাদেরকে নিজেদের আয়ত্তে রাখতেও দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয় রিলে দৌড়ের মতো। পার্টির কেউ সাজছে ডাব বিক্রেতা, কেউ পানির ফেরিওয়ালা, কেউ হচ্ছে সিএনজি অটোরিকশার যাত্রী, আবার অজ্ঞান করা কিংবা চোখে মলম লাগানোর ক্ষেত্রে স্বল্প পাল্লার মাইক্রোবাসকে ব্যবহার করছে তারা।
এ বিষয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া ও কমিউনিটি সার্ভিস) আশরাফ উল্যাহ তাহের জালালাবাদকে বলেন, সাধারণত ঈদে অজ্ঞানপার্টি, ছিনতাই ও জাল টাকা চক্রের আনাগোনা বেড়ে যায়। তাই জনসাধারণের নিরাপত্তায় সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ডিবি পুলিশের টিম কয়েক স্তরে ভাগ হয়ে দায়িত্ব পালন করছে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, টানাপার্টির সদস্যদের ধরতে আমাদের অভিযান চালু আছে। এমএমপির প্রতিটি থানা এলাকায় টহল পুলিশ কাজ করছে। ঈদকে সামনে রেখে টানাপার্টির তৎপরতা একটু বেড়ে যায়। সেজন্য আমাদেরও তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। থানা পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও কাজ করে যাচ্ছেন।