সিলেটে বেওয়ারিশ লাশ আতঙ্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ মে ২০২১, ১২:০৫:২৩ অপরাহ্ন
এ টি এম তুরাব :
সিলেটে অহরহ মিলছে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা। গত ছয়মাসে (নভেম্বর থেকে এপ্রিল) সিলেটে মিলেছে ১৫টি বেওয়ারিশ লাশ। এ নিয়ে জনমনে আতঙ্ক বেড়েছে। এসবের বেশিরভাগেরই পরিচয় না মিলায় অজ্ঞাত হিসেবে দাফন হচ্ছে। তবে বেওয়ারিশ লাশের পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্য জানে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আর প্রশাসন। মাসে অন্তত ২ থেকে ৩টি লাশ উদ্ধার হয় নগরী থেকে। শুধু যে নগরীতে মিলছে তা নয়। সিলেট জেলা ও বিভিন্ন উপজেলার দুর্গম এলাকা ও বেশ কিছু স্পট লাশের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
এসব বেওয়ারিশ লাশের দুই একটির ওয়ারিশ বা পরিবার-পরিজন কিংবা পরিচয় মিললেও অধিকাংশের কোনো পরিচয় মেলেনি। বেওয়ারিশ লাশগুলোর শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া গতানুগতিক ও দায়সারা, নেই প্রযুক্তির ব্যবহার। তবে প্রশাসনের দাবি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লাশ বিকৃত থাকায় পরিচয় পাওয়া সম্ভব হয় না। এভাবে প্রতিনিয়ত খুনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় মানুষ ক্রমেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে।
আবাসিক ভবন, হাসপাতালের সামনে থেকে ধানক্ষেত, নদীর পারে পাওয়া যাচ্ছে মৃতদেহ। প্রতিনিয়তই নিখোঁজ হচ্ছে মানুষ। কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, কোথাও উদ্ধার হচ্ছে মৃতদেহ। আবার এমন অনেক মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে, যেগুলোর কোনো পরিচয় মিলছে না। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে তা দাফন করা হচ্ছে।
ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ সূত্রে জানা গেছে, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হলেও প্রতিটি মৃতদেহের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট ধারণা মিলেছে, উদ্ধারকৃত বেওয়ারিশ লাশের বেশির ভাগই হত্যাকাণ্ডের শিকার। প্রতিবছর শতাধিক হত্যা রহস্যের কিনারা হচ্ছে না। অপরাধীরা নানা দুর্বলতার সুযোগে পার পেয়ে যাচ্ছে। নতুন করে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অপরাধী ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একেবারে তৎপরতা নেই, তা বলা যাবে না। কিন্তু অধিকাংশ লাশের পরিচয় জানা না যাওয়ায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করার কাজটি জটিল হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই তৎপরতা যথেষ্ট নয়। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনোভাবেই বেওয়ারিশ লাশের দায় এড়াতে পারে না। তাদের দায়িত্ব হলো, তদন্তের মাধ্যমে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের পরিচয় নিশ্চিত ও হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির মুখোমুখি করা।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকার তথ্যমতে ও অসমর্থিত কয়েকটি সূত্র জানায়, গত সোমবার সকালে শহরতলীতে খিত্তারগাঁও গ্রামে সুরমা নদী থেকে এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে জালালাবাদ থানা পুলিশ।
অপরদিকে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে মোগলাবাজার থানার হাজীগঞ্জ মুহাম্মদপুর এলাকার একটি ডোবা থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে লাশটির পরিচয় মিলেছে। তার নাম রেদওয়ান রশীদ চৌধুরী সৌরভ (৩০)। পেশায় উবার চালক ছিলেন। তিনি ৩ দিন আগে সিলেট থেকে নিখোঁজ হয়েছেন।
২ মে রাত ১০টার দিকে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার বরাম হাওর থেকে মস্তকবিহীন অজ্ঞাত ব্যক্তির ছিন্নভিন্ন লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
২৯ এপ্রিল রাত ১২টার দিকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে একজন অজ্ঞাতনামা নারীকে অসুস্থ অবস্থায় কে বা কারা পেয়ে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ভর্তি করে। পরে শুক্রবার বিকেল ৪টায় হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় অজ্ঞাতনামা ওই নারী মারা যান। ওই মহিলার বয়স আনুমানিক ৪০ বছর।
২৭ এপ্রিল দিবাগত রাত পৌনে ১টার দিকে ওসমানী হাসপাতালের মূল ভবনের ২য় তলার সিড়ির পাশে একজন অজ্ঞাতনামা নারীকে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে পেয়ে বিষয়টি পুলিশকে জানান। পরে পুলিশ এসে অজ্ঞান অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে যায়। এ সময় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আনুমানিক ৫৫ বছর বয়স্ক এই নারীর মৃতদেহ বর্তমানে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রয়েছে।
বুধবার সকালে গোয়াইনঘাটের খেয়াঘাট যাত্রী ছাউনিতে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে। মৃত ব্যক্তির বয়স আনুমানিক ৬০ বছর হবে।
গত ২২ জানুয়ারী ওসমানীনগরে অজ্ঞাত এক বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার অনুমান বয়স ৭৩ বছর। একই মাসের ১১ জানুয়ারী সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় সুরমা নদী থেকে অজ্ঞাত ব্যক্তির ভাসমান লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। একই মাসের ৩১ জানুযারী সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে ধলাই নদীতে অজ্ঞাত এক কিশোরীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ওইদিন বিকেল ৪টায় হাত-পা বাধা অবস্থায় অজ্ঞাতনামা কিশোরের মরদেহ দেখে স্থানীয়রা। পরে থানা পুলিশকে খবর দিলে লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায় পুলিশ।
১০ জানুয়ারী সকালে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার ছাতিয়াইন গ্রামের একটি পুকুর থেকে অজ্ঞাত (২২) নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত ১ জানুয়ারী নগরীর ক্বিন ব্রিজ এলাকা থেকে কাপড়ে মোড়ানো এক নবজাতকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এছাড়া গেলো বছরের ১৩ ডিসেম্বর সিলেট নগরীর উপশহর থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ওইদিন সকাল সোয়া ১০টার দিকে মেন্দিবাগস্থ গার্ডেন টাওয়ারের দক্ষিণ পাশে পরিত্যক্ত একটি খাল থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়।
১৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় সিলেটের দক্ষিণ সুরমার লালাগাও এলাকা থেকে ২০ বছর বয়সী অজ্ঞাত এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এরআগে ১১ জুন সকাল ১১টার দিকে সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কের ষাটঘর এলাকায় রাস্তার পাশ থেকে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির ওই লাশ উদ্ধার করা হয়। একই মাসে জকিগঞ্জ উপজেলার উত্তরকুল এলাকায় সুরমা নদীতে অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ ভাসতে দেখে স্থানীয়রা। পরে বিষয়টি পুলিশকে জানানো হলে জকিগঞ্জ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে।
জন্মিলে মরিতেই হবে, কথাটি চিরন্তন। তবু প্রিয়জনের বিদায় মানতে পারেন না কেউই। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় বা লাশকাটা ঘরে পড়ে থাকা নিথর মরদেহ ঘিরে স্বজনদের বিলাপ তো দূরের কথা কেউ জানতেও পারলো না পরিচয়। রয়েছে এর উল্টোচিত্র। দীর্ঘদিন আপনজনের খোঁজ না পেয়ে অনেক পরিবারই হারানো বিজ্ঞপ্তি দেয়ার পাশাপাশি ভীড় করছে মর্গ থেকে মর্গে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, ডিএনএ নমুনা, ফিঙ্গার প্রিন্টসহ যেসব আলামত সংরক্ষণ করা প্রয়োজন, তা ঠিকমতো হয় না। এ সংক্রান্ত নমুনা সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের জন্য নেই কোনো উপযুক্ত গবেষণাগার। প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে বিশেষ সেলের মাধ্যমে নিখোঁজ ব্যক্তি ও বেওয়ারিশ লাশের নমুনা মেলাতে হবে। কিন্তু পুলিশ তথা র্যাবের যে ল্যাব রয়েছে, তার মাধ্যমে এ ধরনের কাজ সম্ভব নয়।
সার্বিক বিষয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আশরাফ উল্যাহ তাহের জালালাবাদকে বলেন, ডিএনএ নমুনা, ফিঙ্গার প্রিন্টসহ যেসব আলামত সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়া লাশ উদ্ধারের পর পরিচয় জানতে গণমাধ্যমে ছবিসহ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রেরণ করা হয়।
তিনি বলেন, অন্য কোনো স্থানে হত্যা করে নির্জন স্থানে লাশ ফেলে যাচ্ছে খুনিরা। তবে তদন্তের মাধ্যমে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি অজ্ঞাত লাশ ক্লু উদঘাটনসহ জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। পাশাপাশি অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের পরিচয় নিশ্চিত ও হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির মুখোমুখি করতে পুলিশ কাজ করছে।