আওয়ামী নিপীড়নের সরল সমীকরণ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ মে ২০২১, ৭:৫৬:২৭ অপরাহ্ন
হাসান আহমাদ
বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও ভিন্নমত পোষণকারী লেখক-সাংবাদিকদের ওপর আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়ন এখন শুধু দেশে নয়, বহিঃর্বিশ্বেও আলোচিত-সমালোচিত একটি বিষয়। সরকারের অগণতান্ত্রিক ও জনবিরোধী কর্মের প্রতিবাদে সোচ্চার দল ও ব্যক্তিদের বিরোদ্ধে হয়রানীমূলক মামলা, গ্রেফতার, জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নির্যাতন এবং বিনা বিচারে বছরের পর বছর কারাগারে আটক রাখার যে আওয়ামী প্রক্রিয়া ২০০৯ সাল থেকে শুরু হয়েছিল, আমরা দেখছি তা এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। বাস্তবিক অর্থে সরকার বিরোধী সকল দল ও ব্যক্তিকে কোনো না কোনো ভাবে আওয়ামী সরকারের রোষানলে পড়তে হচ্ছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র অভিযোগ, সারা দেশে প্রায় ১ লাখ মামলায় তাদের দলের ৩ লাখের উপরে নেতাকর্মীকে আসামী করে হয়রানী করা হচ্ছে। খোদ দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে রয়েছে আনুমানিক ৮৬ টির মত মামলা। বিএনপি’র অন্যতম শরীক জামায়াত-শিবিরের বিরোদ্ধে মামলার সংখ্যা ও নির্যাতনের ইতিহাস আরো লোমহর্ষক নিশ্চয়ই।
বিএনপি জামায়াতকে দমনের চেষ্টা চালানোর সাথে সাথে বর্তমান সরকার নতুন করে চড়াও হয়েছে কওমী মাদরাসা ভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের উপর।
দেশে সরকার সমালোচক অনেক রাজনৈতিক দল আছে, গঠনমূলক সমালোচনা করেন এমন অনেক লেখক আছেন। আমরা দেখছি, সরকার কিন্তু সবার উপর নির্যাতনের স্ট্রীম রোলার চালাচ্ছে না। সবার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া প্রয়োজন মনে করছে না, মামলা হলেও সবাইকে গ্রেফতার করছে না। আমাদের পর্যালোচনায় মনে হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে সরকার একটি পুরনো সূত্রকে অনুসরণ করে এগুচ্ছে।
সরকার তথা আওয়ামীলীগের এই দমন-পীড়নের সূত্রটা আসলে কী ?
এই সূত্র যদি আমরা বুঝতে পারি তাহলে সরকারের সাম্প্রতিক সকল কর্মযজ্ঞের হিসাব আমাদের সামনে সহজেই খোলাসা করা সম্ভব। কারণ, আওয়ামীলীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে দমন-পীড়নের জন্য যে নীতি বা সূত্র অনুসরণ শুরু করেছিল, তাদের কর্মকান্ড বলছে-তারা এখনো সেই নীতি অব্যাহত রেখেছে। সরকার ভবিষ্যতেও বিরোধী মত ও তাদের সমালোচকদের দমনে একই নীতি অনুসরণ করে এগুবে-এটা প্রায় নিশ্চিত।
কী সেই সূত্র ?
বিএনপি-আওয়ামীলীগ-জামায়াত সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সচেতন নেতাকর্মী এই আওয়ামী লীগের এই নীতি সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই অবগত। তারপরও সর্বসাধারণের বিবেককে জাগ্রত করার মানসে আজকে আমি এই সরকারী এই দমন নীতিটি একটু খোলাসা করতে চাই।
সরকার দলীয় অনেকে হয়ত তাতে দ্বিমত পোষণ করবেন, অনেকে হয়ত ক্ষুব্ধ হবেন, অনেকে হয়ত হুমকি-ধামকি দিয়ে কলম থামিয়ে দিতে চাইবেন।
অদৃশ্য এ নীতিটা খোলাসা করার জন্য আমাদের খুব পেছনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের বিরুদ্ধে সরকারের এ্যাকশনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করতে পারি। কারণে চলমান গ্রেফতার অভিযানেও সরকার একই নীতি অনুসরণ করছে। আমরা দেখছি; সরকার টার্গেট করে করে, খুবই ধীরস্থীরভাবে, বিনা বাধায় হেফাজতের বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করেছে। আটককৃত অধিকাংশকে ২০১৩ সালের শাপলা চত্ত্বরের ঘটনার মামলায় আটক দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩/৪ জনকে শুরুতেই আটক দেখানো হয়েছে নতুন মামলায়।
এই গ্রেফতার অভিযানে সরকার সিনিয়র-জুনিয়র কিংবা পদ পদবীকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। হেফাজতের সিনিয়র শত শত দায়িত্বশীল, কওমী মদারসার শত শত মুফতি-মুহতামিম কারাগারের বাইরে নিরাপদেই আছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও আপাতত তাঁরা গ্রেফতার হওয়ার তেমন আশঙ্কা নেই। ইতিমধ্যে আটক করা হয়েছে এমন কয়েকজন আলেমকে-দু’একজন বাদে যাদের অধিকাংশই দলটির তৃতীয়/ চতুর্থ সারির নেতা। তাদেরকে আবার ধরা হয়েছে অনেক নজরদারীর মাধ্যমে, তথ্যের ভিত্তিতে খুবই সতর্ককতার সাথে।
এর কারণ কি ?
সরকার হেফাজতের সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে ছাড়া ৩য়/ ৪র্থ সারীর নেতৃবৃন্দকে এত গুরুত্ব দিয়ে আটক করার মাঝে অনেক কার্যকারণ রয়েছে। এই কারণ বা রহস্যটা আমাদেরকে বুঝা দরকার।
পূর্বেই বলেছি যে, সরকার কারো ইলমের বহর, পদ-পদবী, জুব্বা, পাগড়ী কিংবা মাদরাসার আকার বিবেচনা করে সাম্প্রতিক ধরপাকড় শুরু করেনি। সহিংসতায় জড়িত থাকার যে অজুহাত প্রচার করানো হচ্ছে মূল কারণ সেটিও না। সরকার এ অভিযানে টার্গেট করেছে কওমী অঙ্গনের সেই সব আলেমকে-যারা সমাজ ও রাজনীতি সচেতন, যারা আওয়ামী লীগের অন্যায় অপকর্মের বিরুদ্ধে কওমী অঙ্গনকে সংগঠিত করার কিছুটা যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
কওমী অঙ্গনের মধ্যে রাজনীতি সচেতন যারা আছেন তাদের মধ্যে গ্রেফতারকৃতরা অন্যতম। তাঁদের মধ্যে এমপি ছিলেন, কেউ কেউ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন। তাঁদের মধ্যে টকশো, সভা-সেমিনার ও ওয়াজের ময়দানে আওয়ামী আদর্শ এবং তাঁদের দূর্ণীতির ঘোর বিরোধীতাকারী সাহসী লোকও আছেন। তারা কওমীর অন্যান্য হুজুরদের মত রাজনৈতিক জ্ঞানশূন্য নন,তারা মোটামোটি রাজনীতি বুঝেন। তাঁরা সমাজে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিফহাল, তারা ভারতের আধিপত্যবাদের প্রচন্ড বিরোধীও। তাঁরা ব্যতিত পুরো কওমী অঙ্গন খুঁজে আওয়ামী অপরাজনীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলার মত বা দেশপ্রেমিক কোনো আদর্শবান শক্তিকে সংগঠিত করার মত যোগ্য নেতৃত্ব পাওয়া দুষ্কর।
দলীয় সূত্র এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সরকার কওমী অঙ্গনের হাতেগোনা এই নেতৃত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে সক্ষম হয়েছে। তাই তাদের মুখ বন্ধ রাখা, তাদেরকে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে নিস্ক্রিয় করে রাখা সরকারের জন্য হয়ত অনেক জরুরী ছিল। ক্ষমতাসীনরা হয়ত ফাঁদ বা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল বহুদিন থেকে। সেই সুযোগ তাদের হাতের নাগালে আসার ফলে তা তারা লুফে নিয়েছে। এখন তারা টার্গেককৃত ব্যক্তিদের বিনা বাধায় বন্দী করছে। রিমান্ডে নিচ্ছে। তেমন কোনো প্রতিবাদ, প্রতিরোধ নেই। আওয়ামীলীগের এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মত যোগ্য এবং সাহসী কোনো নেতৃত্ব আসলে আর হেফাজতে বলতে গেলে অবশিষ্টও নেই।
যাদেরকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের ৩/৪ জন সম্পর্কে আলাদাভাবে কিছু লিখা প্রয়োজন। আমার জানামতে, তাদের মধ্যে ৪/৫ জন এমন আছেন-যারা হেফাজতের নেতৃত্বে ছিলেন না, কোনো সাংগঠনিক তৎপরতায়ও তাদের সক্রিয়তা নেই, তারা অখ্যাত অপরিচিত। ভয় এবং উৎকোচের কাছে তারা সহজেই ধরাশায়ী হওয়ার মত। সরকার তার উদ্দেশ্য এবং ষড়যন্ত্রমূলক দূরভিসন্ধি বাস্তবায়নে সহায়তাকারী হিসেবে এরকম ৩/৪ জনকে আটক করেছে। কারণ ভয় ও অর্থের বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা এবং তা টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো মোটেও কঠিন নয়। আর আমরা সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র হনন ও তাদের সামাজিক এবং পারিবারিক ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার একটা প্রবনতা দেখেই আসছি। হেফাজত নেতারাও এই প্রবনতার স্বীকার হচ্ছেন, হবেন-এটা স্বাভাবিক। তার বেশ কিছু আলামত আমরা লক্ষ্য করেছি। ভবিষ্যতে হয়ত এ বিষয়টি জাতির সামনে আরো স্পষ্ট হবে।
আমরা আওয়ামীলীগের দমন নীতির এই যে সূত্রটি পর্যালোচনা করলাম এটা আসলে নতুন নয়। সরকার বিএনপি জামায়াত নেতাদের দমনেও এই নীতি অবলম্বন করেছে। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপি জামায়াত নেতাদেরকে গ্রেফতার নির্যাতন করা হয়েছিল, সেই একই উদ্দেশ্যে হেফাজতের রাজনীতি সচেতন নেতাদের গ্রেফতার-নির্যাতন করা হচ্ছে। এখানে কার পদ বড়, কে কোন এলাকার, কে কোন মাদরাসার-এটা বিবেচনা করার মধ্যে সরকারের মোটেও স্বার্থকতা নেই। সরকার মনে করছে তাদের মূল স্বার্থকতা সমালোচকদেরকে গ্রেফতার করে বন্দী করার মধ্যে। যেখানেই আওয়ামী লীগের বিরোধীতা-সেখানেই প্রশাসনের থাবা,যেখানেই প্রতিবাদ- সেখানেই হামলা,মামলা কিংবা গুলি। আওয়ামী দমন পীড়ন চলে এই একটি নীতিকে কেন্দ্র করে। এ বিষয়ে ভিন্ন ভাবনার সুযোগ আছে কিন্তু বাস্তবতা নেই।
লেখক: ফ্রান্স প্রবাসী সাংবাদিক