থামছে না আত্মহত্যা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ মে ২০২১, ৮:৩২:৪৮ অপরাহ্ন
ইদানীং আত্মহত্যার ঘটনা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে। সিলেট অঞ্চলে প্রায় প্রতিদিনই এ ধরণের ঘটনার খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। গত মঙ্গলবার ‘কুলাউড়ায় কলেজ ছাত্রীর আত্মহত্যা’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কুলাউড়া উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
সাম্প্রতিককালে আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে। করোনা মহামারির কারনে দীর্ঘদিন যাবৎ স্কুল কলেজ বন্ধ থাকা এবং পড়াশোনায় বিশৃঙ্খলা এগুলোর পেছনে কাজ করছে কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার। স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষার স্বাভাবিক গতি যে ব্যাহত ও বিঘিœত হচ্ছে এতে কোন সন্দেহ নেই। এ পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুনভাবে হতাশার কারণ সৃষ্টি করেছে।
দেখা গেছে, পড়ালেখার বিষয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ায় অনেকেই হতাশায় ভুগছে। নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে শংকিত বোধ করছে। অনেকে স্থায়ীভাবে ডিপ্রেশন বা বিষণœতা বোধে আক্রান্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় নারী শিক্ষার্থীদের মাঝে ভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দিয়েছে। শিক্ষার সাথে তাদের বিয়েশাদীর বিষয়টি জড়িত থাকায় জটিলতা বাড়ছে। আমাদের দেশে শিক্ষিত পরিবারগুলোতে পড়ালেখার একটি পর্যায় শেষ হলে মেয়েদের বিয়ের কথা চিন্তা করা হয়। এসএসসি বা সাধারণতঃ এইচএসসি পরীক্ষা পাশের পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয়। তবে ইদানিং অনেক ক্ষেত্রে বিএ, এম,এ পর্যন্ত অপেক্ষা করে পরিবারগুলো। মেয়েদের স্বাবলম্বী করে তোলার চেষ্টা করেন পিতা-মাতা ও অভিভাবকেরা। কিন্তু বর্তমানে করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার মেয়াদ দীর্ঘায়িত হওয়ায় এসব পরিবার শিক্ষার্থী মেয়েদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন, অনেকে পড়াশোনার চিন্তা বাদ দিয়ে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। অনেকে দো-টানায় পড়ে হতাশায় ভুগছেন।
এ হতাশা সঞ্চারিত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের মাঝে। তা থেকে অনেকে হতাশায় আত্মহত্যার মতো নেতিবাচক পন্থা অবলম্বন করা অস্বাভাবিক নয়। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা জরুরি বলে আমরা মনে করি।
এছাড়া করোনা মহামারির কারনে গত এক বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও আর্থিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি অপেক্ষাকৃত দুর্বল হওয়ায় করোনার প্রভাব বেশি মাত্রায় অনুভূত হচ্ছে এই খাতে। ইতোমধ্যে প্রায় আড়াই কোটি বাংলাদেশী মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে গেছেন। হাজার হাজার মানুষ চাকুরি হারিয়ে দেশে ফেরত এসেছেন। দেশের অভ্যন্তরে চাকুরি হারানো ও আয় হ্রাস পাওয়া কর্মজীবি মানুষের সংখ্যা কয়েক কোটি। এ অবস্থা স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মাঝে মানসিক যন্ত্রণা ও হতাশা সৃষ্টি করেছে। আর এ ধরণের মানসিক যন্ত্রণা ও হতাশা থেকে ইদানিং আত্মহত্যার হারও যে বেড়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা অমূলক নয়।
বর্তমান সময়ে সহিংসতা ও বিরোধ বেড়ে যাওয়ার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। প্রায়ই ঘটছে নৃশংস হত্যাকান্ড ও খুনের ঘটনা। এতে সামাজিক অস্থিরতা ও অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। এসব বিষয়ও আত্মহত্যার মতো নেতিবাচক প্রবণতা বৃদ্ধি করতে পারে। পারিবারিক অশান্তি ও কলহ থেকে আত্মহত্যার ঘটনা আত্মহত্যার একটি বড়ো কারণ। এদেশের সমাজ জীবনে এটা দীর্ঘকাল ধরে লক্ষণীয়। এছাড়া সন্তান ও পিতামাতার মধ্যে মান অভিমান এবং পরীক্ষার অকৃতকার্য হওয়া থেকেও ইতোমধ্যে বহু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ ধরণের আত্মহত্যার ঘটনায় প্রতি বছর বহু জীবন প্রদীপ নির্বাপিত হচ্ছে। এছাড়া প্রেম ভালোবাসায় ব্যর্থতা থেকেও বহু তরুণ-তরুণী এমনকি কিশোর-কিশোরীকে আত্মহত্যা করতে দেখা যায়। এ সংখ্যাও ইদানিং বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট প্রযুক্তির কুফল আত্মহত্যার প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। মোবাইল ইন্টারনেটে অশ্লীল ছবি ধারণ ও ছড়িয়ে দেয়ার জের ধরে অনেক তরুণী ও নারীকে আত্মহত্যা করতে দেখা যাচ্ছে। এছাড়া ইন্টারনেটের ফ্যান্টাসী জগত ও ক্ষতিকর ভিডিও গেইম তরুণ-তরুণীদের মনে হতাশা ভীতি ও শঙ্কা সৃষ্টির মাধ্যমে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি করছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এছাড়া দীর্ঘকালীন জটিল অসুস্থতাও অনেককে প্ররোচিত করছে আত্মহত্যায়।
সর্বোপরি আত্মহত্যা একটি মানসিক ব্যাধি ও সামাজিক সমস্যা। এটা কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না। আত্মহত্যা একটি নিন্দনীয় ও কাপুরুষোচিত কাজ। কাপুরুষোচিত এজন্য যে, এটা মানুষের ব্যর্থতা প্রমান করে, প্রমান করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে এটা থেকে পালিয়ে যাবার মনোবৃত্তি। তা-ই সর্বোতভাবেই এটা পরিত্যাজ্য। ব্যক্তিগত হোক আর সামাজিক-রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক হোক, সকল সমস্যাকে সাহসের সাথে মোকাবেলা করতে হবে, চেষ্টা করতে হবে এগুলো সমাধানের। এটাই জীবনের দাবী। তাই আত্মহত্যার মতো নেতিবাচক কর্মকা- থেকে সবাইকে দূরে থাকতে হবে এবং অন্য থেকে দূরে থাকতে উৎসাহিত করতে হবে। আত্মহত্যার কারণ সৃষ্টিকারী বিষয়গুলো দূর করার চেষ্টা করতে হবে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে। এটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি।