অনলাইন গেমে সর্বনাশ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মে ২০২১, ১২:০১:৪৫ অপরাহ্ন
মামুন পারভেজ:
অনলাইন গেমে সর্বনাশা পথে হাঁটছে কমলমতি শিশুরা। ‘ফ্রি ফায়ার’ ও ‘পাবজি’র মত মরণ গেমে আসক্ত হচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। গেম খেলতে না পারায় ইতোমধ্যে দুই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অলস সময়ে এ গেমসে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এ নিয়ে অনেক অভিভাবক পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। অনলাইনে ক্লাশের কারণে বাধ্য হয়ে সন্তানদের মোবাইল দিতে হচ্ছে, সেই সুযোগে শিক্ষার্থীরা ঝুঁকছে এসব গেমে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশে বাঁধা সৃষ্টি করছে।
জানা গেছে, উঠতি বয়সের শিক্ষার্থীরা ও যুব সমাজ দিন দিন ফ্রি ফায়ার ও পাবজি নামক গেমের নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। যে সময় তাদের ব্যস্ত থাকার কথা নিয়মিত পড়ালেখাসহ শিক্ষা পাঠ গ্রহণ নিয়ে ও খেলার মাঠে দাপিয়ে বেড়ানোর কথা।
৮ বছর থেকে ২১ বছরের উঠতি বয়সের যুবকরা প্রতিনিয়ত অ্যান্ড্রয়েড ফোন দিয়ে এসব গেইমে আসক্ত হচ্ছেন। সারাদিন লাইভ ভিডিও আড্ডা দিয়ে গেইম খেলছে, তো কেউ আবার রাত জেগে খোলায় মগ্ন। স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় সকালে ঘুম থেকে উঠার তাড়া নেই, তাই দেরি করে ঘুম থেকে উঠছে। শুধু খেলা দিয়ে ক্ষান্ত নয় কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব গেইমস। ইউসি ক্রয় ও ডায়মন্ড টপ আপের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, পাবজি ও ফ্রি ফায়ার নামক সর্বনাশা গেমস। কোমলমতি শিশুদের ১০ টাকা ২০ টাকা জমিয়ে যেখানে ক্রিকেট বল ফুটবল কেনার কথা, সেখানে তারা টাকা জমিয়ে রাখছে একাউন্ট আইডি, ইউসি/ ডায়মন্ড কেনার জন্য।
গেইমের চরিত্রের জন্য কাপড়, চশমা, বন্দুক, জুতা, গাড়িসহ জীবন ধারণের জন্য যাবতীয় সবকিছু কিনতে হয় ইউসি/ ডায়মন্ড দিয়ে। সর্বনিম্ন ৪৩০ টাকা থেকে শুরু করে লক্ষাধিক টাকার উপকরণ কিনতে পাওয়া যায়। বিশে^র বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাইভ আড্ডা দিয়ে খেলায় নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থান প্রমাণ করার একটা অসুস্থ প্রতিযোগীতা চলে এই গেইমে। নানা বাহানায় চাহিদা মত উপকরণ কিনতে অভিভাবকদের চাপ দিতে থাকে শিক্ষার্থীরা। কিনে না দিলে অনেক সময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এসব বিদেশী গেম থেকে শিক্ষার্থী বা তরুণ প্রজন্মকে ফিরিয়ে আনতে না পারলে বড় ধরণের ক্ষতির আশঙ্কা দেখছেন সচেতন মহল।
৮ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সজিব জানায়, এবছর ঈদের কাপড় না কিনে সে ফ্রি ফায়ার গেমের চরিত্র ডিজে অলকের জন্য ২ হাজার টাকা দিয়ে বন্দুক কাপড় কিনেছে। প্রথমে তার কাছে ফ্রি ফায়ার গেমস ভালো লাগত না।
কিছুদিন বন্ধুদের দেখাদেখি লাইভে আড্ডা দিয়ে খেলতে গিয়ে তার ভালো লাগতে শুরু করে। এখন গেমস না খেলে তার অস্বস্তি হয়। ১০ম শ্রেণীর আরেক শিক্ষার্থী তাওহীদ জানায়, ‘পূর্বে গেমস সম্পর্কে কিছু জানতাম না। এখন নিয়মিত ফ্রি ফায়ার গেমস খেলি। মাঝে মধ্যে গেমস খেলতে না পারলে মুঠোফোন ভেঙে ফেলার ইচ্ছাও হয়। সে আরো বলে, ফ্রি ফায়ার গেমস যে একবার খেলবে সে আর ছাড়তে পারবে না।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের অনেকে পড়ার টেবিল ছেড়ে কখনো ইন্টারনেটের খারাপ সাইটে বিভিন্ন ছবি দেখছে। জড়িয়ে পড়ছে নানান অপকর্মে। এতে একদিকে তাদের ভবিষ্যৎ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।
এব্যাপারে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আজির উদ্দিন আহমদ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, মোবাইলে গেইম কিংবা শিশুদের মোবাইল আসক্তি একটি সামাজিক ব্যধিতে পরিণত হয়েছে। এতে করে শিশুর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে মূলত অভিভাবক বিশেষ করে মায়েদের ভূমিকা মূখ্য। আমরা প্রায়ই দেখি একটি শিশু যখন খাচ্ছে না বা অন্য কোনো কাজ করতে যাবে তখন তাকে মোবাইল ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। মোবাইল দেখে দেখে সে খাচ্ছে। এতে করে শিশুটি মোবাইলে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। এভাবে তারা আসক্তি নিয়ে বড় হচ্ছে। যখন তাদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নেয়া হয় তখন তারা ডিপ্রেসড্ হয়ে যায়, একটা সময় তাদের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। অনলাইন ক্লাশগুলোতে অবশ্যই অভিভাবকদের নজরদারি থাকা উচিত। প্রযুক্তির ভালো এবং মন্দ দুটি দিক রয়েছে। তা নির্ভর করে ব্যবহারে উপর। অপ্রয়োজনে মোবাইল দেয়া যাবে না। সবার আগে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে এবং পাশাপাশি সামাজিকভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
একটা শিশু বা কিশোর যখন গেইমে মানুষ হত্যা করছে তখন স্বাভাবিকভাবে এটা তাকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করছে। একটা সময় নিজের মধ্যে সেই হিংস্রতা চলে আসে। এতে ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মানসিক ও স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. গোপীকান্ত রায় দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার ও মোবাইলে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একটা সময় তা আসক্তিতে পরিণত হয়। অনলাইন গেইম ও মোবাইল গেইমে অনেক চ্যালেঞ্জিং বিষয় ও মোবাইলের অতিরিক্ত রেডিয়েশনের কারণে একটা সময় তারা বিষন্নতায় ভোগে। গবেষণায় প্রমাণিত এসব গেম শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করছে। গেমে জিততে না পেরে সারাদিন ডিপ্রেশনে থাকা, ডিপ্রেশন থেকে সুইসাইড ও পরিবারের সদস্যদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা তাদের দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাই কিশোর-কিশোরীদের মা-বাবাসহ সমাজের সবারই খেয়াল রাখতে হবে, যেন তারা মোবাইলের অতিরিক্ত ব্যবহার না করে এবং প্রতিটি সন্তানকে একটু যত্ন সহকারে খেয়াল রাখার দায়িত্ব বা কর্তব্য বলে মনে করেন তিনি। মোবাইল ব্যবহারের উপকারিতা ও অপোকারিতা তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে।
এব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার বিএম আশরাফ উল্লাহ তাহের বলেন, অনলাইন গেইম শিশু থেকে তরুণদের আসক্তি রোধে সামাজিক সচেতনা বৃদ্ধি করতে হবে। আমরা সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করে এধরণের গেইম বন্ধ করার সুপারিশ করবো।