সমরনায়ক হতে রাষ্ট্রনায়ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ মে ২০২১, ৬:১৪:৪৪ অপরাহ্ন
সালেহ আহমদ খসরু
তিরিশে মে ১৯৮১, এ দেশের সাদামাটা মানুষের চোখে জল, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। বৃষ্টি পিচ্ছিল গুড়ুম গুড়ুম ডঙ্কার চট্টগ্রামের সেই কালিমা মাখা অন্ধকার রাত্রির কথাই বলছি, যেদিন দেশ হারিয়েছে অকুতোভয় দুঃসাহসী সমরনায়ক-স্বাধীনতার ঘোষক- হ্যাঁ দ্বিতীয়বার বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই ঘোষণা দেয়া-মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ব্রিগেড কমান্ডার জেড ফোর্স অধিনায়ক, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, হত্যা করা হয় দেশের অন্যতম এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে।
যে ‘কমল’ ফুটেছিল ১৯শে জানুয়ারী ১৯৩৬ সালে বগুড়া জেলার বাগবাড়ি রাঙিয়ে দিয়ে তাঁর অকাল প্রয়ানে তখন দেশ স্তব্ধ, জাতি হতবিহ্বল, বিমর্ষ ও ক্ষুব্ধ এবং মুষড়ে পড়েছিল সেদিন। কিন্তু সেই আবেগ এতো বেগে বহমান হয়েছিল যে, শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়া’র জানাজায় যতো লোক সমাগম হয়েছে তা বিশ্বে স্মরণকালের অন্যতম বৃহত্তর বলেই আজও আলোচিত। আজ সেই আলোর ফেরিওয়ালা- বাংলাদেশের জনপ্রিয় সরকার প্রধান প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর ৪০তম শাহাদাৎ বার্ষিকী।
এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মাওলানা ভাসানীর পর অন্যতম সৎ রাজনীতিবিদ হিসেবে যিনি প্রশংসিত ও আলোচিত তিনি ‘কমল’-যিনি একাধারে নির্ভিক সৈনিক অপরদিকে সফল রাষ্ট্রনায়ক এবং এই অভুতপুর্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এ দেশের মানুষের অন্যতম প্রিয় নাম হয়ে উঠেন মেজর জিয়া হতে ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া’ যার ডাক নাম কমল।
চল্লিশ বছর পরে এই দেশপ্রেমিক নিয়ে স্পষ্ট করে সবকিছু কি বলা যাবে! বা কলম কি অস্পষ্ট হতাশার সুর তুলে বলছে না যে, কি জানি কি হয়! তবুও যেটুকু পারছি এবং বলছে মানুষ তার জন্য শুকরিয়া আল্লাহপাক এর দরবারে এবং ধন্যবাদ সংশ্লিষ্ট সকলকে।
প্রথমেই বলেছি সাদামাটা মানুষের প্রিয় নেতা এমনিতেই জনপ্রিয় হয়ে গেছেন তা কিন্তু নয়, বরং তাঁর যাপিত জীবন যখন স্পষ্ট হয়েছে মানুষের কাছে তখনই তিনি প্রিয় হয়ে সবার মুখে উচ্চারিত হন ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া’ বলে এবং সেদিন যেমন আলোড়িত করেছেন মানুষের হৃদয় আজও তেমনি জেনে উদ্বেলিত হয় তরুণ মন।
মেজর জিয়া হতে প্রেসিডেন্ট জিয়া এ নাতিদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে তাঁকে অনাহুত বিতর্ক থেকে বহু অপবাদ মাড়িয়ে এগুতে হয়েছে দেশের তরে মানুষের জন্য, এজন্যই অকুতোভয় দুঃসাহসী যোদ্ধা তাঁর রাজনৈতিক পথকেও বিজয় সোপানে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন মানুষের কল্যাণে। তাইতো অল্প দিনের গল্প আজ ইতিহাসের বর্ণালী অতীতই কেবল নয় বরং আগামীর এগিয়ে যাবার প্রেরণা ও মাইলফলক।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা অনুল্লেখ করেও যদি একটি কথা বলা যায় তবে সেটি হচ্ছে প্রেসিডেন্ট জিয়া’র হাত ধরেই আজকের মধ্যে প্রাচ্যের শ্রমবাজার, গার্মেন্টস শিল্প, সেচ ব্যবস্থা, ধান রপ্তানি, চা শিল্পের ইউরোপ সহ অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়া তদুপরি তেলের বাজারে হস্তক্ষেপ করে এটিকে মুসলিম বিশ্বের হাতিয়ারে পরিণত করা, ইরাক-ইরান যুদ্ধ থামিয়ে দেয়া, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মর্যাদার ভিত্তিতে পারষ্পরিক সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করা, ভারতের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক আত্মমর্যাদা নিয়ে সাবলীল করা, সার্ক এর স্বপ্নদ্রষ্টা, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে পুনরায় একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনা তথা দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, একটি অবলোপিত রাজনৈতিক দলকে পুনর্জীবিত করা, সর্বোপরি দেশের প্রশাসনের বাহাদুরিকে বিলুপ্ত করার প্রয়াসে মানুষের দুয়ারে নিয়ে যাওয়া, সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়ে ঢাকা নয় আটষট্টি হাজার গ্রাম চষে বেড়ানো এবং রাজনীতিতে সৎ মানুষের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চালু করে বিশ্ব দরবারকে বুঝিয়ে দেন ভিক্ষের ঝুলি নয় বরং আত্মপ্রত্যয় ও ঝকমকে তথা বলিষ্ঠ ভবিষ্যতের দিকেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হাতে নিয়ে অবিরাম তিনি শ্রম দিয়েছেন পাশাপাশি খেলাধুলা জাতির পরিচিতি বিশ্ব দরবারে তুলে দেয় সেটি আমলে নেন এবং এটি-যে বিকাশমান তারুণ্যের সবল সুঠাম স্বাস্থ্যের গঠনে মুলতঃ দেশকেও সুস্থ থাকতে সাহায্যে করে তা তিনি অনুধাবন করেন। সেই লক্ষ্যে গোটা দেশে ক্রীড়া সপ্তাহ প্রচলন করেন এবং বাংলাদেশে জনপ্রিয় ফুটবল এগিয়ে নেবার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে এএফসি চ্যাম্পিয়নশীপ আয়োজন করেন, যা মুলত ১৯৭৯ সালের ফিফা বিশ্ব যুব ফুটবলের কোয়ালিফাইং টুর্নামেন্ট হিসেবে আয়োজিত হয়। যতদূর মনে পড়ে তখন দক্ষিণ কোরিয়া চ্যাম্পিয়ন হয় এবং সৌদি আরবের খেলোয়াড় দাইয়ুস মোহাম্মদ এ দেশে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।
তাই প্রেসিডেন্ট জিয়া একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে কাজ করে গেছেন প্রত্যেক সেক্টরে। একজন স্বপ্নবাজ দূরদর্শী নেতা ছিলেন জিয়া, এটি নির্মোহ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলে সকলের নিকট যেমন স্পষ্ট হবে তেমনি সাদামাটা দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
তাঁর খাল খনন কর্মসূচি উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন যশোরের শার্সা থানার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে, তখন বিবিসি সাংবাদিক প্রশ্ন করেন সারাদেশে বহু স্থান থাকতে এই সীমান্তে কেন! প্রেসিডেন্ট জিয়া উত্তর দেন- “আমার কোদালের আওয়াজ যেন দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে” এমনই বলিষ্ঠ করে গড়তে চেয়েছিলেন প্রিয় স্বদেশ ও তাঁর পররাষ্ট্র নীতি। এই খাল খনন কর্মসূচি বাংলাদেশের সেচ ব্যবস্থায় বিপ্লব সাধন করেছে।
তাঁর সততা নিয়ে নিন্দুকেরা একটিও প্রশ্ন তুলতে পারেনি, হ্যাঁ তিনি দুই টাকার মেজর (!) বা সামান্য এক প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী (!) অথবা সামরিক শাসক এমন আরও কিছু তকমা তাঁকে দেয়া হয়! কিন্তু সততার জন্যে তিনি যে উজ্জ্বল উদাহরণ সেটি দেশের বড় অংশ জোর গলায় বলেন আবার অন্য কেউ মিনমিনে স্বরে বলেন, কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। তাই এ কথা আর অতিকাহন নয় বরং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এ দেশের শত পঙ্কিলতা সত্বেও তাঁর নিজের অবস্থান এই বলে প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন যে, রাষ্ট্রের কর্ণধার কাউকে সৎ বলতে হলেই যার নাম নির্মোহভাবে সর্বাগ্রে উপস্থাপিত হবে-তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়া।
এই দেশে শের-ই-বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী, মৌলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মেজর তথা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অবিনশ্বর হয়ে ইতিহাসে ঠাঁই নিয়েছেন। এ বিষয় নিয়ে আজ-কাল যতই বিতর্ক হোক একদিন এইসব কুতর্ক কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে এবং ইতিহাস তার বরপুত্রদের স্ব-স্ব স্থানে আসীন করবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা উল্লেখ করলে বোঝা যায় তাঁর সাহস তেজস্বীচেতা কতো সুনিপুণ ও দেশমাতৃকার তরে নিবেদিত। দু’টি ক্রান্তিলগ্নে দু’বারই সাহস বিচক্ষণতা ও ন্যায়নিষ্ঠ কর্মদক্ষতায় বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিলেন যে বীর, তিনি জিয়াউর রহমান! মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে যে ১১জন সেক্টর কমান্ডার্সের নাম ছিল পাক হানাদারদের আতঙ্ক, তাঁর প্রথমটিই মেজর জিয়া! তিনটি ব্রিগেড গঠন হয়েছিল পুরো যুদ্ধে তার প্রথমটির কমান্ডিং এই কমলের হাতেই ছিল! দ্বিতীয় ব্রিগেড গঠন হয়েছিল সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে, আর ‘কে’ ফোর্স গঠিত হয় অক্টোবরে।
মুক্তিযুদ্ধে গড়ে উঠা জেড ফোর্স তথা মেজর জিয়া’র কালুরঘাট হতে যশোর তথা সিলেট সীমান্তের বীরত্বের কাহিনী মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল ৭১’র দিনগুলোতে এবং তার প্রভাবে গোটা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণ সঞ্চারিত করেছিল! এখানে উল্লেখ করা উচিৎ যে, আরেক ব্রিগেড কমান্ডার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ‘কে’ ফোর্স অল্পসময়ে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল মুক্তিযুদ্ধে। বিশেষ করে যশোরের খালেদ মোশাররফের যুদ্ধকে সমরবিদরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জেনারেল মন্টেগোমারি ও জেনারেল রোমেলের যুদ্ধের সাথে তুলনা করেন ( রেফারেন্স : O General my General) অথচ এইসকল বীরদের তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে না ধরে নানান রকমারি পণ্যের পশরা সাজিয়ে বসে আছি আমরা, আফসোস।
সৈনিক জিয়াউর রহমান এর জীবন যুদ্ধের মধ্যেই বেড়ে ওঠা, কারণ ১৯৬৫ সালে পাঞ্জাবে যখন তিনি কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে খেমকারান সেক্টরে যুদ্ধরত তখন তাঁর কমব্যাট যুদ্ধে ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে যে বীরত্বের সাথে লড়াই করেছেন তার প্রতি স্বীকৃতিস্বরূপ তৎকালীন পাকিস্তান সরকার প্রধান ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান জিয়াউর রহমানকে ‘হিলাল-ই-জুররাত’ খেতাবে ভূষিত করেন এবং এটি ছিল ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম গ্যালান্টারী এওয়ার্ড, পয়ষট্টি সালের পাক-ভারত যুদ্ধে খেমকারান সেক্টর ছিলো ভয়ঙ্কর যুদ্ধ ময়দান। তাঁর কোম্পানি অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে এই ময়দানে লড়াই করায় যুদ্ধ শেষে তিনটি ‘সিতারা-ই-জুরাত’ ও আটটি ‘তমঘা-ই-জুরাত’ সামরিক খেতাবে ভূষিত হয় ক্যাপ্টেন জিয়ার কোম্পানি। তিনি তখন পাকিস্তান মিলিটারীতে আলোচিত হয়ে উঠেন এবং মেজর পদোন্নতি পান ও পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানে বদলী হন।
বীর যে, সে যে-ই প্রান্তেই লড়াই করে তাঁর লড়াকু মানসিকতার পরিবর্তন হয়না বরং মাতৃভূমির পানে যখন টান পড়ে তখন তাঁর সবটুকু নির্যাস ঢেলে দিতে পাগলপারা হয়ে যায় এবং সেই লক্ষ্যেই সেদিন পাগলপারা একদল সাহসী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার সৈনিক নিয়ে গর্জে উঠে বলেছিলেন – We Revolt. এই মহান মুক্তিযুদ্ধের লড়াই করে আরও বীরদের মতো পেয়েছিলেন জীবিতদের শ্রেষ্ঠ সামরিক পদক ‘বীর উত্তম’ খেতাব।
কালুরঘাট, কামালপুর, নকশী সীমান্ত, ঘাসিপুর, বাহাদুরাবাদ, দেওয়ান গঞ্জ, টেংরা টিলা, চিলমারী, রৌমারী, হাজি পাড়া, ছোটখাল, গোয়াইনঘাট, গোবিন্দগঞ্জ, সালুটিকর এয়ারপোর্ট, ধলাই চা বাগান, সিলেট, শাহবাজপুর, কানাইঘাট-জকিগঞ্জ, ফুলতলা, বড়লেখা সহ বিভিন্ন সীমান্তে মেজর জিয়া তথা জেড ফোর্স যে অকুতোভয় দুঃসাহসী যুদ্ধ করেছেন তার স্বাক্ষর বাংলাদেশের বিজয় পতাকায় পতপত করে উড়ছে! কামালপুরের প্রথম যুদ্ধে তাঁর কৌশলের সমালোচনাও আছে, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় জেড ফোর্স। তবে তিনি এ ব্যাপারে বলেছেন-কখনো কখনো মরতেও হয়, হারতেও হয়-তবেই চুড়ান্ত বিজয় সুনিশ্চিত হয়। একঝাঁক দুরন্ত সাহসী সৈনিক ছিলো জেড ফোর্সে- ক্যাপ্টেন অলি আহমদ (ব্রিগেড মেজর) মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী (কমান্ডিং অফিসার),
মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর আমিনুল হক, মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ, মেজর জিয়াউদ্দিন, ক্যাপ্টেন বজলুল গণি পাটোয়ারী, ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান, ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন, ক্যাপ্টেন মহসিন, ক্যাপ্টেন আনোয়ার, ক্যাপ্টেন আকবর, ক্যাপ্টেন মহসিন উদ্দিন, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী সহ আরও বেশকিছু অফিসার। এসব নাম উল্লেখ এজন্য করছি এতো অকুতোভয় দুঃসাহসী অফিসারদের যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁকে নিয়ে যখন কিছু দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতা প্রশ্ন তোলেন তখন জিজ্ঞেস করতে হয়-একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় উনারা কি উত্তর দিবেন, আফসোস।
কানাইঘাট যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এক গভীর রাত্রিতে আলাপচারিতায় সঙ্গীয় ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন বীর বিক্রমকে উদ্দেশ্য করে জিয়া বলেছিলেন – “হাফিজ, পাকিস্তানিতো তাড়ালাম কিন্তু এখন না ভারতীয়দের তাড়াতে হয়”! কি প্রখর দুরদৃিষ্ট সম্পন্ন ছিলেন এই সমরনায়ক-একবার ভেবে দেখুন!
অপরদিকে যখন দেশ নেতৃত্বশূন্য, রাষ্ট্র পথহারা ঠিক সেই সময়ে আবার ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন উনিশশো পচাত্তরের সাতই নভেম্বর। পচাত্তরের পনের আগস্টের কালিমাময় বিয়োগান্ত অধ্যায় শেষে অক্টোবর-নভেম্বরে যখন দেশ নেতৃত্বহীন হয়ে ক্রমেই ক্ষমতার দ্বা›িদ্বক রক্তাক্ত লড়াইয়ের দিকে অগ্রসরমান তখনই জাতি আবার শুনে সে-ই অমিয় কন্ঠ, আর সাধারণ মানুষ ও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী একত্রিত হয়ে বিপ্লবের মাধ্যমে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এর নেতৃত্বে আবার ঐক্যবদ্ধ হলে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা হয়। যাকে ঐতিহাসিক সাতই নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব হিসেবে বলা হয়, যদিও এখন এটি আর রাষ্ট্রীয় দিবস নয়। তথাপি এই দিন বিশেষ করে তেসরা নভেম্বর হতে সাত নভেম্বর ১৯৭৫ দেশে কি হয়েছিল এবং কোন্ প্রেক্ষাপটে এর উত্থান সবকিছুর কৈফিয়ত ও নির্মোহ বয়ান মুছে যাবে না এবং ইতিহাসের অমোঘ বিধানে লিপিবদ্ধ হবে যথাসময়ে।
রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকাকালীন প্রতিবেশী রাষ্ট্র যে এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান সেটি অনুধাবন করেছিলেন বলেই শান্তি সহমর্মিতা বজায়ে পারষ্পরিক মর্যাদার ভিত্তিতে একটি সহাবস্থান তৈরি করতে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পারস্পরিক অবিশ্বাস যখন তীব্র এবং শ্রীলঙ্কা আফগানিস্তান পাকিস্তান ও ভারতে insurgency যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তথা সামরিকভাবে দুর্বল দেশ ভুটান নেপালকে যাতে কেউ আগ্রাসী লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করতে না পারে বরং বিশ্বাস ও পারস্পরিক মর্যাদায় একে অপরের পরিপুরক হয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করে বিশ্ব মানচিত্রে বুক উঁচিয়ে দাড়াতে সক্ষম হয় সেই লক্ষ্যে তিনি ‘সার্ক’ গঠনে অগ্রসর হন এবং এ লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। ভারতকে আমলে নিয়ে যে এটি এগিয়ে নিতে হবে তা অনুধাবন করে মোরারজি দেশাই সরকার এর সাথে মর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলেন! প্রেসিডেন্ট জিয়াই ফারাক্কার পানি যার যার হিস্যা অনুপাতে বন্টন করতে সফল হন। অথচ আজ তথাকথিত সুনিবিড় বন্ধুত্ব থাকা সত্তে¡ও উত্তরাঞ্চল কখনো হয় মরুভূমি না হয় প্লাবন, কেউ কি ভাবি এ কিসের আলামত!
সার্ক হতে মধ্যপ্রাচ্যে, ওআইসি, ইউরোপ- আমেরিকার সাথে তার ছুটে চলা ও পররাষ্ট্র নীতি পর্যালোচনা করলে তাঁর মাঝে এক বিশ্বনেতার গুণাবলী খুঁজে পাওয়া যায়। সম্ভবত এ কারণেই সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী কোনভাবেই চায়নি মুসলমানদের জগতে এমন ধীমান রাষ্ট্রনায়ক বেঁচে থাকুক, তাই যে পরিণাম তারা চেয়েছে তারই ফলস্বরূপ সাদামাটা সৎ মানুষের নির্ভীক সৈনিক নেতার রক্তাক্ত বিদায় হলো, মুসলিম বিশ্ব হারালো এক পরামর্শক এবং দেশ হারালো রাষ্ট্রনায়ক।
সৈনিক হতে ‘রাষ্ট্রনায়ক জিয়া’ পত্রিকার একদিনের পাতায় তুলে ধরা কেবলই পন্ডশ্রম মাত্র, তবে পাতায় পাতায় শোভিত করে নেয়াও আগামীর ইতিহাসে কিছু না কিছু পালক যোগ করা বটে।
ব্রিগেড কমান্ডার জিয়াউর রহমান হতে ‘কে’ ফোর্স ‘এস’ ফোর্স তথা এগারো সেক্টর কমান্ডার এবং সকল সাব-সেক্টর কমান্ডার ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী সহ সকল সমরনায়ক এর ব্যাপারে যত দ্রুত বর্তমান প্রজন্ম জানবে ততই দেশের জন্যে মঙ্গল।
মেজর জিয়াউর রহমানের সেই ঐশী ডাক কেবল কাগজের পাতায় সীমাবদ্ধ ছিলনা বরং টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া – রুপসা থেকে পাথুরিয়া রক্তাক্ত রণাঙ্গনের লাখো শহিদের অফুরন্ত ত্যাগ ও বলিদানের ফসল আমাদের স্বাধীনতা। তাঁকে বাদ দিয়ে যেমন ইতিহাস হবে না, তেমনি সকল সমরনায়ককে স্মরণ না করে দেশের বিজয়গাঁথা পূর্ণতা পাবেনা। দেশের ঊষালগ্নের সব ক্রান্তিকালে অসম সাহসিকতা বিচক্ষণতা এবং সততার জন্যে এই রাষ্ট্রনায়ক ইতিমধ্যেই ইতিহাসে অমরত্ব পেয়েছেন, এমন বীরের চল্লিশতম শাহাদাৎ বার্ষিকীতে তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।