পথশিশুদের মূলধারায় ফিরাতে হবে
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ মে ২০২১, ৮:৩২:৫২ অপরাহ্ন
ইসমাইল মাহমুদ
পথশিশুরা আমাদের সমাজের চোখে এক অবাঞ্ছিত মানুষ। আমাদের দেশে বর্তমানে কতজন পথশিশু রয়েছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই! বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা পথশিশুদের নিয়ে গবেষণা করছে। তাদের গবেষণা মতে বর্তমানে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৩৫ লাখ পথশিশু রয়েছে। আর সরকারি হিসেব মতে দেশে পথশিশুর সংখ্যা ১৫ লাখ।
সরকার ২০০৫ সালে দেশের ৬টি বিভাগীয় শহরে পথশিশুদের জরিপ করে। সে সময়ে জরিপ অনুযায়ী দেশে পথশিশুর সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৭ লাখ। ২০১৪ সালে দেশে পথশিশুর সংখ্যা হবে আনুমানিক ১২ লাখ এমন ধারণা দেওয়া হয়েছিল ওই জরিপে। সে ধারণা থেকে কয়েকগুণ বেশি পথশিশু বর্তমানে বাংলাদেশে রয়েছে বলে বেসরকারি সংস্থাগুলোর দাবি। এসব পথশিশুদের অধিকাংশই পরিবার বিহীন। কোন কোন পথশিশু নানা কারণে পরিবার থেকে পালিয়ে রাস্তায় বা খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। আবার কোন কোন পথশিশু নিজের পরিবারের বাড়তি আয়ের জন্য এ দলে যোগ দেয়। গ্রামাঞ্চলের অনেক পরিবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়ি হারিয়ে এসে ঠাঁই নেয় দেশের বিভিন্ন শহরের বস্তি ও রাজপথগুলোতে। এই পরিবারগুলো চরম দারিদ্রতার শিকার। এ দারিদ্রতার কারণে অনেক সময় বাধ্য হয়ে পরিবারের শিশুসন্তানদের একটি বড় অংশ পরিবারের বাড়তি আয়ের জন্যই রাস্তায় নেমে আসে এবং পথশিশু হিসেবে পরিগণিত হয়।
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের রাস্তায় ফুলবিক্রেতা, নানা ধরণের পণ্যের ভাসমান বিক্রেতা বা হকার অথবা কাগজ-ময়লা কুঁড়ানো টোকাই হিসেবে অধিকাংশ পথশিশু কাজ করে। এখন প্রশ্ন হলো বড় হয়ে এই পথশিশুদের গন্তব্য কোথায়? যে শিশুটির পরিচয় আজ পথশিশু তার এ বয়সে স্কুলে থাকার কথা। কিন্তু জীবিকার প্রয়োজনসহ নানা কারনে তাকে নেমে আসতে হলো রাস্তায়। নিজের নামের আড়ালে তার নাম হয়ে গেল পথশিশু। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে তারা পুরোপুরি বঞ্চিত। তাদের অন্ন-বস্ত্রের নিশ্চয়তা নেই। অনেক শিশুর জন্ম রাস্তায়-ফুটপাতে। বসবাসও রাজপথেই। তাদের রাজপথ থেকে তুলে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তাদের দ্রুত সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে না পারলে একটা সমাজে নেমে আসতে পারে চরম বিপর্যয়।
পথশিশুদের নিয়ে গবেষণা করা একাধিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের শহরগুলোতে বস্তিবাসী অথবা নিন্ম আয়ের পরিবারগুলোতে প্রতিনিয়তই বেকারত্ব, শিক্ষার অভাবসহ নানা কারণে সামাজিক এবং পারিবারিক কলহ চলতে থাকে। অনেক নি¤œ আয়ের পরিবারে বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ যেন ডাল-ভাত। নি¤œ আয়ের পরিবারগুলোতে বিশেষ করে বস্তির বাসিন্দাদের একাধিক বিয়ের ঘটনাতো রয়েছেই। এ নিয়ে প্রতিনিয়তই পরিবারগুলোতে পারিবারিক কলহ বিদ্যমান। পারিবারিক কলহের মতো ঘটনাগুলো শিশুদেরকে অনেক বেশি রেখাপাত করে। বস্তি কিংবা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে খুব ছোট বয়সে পারিবারিক কলহ কিংবা নির্যাতনের শিকার হওয়া শিশুদের একটি বড় অংশ ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ে। তাদের একটা বড় অংশ পথশিশু হয়ে ওঠে। এরা রেলওয়ে স্টেশন, বাস স্টপেজ, লঞ্চ টার্মিনাল থেকে শুরু করে শহরের ফুটপাত, ওভারব্রিজ অথবা পার্কগুলোতে রাত কাটায়। মৌসুমভেদে তাদের বসবাসের স্থান পরিবর্তন হয়, শুধু পরিবর্তন হয় না তাদের ভাগ্যের! সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন শিশুর প্রতিদিন যে পরিমাণ ঘুম দরকার, দিনের পর দিন সেটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পথশিশু নামের সমাজের চোখে অবাঞ্ছিত এই শিশুরা। ফলে পথশিশু নামের এই শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য পড়েছে চরম সংকটে।
অর্ধাহার আর অনাহার দেশের পথশিশুদের নিয়তসঙ্গী। রাজপথে বসবাসকারী পথশিশুদের প্রায় সবাই চরম অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করছে। ভাগ্য বিড়ম্বিত এসব শিশুদের নেই পুষ্টিকর বা সাধারণ মানের খাবারের নির্দিষ্ট কোন স্থানও। রাস্তার পাশের খোলা জায়গাই তাদের একমাত্র অবলম্বন। কোন কোন পথশিশু তিনবেলা খাবারই জোগাড় করতে পারে না। পথশিশুদের অধিকাংশই অভুক্ততার কারণে জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পথশিশুদের ৮২ শতাংশই সারা বছর নানা ধরণের পেটের পীড়ায় আক্রান্ত থাকে। তারা প্রায়ই পাতলা পায়খানা, ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটব্যথা ইত্যাদি বিভিন্ন রোগে ভুগে থাকে। ময়লা-আবর্জনার মধ্যে কাজ করা ও খাবারের আগে হাত না ধুয়ে খাবার খাওয়ার ফলে তাদের এই রোগগুলিতে বার বার ভুগতে হয়। এছাড়া খোলা মাঠে বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পায়খানা ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত না ধোয়া অথবা হাত ধোয়ার ক্ষেত্রে কোন কিছু ব্যবহার না করা; তাদের অসচেতনতার জন্যে একজনের ডায়রিয়া হলে ডায়রিয়ার জীবাণু আশে-পাশের অন্যান্য শিশুদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি নোংরা পরিবেশে থাকার কারণে এদের অধিকাংশই চর্মরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত। রোগাক্রান্ত এসব পথশিশুদের জন্য কোন চিকিৎসার ব্যবস্থাও নেই। প্রতিনিয়তই সমাজের লাঞ্ছনা ও বঞ্ছনার শিকার এই শিশুদেরকে নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনের সংখ্যাও একেবারে নগন্য।
পথশিশুরা ক্ষুধার জ্বালা, একাকিত্বের কষ্ট নিবারণসহ নানা কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের অধিকাংশই ড্যান্ডি নামক এক ধরণের মাদক সেবনে অভ্যস্ত। পথশিশুদের ভাষায় ড্যান্ডি সেবনে ঝিমুনি আসে, ঘুম আসে। তখন ক্ষুধার কথা মনে থাকে না। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাদকে আসক্ত। সংগঠনটির তথ্যানুযায়ী ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্পট রয়েছে যেখানে ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী পথশিশুরা মাদক সেবন করে থাকে। পথশিশুরা সাধারণত গাঁজা, ড্যান্ডি, পলিথিনের মধ্যে গামবেল্ডিং দিয়ে ও পেট্রল শুঁকে নেশা করে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ) ২০১৬ সালে পথশিশুদের নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয় পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু প্রতিদিন গোসলহীন থাকে, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই ও ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থতায় ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না।
দেশের পথশিশুরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে যোজন-যোজন দূরে অবস্থান করছে। পথশিশুদের একটি বড় অংশের অক্ষরজ্ঞান নেই। কিছু কিছু পথশিশুদের অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও), অন্য কোনো সহায়ক প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু তাও প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় এসব পথশিশু সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। এসব পথশিশুরা একটু বড় হবার পর শ্রমিক, বাসের হেলপার, চালকসহ নানা ধরনের পেশায় যুক্ত হয়ে জীবন-জীবিকার সংস্থান করে। মেয়ে পথশিশুদের অধিকাংশই তাদের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে নানা লাঞ্ছনার শিকার হয়ে এক সময় সমাজের অচ্যুত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠছে।
বর্তমানে দেশের প্রায় সব শহরে পথশিশুদেরকে নিয়ে কাজ করার লক্ষ্যে এগিয়ে আসছে অনেক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান। তারা পথশিশুদের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।
পথশিশুরা শুধু কি তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত? না তা নয়। পথশিশুদের অধিকাংশই সামাজিক নানা অনাচারের শিকার হচ্ছে। একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তথ্যমতে, করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবের মধ্যেও গত বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে দুই শতাধিক মেয়ে পথশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটিরও বেশি। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে দেশে পথশিশু রয়েছে প্রায় ৩৫ লক্ষ। সে হিসেব যদি বাস্তবসম্মত হিসেবে আমরা ধরে নেই তবে প্রতি প্রায় ৫০ জন মানুষের মধ্যে একজন মাত্র পথশিশু। আমরা প্রতি ৫০ জন মানুষ যদি একজন পথশিশুর দায়িত্ব নিয়ে তাদের সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি তবে দেশে আর কোন পথশিশু থাকবে না; থাকার কথা নয়। আর এটি কোনভাবেই কঠিন কোন কাজ নয়। সুবিধাবঞ্চিত এই পথশিশু নামের আমাদের আগামীর প্রজন্ম শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে শুধু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাই নয়, এর পাশাপাশি সমাজের সকলস্তরের সাধারণ মানুষ পথশিশুদের প্রতি একটু সহানুভূতি দেখালে আমাদের এ সমাজটা আরো সুন্দর ও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠবে এতে কোন সন্দেহ নেই।