দুই মন্ত্রীর দ্বন্দ্বে থমকে যাচ্ছে সিলেটের উন্নয়ন
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জুন ২০২১, ১১:০১:৫৮ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার :
দুই প্রভাবশালীর মন্ত্রীর সমন্বয়হীনতা, দ্বন্দ্ব ও দুরত্বের কারণে থমকে যাচ্ছে সিলেটের উন্নয়ন কার্যক্রম। সিলেটে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প কাগজে কলমে নেয়া হলেও তা বাস্তবায়নে দেখা দিয়েছে চরম ধীরগতি। বছরের পর বছর আশ্বাসের বাণী শোনানোর পরও আলোর মুখ দেখছেনা বড় বড় প্রকল্পগুলো। এ নিয়ে অন্তহীন ক্ষোভ, হতাশা ও উদ্বেগ সিলেটের সচেতন মহলে।
সিলেটের সুশিল সমাজের অনেকে মনে করেন, মন্ত্রীদের দুরত্বের কারণে ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে সিলেট। তাদের দ্বন্দ্বের সুযোগ নিচ্ছে সিলেটের উন্নয়ন বিদ্বেষী চক্র। ফলে উন্নয়নের দৌড়ে বার বার হোঁচট খাচ্ছে সিলেট। অন্যান্য অঞ্চলে যেখানে মেগা প্রজেক্ট দ্রুত বাস্তবায়ন হচ্ছে সেখানে উল্টো চিত্র সিলেটে। তারা মনে করেন, সফল নেতৃত্বের কারণে ঢাকা-চট্রগাম চারলেন প্রকল্প এখন দৃশ্যমান। সিলেট-ঢাকার চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ কুমিল্লা-নোয়াখালী মহাসড়ক প্রকল্প এগিয়ে চলেছে। অথচ ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক প্রকল্প এখনো অন্ধকারের মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে।
একইভাবে সিলেটের উন্নয়ন থমকে গিয়েছিলো ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে তৎকালীন স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদের দ্বন্দ্বের কারণে। সেসময় একজন একটি মেগা প্রজেক্ট নেন তো, অন্যজন বাধার প্রাচীর হয়ে দাড়ান। ফলে সিলেট তখন কাঙ্খিত উন্নয়ন বঞ্চিত হয়। তাদের তখনকার দ্বন্দ্ব ছিলো ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’।
যেন তাদের সেই পথ অনুসরণ করেই এগুচ্ছেন সিলেট ও সুনামগঞ্জের দুটি আসন থেকে নির্বাচিত বর্তমান দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী।
সংশ্লিষ্ট এধাধিক সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান এই দুই মন্ত্রীর কেবল দেখা হয় মন্ত্রীপরিষদ মিটিংয়ে। এর বাইরে তাদের দুজনের চোখের দেখা কিংবা কথা হয়না বললেই চলে। একজন অপরজনকে এড়িয়ে চলেন। একজনের উন্নয়নের ক্রেডিট অপরজন দিতে চাননা। তবে এর মাঝে একজন উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে। তাঁর হাত ধরেই সুনামগঞ্জ এখন অনেকটাই উন্নয়নের মহাসড়কে। তাঁর কারণেই সুনামগঞ্জ হয়েছে মেডিকেল কলেজ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পও কাগজে কলমে এগিয়েছে অনেকদূর। এয়াড়া তিনি প্রচুর ব্রিজ-কালভার্ট, রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন করেছেন। স্বপ্ন দেখাচ্ছেন রেললাইন এবং বিমানমন্দরেরও। তবে উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে অপর মন্ত্রী। এখনো তাঁর মেগা কোন প্রকল্প দৃশ্যমান হয়নি। যা হচ্ছে তা কেবল রুটিন উন্নয়নই বলা চলে। এ নিয়ে গত পরশু সভা করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সিলেট উন্নয়ন পরিষদ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের অনেকেই বলছেন, নেতৃত্বের অদূরদর্শীতা ও মন্ত্রীত্বের দ্বন্দ্বে আলোর মুখ দেখছেনা সিলেট-ঢাকা চারলেন প্রকল্প। সিলেটের মন্ত্রীদের দ্বন্দ্ব আর দূরত্বের কারণেই অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ এই মহাসড়কটি এখনো অদৃশ্য ফিতায় বন্দি। মন্ত্রীদের দ্বন্দ্বের সুযোগে আমলাতন্ত্রের পেটে এখন এই মহাসড়ক। অথচ উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর বিন্দুমাত্র কার্পণ্যতা নেই। তাই তিনি এটি একনেকে পাশও করেছেন। আর তাদের দুরত্বের কারণে বছরের পর বছর ধরে আলোর মুখ দেখছেনা ঢাকা-সিলেট চারলেন প্রকল্প।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, স্বপ্নের সিলেট-ঢাকা চারলেন প্রকল্প এখনো সুদূর পরাহত। কারণ যেখানে মহাসড়কের ২১০ কিলোমিটারের টেন্ডার হওয়ার কথা, সেখানে গত ২৯ এপ্রিল ঢাকা থেকে নরসিংদী পর্যন্ত মাত্র ৩৫ কিলোমিটার টেন্ডার আহবান করেছে সড়ক ও জনপথ। নরসিংদী থেকে সিলেট পর্যন্ত এখনো টেন্ডার আহবান করা হয়নি। এটিতে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে ওই সূত্র। ধারণা করা হচ্ছে, ঢাকা থেকে নরসিংদী পর্যন্ত কাজ হওয়ার পর সিলেট অংশ দীর্ঘসূত্রিতায় পড়তে পারে। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, অনৈক্য ও সমন্বয়হীনতায় সিলেট-ঢাকা চারলেন প্রকল্পও হারিয়ে যেতে পারে অন্ধকারে।
তবে সড়ক ও জনপথ বলছে, ৬ প্যাকেজে এই চারলেন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। প্রথম ধাপে ঢাকা-নরসিংদী ৩৫ কিলোমিটার, ২য় ধাপে নরসিংদী-ভৈরব ৩৩ কিলোমিটার, ৩য় ধাপে সরাইল-বুদন্দিপুর ২৮ কিলোমিটার, ৪র্থ ধাপে বুদন্দিপুর-বাহুবল ২৮ কিলোমিটার, ৫ম ধাপে বাহুবল-শেরপুর ব্রিজ ৩৫ কিলোমিটার ও ৬ষ্ঠ ধাপে শেরপুর-পীর হবিবুর রহমান চত্বর সিলেট ৩৬ কিলোমিটার সড়ক বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্পের আওতায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে আটটি উড়ালসেতু, ২২টি ওভারপাস, পাঁচটি রেলওয়ে ওভারপাস, ৬৯টি ছোটবড় সেতু, দশটি আন্ডারপাস, তিনটি সড়ক মোহনা উন্নয়ন এবং ২৯টি ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করা হবে।
কিন্তু ৬ প্যাকেজের কথা বলা হলেও এখনো নরসিংদী থেকে সিলেট অংশের টেন্ডার হয়নি। হয়নি জমি অধিগ্রহন। অথচ জুনের মধ্যে প্রকল্প অনুমোদন না হলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চারলেন প্রকল্পে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) টাকা ফেরত চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এডিবি এরইমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে, নির্মাণ প্রকল্প জুনের মধ্যে অনুমোদন হলে জুলাইতে অর্থায়ন বিষয় নিয়ে আলোচনা সম্পন্ন করে সেপ্টেম্বর থেকে অর্থ ছাড় করতে প্রস্তুত তারা। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় মহাসড়ক প্রকল্পে বিলম্ব হলে তাদের অর্থ এখান থেকে সরিয়ে অন্য প্রকল্পে নেবে এডিবি।
সূত্র জানায়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই করতে ৪৫-৬০ দিনের সময় নেবে। যেখানে জুনের মধ্যে মহাসড়কের নকশার অনুমোদন চেয়েছে ব্যাংকটি।
শুধু সিলেট-ঢাকা মহাসড়কই নয়, সিলেট বিমানবন্দর থেকে বাদাঘাট বাইপাস চারলেনেও দেখা দিয়েছে দীর্ঘসূত্রিতা। দীর্ঘদিন ধরে সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার দাবি সিলেটের মানুষের। সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে এ বিষয়ে প্রস্তাবনাও পাঠানো হয়েছিল সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু সেই প্রস্তাবনা রহস্যজনক কারণে পাচ্ছে না গতি। ফলে সিলেট নগরীর মধ্যে পাথরবাহী ট্রাকে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে, ট্রাকচাপায় ঝরছে প্রাণ, দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন নগরবাসী। এখানেও সিলেটের নেতৃত্বের দুর্বলতা ও মন্ত্রীদের সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন অনেকে।
একইভাবে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পও থমকে আছে বলে দাবী করছে বিভিন্ন সূত্র। ২০১৮ সালে বিমানবন্দরে ৩৪ হাজার ৯১৯ বর্গমিটারের অত্যাধুনিক আন্তর্জাতিক মানের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী কাজও পায় একটি চীনা কোম্পানী। এই প্রকল্পও গতি হারিয়েছে বলে দাবী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া মন্ত্রীদের অনৈক্যের কারণে সিলেট-সুনামগঞ্জ রেললাইন প্রকল্প, সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় প্রকল্পসহ আরো অনেক সম্ভাবনাময় প্রকল্পও ঝুলে আছে। দুই মন্ত্রীর দৃরত্ব আরো প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে দু’দিন আগে রেলমন্ত্রীকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি ডিও লেটারে। সুনামগঞ্জ রেললাইন স্থাপনে যেখানে পরিকল্পনামন্ত্রী পরিকল্পনা নিয়েছেন, সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডিও অনেকেরই মাঝে প্রশ্নের সুষ্টি করেছে। কেউ কেউ বলছেন, এটি তাদের দ্বন্দ্বেরই প্রকাশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারী দলের সিলেটের একাধিক নেতা বলেছেন, ঢাকায় সিলেটের নেতাদের অনৈক্যের সুযোগ লুফে নেয় সিলেট বিদ্বেষী চক্র। অথচ তা বুঝেও বুঝেননা আমাদের নেতারা। এভাবে চলতে থাকলে ১৯৯৬-২০০১ সালে যেভাবে স্পীকার-পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্বন্দ্বে কাঙ্খিত উন্নয়নের সুফল পায়নি সিলেট, একইভাবে এই সময়েও উন্নয়নের মহাসড়ক থেকে ছিটকে পড়বে সিলেট। মন্ত্রী ও নেতাদের এখনই বুধোদয় না হলে ভবিষ্যতে প্রত্যাশিত শ্রদ্ধা ও সম্মান থেকে বঞ্চিত হবেন তারা নি:সন্দেহে।