প্রিয় ভাগ্নের চিরবিদায় : কিছু কথা, কিছু স্মৃতি
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ জুলাই ২০২১, ১০:২৯:৫১ অপরাহ্ন
মুকতাবিস-উন-নূর
জামিল হোসেন চৌধুরী, আমার বড় ভাগ্নে। গত ৫ জুলাই রাত ১১ টায় ঢাকায় করোনাক্রান্ত হয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)। রাত সাড়ে ১১ টায় খবরটি শুনে অনেকক্ষণ হতভম্ব ছিলাম। এক পর্যায়ে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়লে আরেক ভাগ্নে ডা. শিবলী খান এসে ওষুধপাতি খাওয়ানোর প্রায় ২ ঘন্টা পর স্বাভাবিক হয়ে উঠি। শিবলীও জামিলের মৃত্যুর খবরে অঝোরধারায় কাঁদছিল, আমার আকষ্মিক অসুস্থতা দেখে তাঁর কান্না থামে।
জামিলের কর্মজীবন শুরু হয় বাংলাদেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ইংরেজির লেকচারার হিসাবে। এরপর একসময় লিবিয়ার একটি কলেজে ইংরেজি শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়ে কয়েক বছর পর দেশে ফিরে এসে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জিএম পদে যোগ দেন। লিবিয়া যাওয়ার পূর্বেই জামিলের বিয়ে হয় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ঢাকা কলেজের প্রফেসর আব্দুল হাশেম সাহেব (বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিন সাহেবের বড় ভায়েরা) এর মেয়ে জুবাইদা নাসরিন লিপি’র সাথে। তাদের দুই পুত্রের বড় মাহের জামিল চৌধুরী অভি অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছে, ছোট ছেলে নাদের জামিল চৌধুরী অর্চি ঢাকা স্কলাস্টিকা স্কুলে শিক্ষকতা করছে। জামিল সর্বশেষ বেসরকারি সংস্থা এএসডি’র নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। জামিলরা দুই ভাই দুই বোন। জামিলের ছোট তজম্মুল আমেরিকা প্রবাসী। সে আবার আমার আরেক বোনের মেয়ে লিলিকে বিয়ে করেছে। দুই বোন মাছুমা ও লতিফা সিলেটেই সন্তান-সন্ততি নিয়ে বসবাস করছে।
জামিল আমাদের সব বড় বোনের ছেলে। বয়সে আমার ৮/৯ বছরের বড়। মামা ভাগ্নের সম্পর্ক মধুর থাকে। তবে সকলের সাথে সম্পর্ক একই মাত্রার থাকেনা। জামিলের সাথে ভাগ্নেদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক ছিল আমার। এক সপ্তাহ আগে রাতে অনেকক্ষণ মোবাইলে কথা হয়েছে। তাঁর শেষ কথা ছিল – মামা তোমারও বয়স হয়ে গেছে, করোনা বাড়ছে, বেশি বাইরে না যাওয়া ভালো। হেসে বলেছিলাম, বিকেলে ৫ ঘন্টার জন্য অফিসে যেতে হয়। এর বাইরে কোথাও যাইনা। মামা সাবধানে থাকো বলে সালাম দিয়ে জামিলের সাথে ফোনালাপ শেষ হয়। এরপর সপ্তাহের মাথায় তাঁর চিরবিদায়ের খবর আমাকে হতবিহ্বল করে তুলে।
আগেই বলেছি ভাগ্নেদের মধ্যে জামিলের সাথে আমার সর্বাধিক সম্পর্ক ছিল- শুধু আমার নয় আমাদের গোটা পরিবারের সাথে জামিলের সর্বাধিক যোগাযোগ ছিল। এর বিশেষ কারণও আছে।
আমাদের বড় বোনের বাড়ি দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ গ্রামে। দুলাভাই মফজ্জুল হোসেন চৌধুরী’র ভাতিজা রব্বানী চৌধুরী ছিলেন কুলঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। পরবর্তী সময়ে তাঁর ভাই তোফায়েল আহমদ চৌধুরী এই বনেদী পরিবারে চেয়ারম্যানশীপ রাখেন। আমাদের দ্বিতীয় বোন এর মেয়ে রাহনমা (ডা. শিবলী’র ছোট বোন)-কে তোফায়েল তাঁর শ্যালক আলমের সাথে বিয়ে করিয়ে আমাদের আত্মীয়তা ঝালাই করে দেন। তোফায়েলসহ সবাই এখন আমেরিকায়। জামিলের চাচাতো ভাইদের মধ্যে আহবাব আমার সাথে অতি ঘনিষ্ট। বীর মুক্তিযোদ্ধা আহবাব হোসেন চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউকে’র সভাপতি ছিলেন। আহবাব ভাগ্নে জামিলেরও কিছু বড়। কিন্তু সম্পর্কে বড় হওয়ার কারণে আহবাব আমাকে অতীব সম্মান করেন।
জামিলের মৃত্যুর ঘন্টাখানেক পরে আহবাব আমাকে ফোন করে বলছিলেন, মামা জামিল আমার আগে চলে গেলো। আমরা দুজনই তখন কাঁদছিলাম। আমি তারপরও আহবাবকে শান্ত্বনা দিয়ে বলেছি- আল্লাহ’র হুকুম, এখন তার জন্য দোয়া করো।
ছোটবেলায় যখন বাবার সাথে কুলঞ্জ যেতাম তখন নৌকাই ছিল একমাত্র ভরসা। নদী হাওর পেরিয়ে ২ দিন লাগতো কুলঞ্জ যাত্রায়। সে সফরে এডভেঞ্চার ছিল। কুলঞ্জ সফরের জন্য কাইম উল্লাহ নামে আমাদের নির্ধারিত মাঝি ছিল। সত্তরের প্রলয়ংকরী ঘুর্ণিঝড়ের দিন আমরা কুলঞ্জের পথে ছিলাম, মারকুলী পার হওয়ার পর সাগরসম হাওরের উত্তাল ঢেউ মাড়িয়ে আল্লাহ’র বিশেষ রহমতে ও মাঝি কাইম উল্লাহ’র দক্ষতায় শেষ পর্যন্ত কুলঞ্জ গিয়ে পৌঁছি। ৫০ বছর আগের সেই ভয়াল স্মৃতি স্মরণ হলে আজও শিউরে উঠি।
দুই বছর আগে আমার ‘বনকুঞ্জ’ বাড়িতে ভাগ্নে জামিল হোসেন চৌধুরী (ডানে) ও ভাতিজা মহিউস সুন্নাহ’র সাথে আমার এই ছবিটি ভাতিজা বউ কিশোয়ার কামাল’র তোলা।
কুলঞ্জ এর কাছাকাছি হাইস্কুল না থাকায় বাবা জামিলকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। ভর্তি করে দেন বিশ্বনাথ রামসুন্দর হাইস্কুলে। রামসুন্দর হাইস্কুলের হেড মাস্টার আমার মামা তজম্মুল আলী। আরেক নানাকে হেডমাস্টার হিসাবে পেয়ে জামিলের হাইস্কুল জীবন ভালোই কাটে। মামাও মেধাবী নাতিকে ছাত্র হিসাবে পেয়ে খুশি। নানাবাড়িতে অবস্থানের কারণে মামা খালাদের সাথে জামিলের অন্তরঙ্গতা বৃদ্ধি পায়।
৭১ মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে জামিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ইংরেজি অনার্সের ছাত্র। ঢাকার অবস্থা খারাপ হলে বাড়ি এসে চাচাতো বড়ভাই আহবাবসহ মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্যেশ্যে ভারতে পাড়ি জমান। বাড়িতে বয়োজ্যেষ্ঠদের দেখার বড় কেউ নেই এই কথা বলে আহবাব জোর করে তাকে দেশে ফেরত পাঠান। কিন্তু দুই ভাইয়ের ভারত যাত্রা ও একজনের ফিরে আসার খবর চাউর হয়ে গেলে বুয়াই তাকে আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। আবার নানাবাড়িতে লম্বা সময় কাটে জামিলের। ফলে মামা খালা ও ভাইবোনদের সম্পর্ক আরো গাঢ় হয়। এ সম্পর্ক অব্যাহত ছিল আমৃত্যু। আমাদের পারিবারিক সকল অনুষ্ঠানে জামিলের উপস্থিতি অপরিহার্য ছিল। ব্যস্ততা থাকলে ফ্লাইটে এসে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আবার ফ্লাইটে তাকে ফিরতে দেখেছি।
৭৮ সালের জানুয়ারিতে জামিল ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগপত্র পেয়ে বাবার কাছে ছুটে এসে বলেন, নানা আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জয়েন করতে হবে। মামাকে সাথে নিতে চাই। আমি তখন এইচএসসি দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষায়। বাবা সম্মতি দিলেন। জামিল আমাকে কাপড় চোপড় গুছিয়ে ২/১ দিনের মধ্যে যাত্রার প্রস্তুতি নিতে বললেন।
ফৌজদারহাট ক্যাডেট দেখার আগ্রহ নিয়ে পরদিন রাতেই আমরা চট্টগ্রামের ট্রেনে উঠলাম। বড়ভাই ওহিদুন নূর তখন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কালেক্টর। আগ্রাবাদ কলোনিতে জাম্বুরী মাঠের পাশে বাসা। ওখানে নাস্তা ও দুপুরের খাবার খেয়ে খানিক বিশ্রাম নিলাম। ওখানে আমার সমবয়সী ও সহপাঠি ভাতিজা সাদেক (ড. নজমুল সাকিব, পরবর্তীকালে বুয়েট শিক্ষক, এখন আমেরিকা প্রবাসী)। আমার জন্ম ২০ জুনের পরদিন ২১ জুন সাদেকের জন্ম। সাদেকের কাছে পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার খোঁজখবর নিলাম ও গল্পগুজব করে বিকেলে গাড়িতে মামাভাগ্নে ফৌজদারহাট রওয়ানা দিলাম। যাওয়ার আগে ভাবি সময় সুযোগ করে আসার জন্য বললেন।
ভাইবোন সকলের ছোট হওয়ায় ভাইবোনদের পাশাপাশি ভাবিদের আদর সোহাগ আমি মনে হয় বেশি পেয়েছি। বিকেলে ফৌজদারহাট পৌঁছলে কলেজের কর্মকর্তা কর্মচারীরা আমাদের রিসিভ করে জামিলের নির্ধারিত বাসায় নিয়ে গেলেন। চমৎকার পরিবেশ। পুরো নেট মোড়ানো ৩ বেডের ফার্নিসড বাসা। শিক্ষকদের বাসা একই সারিতে, একই রকম। সকল বাসার সামনে নারিকেল গাছ, ছোট ফুল বাগান। বাসার পেছন ও খুব পরিপাটি। নিয়মিত মালি ঝাড়ুদার তদারক করে।
যেহেতু ভাগ্নের ফ্যামিলী নেই, তাই কলেজ ডাইনিংয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। রাতের খাবার খেতে কলেজ ডাইনিং এ গেলাম। কলেজের ছাত্ররা এক দিকে বসা, অপরদিকে ৩/৪ জন শিক্ষক। ভাগ্নে আমাকে আস্তে করে বললেন, মামা সবাই যখন খাওয়া শুরু করবে-তখন তাদের ফলো করবে।
সবার প্লেটে কাঁটা চামচ দেয়া। ভাগ্নের কাছ থেকে বুঝলাম কাঁটা চামচ দিয়ে খেতে হবে। বাসায় আম আনারস কাঁটা চামচ দিয়ে খেয়েছি। কিন্তু ভাত কাঁটা চামচ দিয়ে কখনোও খাইনি। বিরক্ত মনে অপারগ অবস্থায় কাঁটা চামচ হাতে নিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করলাম। খাবার খুবই উন্নতমানের, ডাল মনে হলো ঘি দিয়ে রাঁধা। হাড্ডিযুক্ত মোরগের মাংস কাঁটা চামচ দিয়ে আলাদা করার চেষ্টায় খুব একটা সফল হলাম না। অগত্যা ডাল ভাজি দিয়ে কোনরকম খাবার চেষ্টা করছি। এমন সময় ভাগ্নে জানালেন, আর খাওয়া যাবে না। খাওয়া শেষের সিগন্যাল পড়ে গেছে। ক্যাডেট কলেজে খাওয়া নাস্তাসহ সব বিষয়ে কঠোর সময়ানুবর্তীতা মেনে চলতে হয়।
খাবার শেষে উপস্থিত শিক্ষকরা ছাত্রদের সাথে নতুন ইংরেজি শিক্ষককে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাকেও শিক্ষকের মামা হিসাবে জানান দিলেন। বাসার ফেরার পথে জামিল আমার জন্য ব্রেড আনার জন্য কলেজের বাইরে দোকানে যেতে চাইলে আমি বাঁধা দিলাম কিন্তু নাছোড়বান্দা ভাগ্নের এককথা তোমার পেট ভরেনি। তা ছাড়া সকালের নাস্তা ঘরে হবে, তাই ব্রেড, বিস্কুট কলাসহ চায়ের সরঞ্জাম আনা হলো। ঘরে ফিরে অনেকটা জোর করে ভাগ্নের আনা ব্রেডকলা খেতে হলো। ভাগ্নে আমার খাবার নিয়ে উদ্বিগ্ন দেখে বললাম- চিন্তা করোনা সেভেন- এইটের বাচ্চারা কাঁটা চামচ দিয়ে যখন খেতে পারছে আমিও পারবো। শুনে ভাগ্নে বললেন, সাব্বাস মামা আমি টেনশন ফ্রি।
পরদিন সকালে ভাগ্নে কলেজে চলে গেলেন। বললো তোমাকে রোজ কয়েকঘন্টা একা থাকতে হবে। অনেকগুলো গল্প উপন্যাসের বই দেখিয়ে বললেন, এগুলো পড়ো আর গান শুনতে চাইলে টেপরেকর্ডার আছে। ৩/৪ দিনের মধ্যে কাঁটা চামচ রপ্ত হলো। ক্যাডেট কলেজের বিধান অনুযায়ী ছাত্র শিক্ষক সবার জন্য মাগরিব ও জুমা’র নামাজ বাধ্যতামূলক। তাই মাগরিব ও জুমার নামাজে যাওয়ার পথে কলেজও দেখা। অপূর্ব পরিপাটি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ।
কোন কলেজ এত পরিপাটি হতে পারে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ না দেখলে আমি বুঝতে পারতাম না। ক্যাডেট কলেজগুলো নিয়মশৃঙ্খলার কারণে পরিপাটি। পরবর্তীকালে আমার দ্বিতীয় ছেলে আলবাব সিলেট ক্যাডেট কলেজে পড়েছে। এখানেও শৃঙ্খলা দেখেছি কিন্তু ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ অতুলনীয়। প্রায় ৪৫ বছর হতে চলেছে কিন্তু ফৌজদারহাটে দেড়মাস অবস্থানের স্মৃতি এখনও মানসপটে ভাসে। সিলেট ফেরার সময় হয়ে যাচ্ছে, একদিন ফৌজদারহাট থেকে আগ্রাবাদ ভাইয়ের বাসায় গেলাম। ভাবি খুশি হলেন। একদিন যেতে না যেতেই ভাগ্নের ফোন, মামা এক ভালো লাগছে না, চলে আসো।
ভাগ্নের চাপাচাপিতে রওয়ানা দিলাম বাসে চড়ে। ফৌজদারহাট নামতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে গেলাম। বাস পুরো না থেমে নামিয়ে দেয়, এক্ষেত্রে সামনের দিকে নাকি পা দিয়ে নামতে হয়। এ কৌশল জানা ছিল না-তাই পড়ে গেছি। পড়ে এমন অবস্থা হলো উঠে দাঁড়াতে পারছিনা। লোকজন এগিয়ে এসে ক্যাডেট কলেজের গেইট অবধি নিয়ে গেলেন। গেইট কীপাররা ইতোমধ্যে আমাকে চিনে ফেলেছে। খবর পেয়ে ভাগ্নে এসে আমাকে নিয়ে সোজা কলেজ হাসপাতালে গেলেন। পা মচকে গেছে, তীব্র ব্যথা, ডাক্তারের পরামর্শে হাসপাতালে ৩ দিন থেকে কোয়ার্টারে ফিরলাম। ভাগ্নে দিনে-রাতে গিয়ে দেখতেন, মাঝেমধ্যে তার দু-একজন কলিগও হাসপাতালে এসে আমাকে দেখেছেন। হাসপাতালের পরিসর বড় নয়, তবে ছিমছাম আর দারুন পরিষ্কার। ঐ রাতে রোগী বলতে আমি একা। পরদিন একটি ছেলে এলো, বেশ জ্বর নিয়ে, শুধু জানলাম কলেজের ছাত্র।
আমার ফৌজদারহাট যাওয়ার মাসখানেক পর বুয়াই (জামিলের মা) ফৌজদারহাট চলে আসলেন। এবার চলে আসতে চাইলে বোন ভাগ্নে দু’জনই বাঁধ সাধলেন। অগত্যা আরো দিন পনেরো থেকে ফৌজদারহাট ছাড়লাম। ফৌজদারহাটের ওই দিনগুলো আমাদের অতি ঘনিষ্ট করে তোলে।
ছুটির দিনে অন্যান্য শিক্ষকরা জামিলের বাসায় আসতেন। সবাই আমাকে মামা ডাকতেন। মুখে দাঁড়ি থাকার কারণে হয়তো তারা আমার বয়স অনুমান করতে পারেন নি। আর ভাগ্নে যেভাবে মামা মামা করতেন সে কারণে আমি গণমামা হয়ে গেলাম। নামাজে গেলে ছাত্রদের অনেকে সালাম দিতো। সিনিয়র ক্লাসের কয়েকজন দেখা হলে বলতো মামা কেমন আছেন। আমিও তাদের সাথে টুকটাক দু’চার কথা বলতাম।
জামিলের আবৃত্তি ছিল চমৎকার, তাঁর পাঠদানের স্টাইল তাকে ফৌজদারহাটে অল্পদিনের মধ্যে জনপ্রিয় শিক্ষক হিসাবে পরিচিত করে তোলে।
কলেজ শেষে ঘরে এসে প্রায়শই ভাগ্নে আমাকে দরাজ গলায় কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। আমার অল্পস্বল্প কবিতা লেখার অভ্যাস ছিল। ঘরে ফিরেই বলতেন মামা আজ কিছু লিখেছ? আমার অর্থনীতি নিয়ে উচ্চশিক্ষার ইচ্ছা শুনে ভাগ্নের বক্তব্য ছিল ওটা রসকষহীন সাবজেক্ট, তুমি লেখালেখিতে থাকলে ভালো করতে পারতে। পরবর্তীকালে আমার ভাগ্নের কথাই বাস্তবে সত্য হয়েছিলো।
বছর চারেক আগে আমার বড় ভাতিজা আজিজুন নবী ফারুকও আকস্মিক চিরবিদায় নিলেন। তখন আমি লন্ডনে থাকায় শেষ দেখা হলো না। ভাতিজাদের মধ্যে তার সাথে আমার অন্তরঙ্গতা বেশি ছিল। এখন অন্তরঙ্গ ভাগ্নেও চলে গেলেন। কঠোর লকডাউনের কারণে তার জানাজা ও দাফনেও শরীক হতে পারলাম না। এই মর্মপীড়া আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কখন কার পরপারের ডাক আসবে কে জানে। আল্লাহ যেন ভাগ্নের পরিবারের সবাইকে শোক সইবার তাওফিক দিন।
আজ আমাদের অগ্রজদের অনেকেই কবরবাসী, শেষমেষ জামিলের আকস্মিক বিদায়ে আমরা সবাই ভারাক্রান্ত। আল্লাহপাক আমাদের মরহুম মা বাবা, ভাই বোন, ভাবি, ভাতিজা ভাতিজী ও ভাগ্নে জামিলসহ সকলের কবরের জিন্দেগিতে প্রশান্তি দান করুন, তাদের ভুলভ্রান্তি মার্জনা করে তাঁর অফুরাণ রহমত দিয়ে আচ্ছাদিত করুন। একইসাথে আমরা যারা জীবিত আছি তাদের সত্যের পথে অবিচল রেখে ঈমানের সাথে মৃত্যু নসীব করুন। আমীন।
লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জালালাবাদ, সাবেক সভাপতি, সিলেট প্রেসক্লাব।