সুন্দর সমাজ গঠনে তাকওয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ জুলাই ২০২১, ৭:০৮:৪০ অপরাহ্ন
ফয়সল আহমদ
গভীর রাতে নির্জনে কেউ অবৈধ কোন কাজ করলে কারও দেখে ফেলার আশঙ্কা হয়তো নেই। তবুও একজন মুসলমান নির্জনে অবৈধ কাজ থেকে বিরত থাকে। রমজান মাসে দিনের বেলায় ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে কিছু খেয়ে ফেললে হয়তো কেউ দেখবেনা। তবুও সাধারনত মুসলমানরা কাজটি করেননা। প্রবৃত্তির তাড়নায় কোন অন্যায় কাজ করার জন্য তাড়িত হওয়ার পর সুযোগ থাকা সত্বেও অনেক সময় সে অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকে। এসবই অন্তরে তাকওয়া বা খোদাভীতির আলামত। কারও অন্তরে স্রষ্টার প্রতি নূন্যতম ভয়ও যদি থাকে সে একটি অন্যায় কাজ করতে অনেক ভাববে! আর যার অন্তরে তাকওয়ার বীজটি অঙ্কুরিত হয়নি, সে যখন অন্যায় কাজ করবে তখন অপার্থিব কোন পরিণতির কথা কল্পনাও করবেনা।
সুন্দর জীবন-যাপনের জন্য ইসলাম তাকওয়ার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেছে। তাকওয়া সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন- হে ঈমানদারগন! তোমরা আল্লাহকে যেরকম ভয় করা উচিত, ঠিক সেইভাবে ভয় করতে থাকো এবং অবশ্যই মুসলমান না হইয়া মৃত্যুবরণ করিওনা। হজরত ওমর রা. তাকওয়ার অর্থ জানতে চাইলে সাহাবা হজরত উবাইদ ইবনে কাব রা. বলেন কাঁটাবনের ভেতর দিয়ে চলতে গেলে যেমন সাবধান ও সতর্ক হয়ে চলতে হয় তেমনি অন্যায় বা গুনাহ থেকে আত্মরক্ষা করে চলাকে বলে তাকওয়া। কাঁটা বলতে এই ঘাত-সংঘাতময় জীবনে চলার পথে সব গোপন ও প্রকাশ্য পাপাচার যেমন-মিথ্যাচার, অন্যায়-অত্যাচার, সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি, খুন-ধর্ষণ, জুলুম-নির্যাতন, যিনা ব্যবিচার ইত্যাদি অপকর্মকে বুঝানো হয়েছে। তাকওয়া হলো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র আল্লাহকে ভয় করা ও তাঁকে স্মরণ করে এগুলো পরিহার করে চলা।
তাকওয়া কেবল ঠোঁটে বা হৃদয়ে বিশ্বাস হলে চলবেনা, এটা হতে হবে বাস্তব কর্মভিত্তিক। আমাদের চিন্তা-চেতনায়, ব্যাক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় কৃষিতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, অফিস-আদালতে, শিল্প-সাহিত্যে সর্বত্র এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
কেউ কেউ মনে করতে পারেন তাকওয়া অর্জনের জন্য শিক্ষার প্রয়োজন। কিন্তুু মূলত তাকওয়া অর্জনের জন্য কোন শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। শিক্ষা দিয়ে তাকওয়া কি তা জানা যায় কিন্তু অর্জন করা যায়না! তাই যদি হতো আমাদের সমাজে কিংবা রাষ্ট্রে শিক্ষিত মানুষের কি অভাব রয়েছে? যদি জ্ঞান ও শিক্ষা দিয়ে তাকওয়া অর্জন হয়ে যেত তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রে এত দুর্নীতি, অনিয়ম, অন্যায়,পাপাচার ও অপকর্ম কেন?
সমাজের নিম্নশ্রেনীর কিংবা অশিক্ষিত (যারা প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষত নয়) লোকজন যতটা অনিয়ম করে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি অনিয়ম, দুর্নীতি ও অন্যায় করে উঁচুশ্রেণীর শিক্ষিত ভদ্রবেশী লোকজন।
কারও কারও ধারণা বয়স বাড়লে তাকওয়া অর্জিত হয়। যদি তাই হতো তাহলে হজরত ওমর রা. এর শাসনামলে একজন বয়স্ক মা বেশি লাভের আশায় কি করে দুধে পানি মেশাতে গেলে তার অল্প বয়সী মেয়ে আল্লাহর ভয় দেখিয়ে পানি না মেশাতে সতর্ক করেছিল? বলেছিল মা, তোমার মনে কি আল্লাহর ভয় নেই? তুমি কি জানোনা যে আর কেউ দেখুক বা না দেখুক আল্লাহ গোপন ও প্রকাশ্য সব দেখেন?
কাজেই তাকওয়া হলো এমন এক অন্তর্মুখী শক্তিসম্পন্ন গুন যা সুপ্ত আত্মা ও বিবেককে জাগিয়ে তোলে। এটি অনুভবের, উপলব্দির ও অনুধাবনের ব্যাপার। তাই এর অভাবে বাস্তব জীবনে আমরা দেখছি এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ও তমসাচ্ছন্ন চিত্র। নাগরিক ও সামাজিক জীবনে তাকওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
মানুষের মনের রাজ্য নিয়ন্ত্রক তাকওয়া থাকলে সে অসদাচরন কিংবা কোন অনিয়ম করতে পারেনা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তাকওয়ার চর্চা বা অনুশীলন করা আবশ্যকীয় বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। আর একমাত্র মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট জবাবদিহিতার মানসিকতা নিয়ে চর্চার মাধ্যমেই তাকওয়া অর্জিত হতে পারে। মানুষের মধ্যে তাকওয়া থাকলে সে মিথ্যা কথা বলবেনা, দুর্নীতি করবেনা, অন্যকে ঠকাবেনা, সুদ-ঘুষের বাণিজ্য করবেনা, প্রতারণা করতে পারবেনা, খুন-ধর্ষণ হবেনা, মানুষ কালোবাজারির আশ্রয় নেবেনা, অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাত করবেনা। সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় আইন লঙ্ঘন করতে পারবেনা।
এককথায় তাকওয়ার মাধ্যমে মানুষকে অন্যায় -অপকর্ম থেকে যেভাবে বিরত রাখা সম্ভব, তা আইন প্রশাসন দিয়ে কখনও সম্ভব নয়। ইসলামের সোনালি যুগে শক্তিশালী আইন প্রশাসন তেমন ছিলনা কিন্তু মানুষের মধ্যে ছিল তাকওয়ার গুণ। ফলে তৎকালীন সমাজসভ্যতা গড়ে উঠেছিল সুখময় ও শান্তির আবাস হিসাবে। তাই বর্তমান প্রযুক্তির ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে এসেও সমাজপতিরা সমাজ সংস্কারের যতই উন্নত থিওরি উদ্ভাবন করেননা কেন আজও একটি সুষ্ঠু, সুন্দর, সুশীল এবং কাক্সিক্ষত সমাজের জন্য তাকওয়ার বিকল্প নেই। কাজেই আসুন এই করোনাময় পৃথিবীতে করোনা থেকে শিক্ষা নিয়ে হলেও সবার জীবনে তাকওয়ার গুণাবলী অর্জনের সর্বাত্মক চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের সকলকে বুঝার ও মানার তাওফিক দান করুন।
লেখক: সরকারি কর্মকতা