সিলেটের ক্বওমী মাদ্রাসা বোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২:০৫:২৩ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার :
ব্যাপক অনিয়ম জালিয়াতির মধ্য দিয়ে চলছে সিলেট অঞ্চলের ক্বওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। সংবিধান বহির্ভূতভাবে চালানো হচ্ছে বোর্ডের কার্যক্রম। বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তারা সংবিধান লঙ্ঘন করে সরাসরি রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত থেকে অংশ নিচ্ছেন দলীয় কার্যক্রমে। বোর্ডের বিগত নির্বাচনে জাল-জালিয়াতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে জামেয়া ক্বাসিমুল উলুম দরগাহ শাহজালাল (রহ.) মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মুফতি মুহিব্বুল হক গাছবাড়ীসহ সিলেটের কয়েকজন শীর্ষ আলেম সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরে বোর্ডের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট নানা অনিয়ম তুলে ধরে লিখিত অভিযোগ করেছেন। ক্বওমী মাদরাসার মত দ্বীনি শিক্ষাবোর্ডের দায়িত্বে থাকা শীর্ষ নেতৃবৃন্দের এমন অনিয়ম জালিয়াতির ঘটনা ক্বওমী অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এসব থেকে ক্বওমী শিক্ষাবোর্ডকে রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ চান সিলেটের শীর্ষ ও সচেতন আলেমগণ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৪১ সালে গঠিত হয় ‘আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তালীম বাংলাদেশ’ নামক বোর্ড। ক্বওমী অঙ্গনের এই বোর্ডের অধীনে সিলেট বিভাগের ৪ জেলার প্রায় ৭৯৫টি মাদরাসার অধ্যয়ন করছেন প্রায় ৫০ হাজারের বেশী শিক্ষার্থী। বোর্ড পরিচালনার জন্যে রয়েছে নিজস্ব সংবিধান। সংবিধানের ধারা-৫ এর আদর্শ-উদ্দেশ্যে (ঘ) বলা হয়েছে, ‘আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ’ একমাত্র শিক্ষা-বিষয়ক প্রতিষ্ঠান বিধায় কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের সহিত এই বোর্ডের সম্পর্ক থাকিবেনা’। সংবিধানে এমন বিধান থাকলেও বোর্ডের বর্তমান সভাপতি মাওলানা জিয়া উদ্দিন একই সাথে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আব্দুল বছিরও একই সাথে দলটির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। হেফাজতের নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ের পর বিএনপি জোটের অন্যতম শরীক এদলটি কিছু দিন আগে বিএনপি জোট থেকে বের হয়ে যায়।
সূত্রে জানা যায়, বোর্ডের বিগত নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে শুরা গঠন ও অন্যান্য কার্যক্রমে নিজস্ব সংবিধান লঙ্ঘন ও অবমাননা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। ১০ পৃষ্ঠার অভিযোগে নানা অনিয়মের বর্ণনা ছাড়াও গেল নির্বাচনের জাল-জালিয়াতির বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। সংবিধান লঙ্ঘন করে বোর্ডের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন রাজনৈতিক দলের পদবীধারী শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ তাদের পছন্দের মাওলানা ইউসুফ খাদিমানী, হাফিজ মাওলানা ফখরুজ্জামান ও মাওলানা তৈয়বুর রহমান চৌধুরীকে বোর্ডে পুনর্বাসনে মরিয়া হয়ে উঠেন। অথচ এই ৩ জনের বিরুদ্ধে অনিয়মসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে বলে লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে।
রামধা মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা ইউসুফ খাদিমানী বোর্ডের অডিটর হওয়ায় তিনি নিজে অডিট না করে নিজের স্বাক্ষর অন্য ব্যক্তিকে দিয়ে জালিয়াতি করে অডিট করান। কিছু দিন পূর্বে তার মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা রুহুল আমিন জাক্কারকে দিয়ে সিলেট নগরের বাদামবাগিচা মাদরাসা অডিট করান। বাদামবাগিচা মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আজিজুর রহমান বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। বোর্ডের অভ্যন্তরীণ অডিট কাজ শেষ করে অডিটের গুরুত্বপূর্ণ খাতা তার নিজের মাদরাসায় নিয়ে যান। বিভিন্ন মাদরাসা ও বোর্ডের অডিটের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। গেল নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সাব-কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। নির্বাচনের পূর্বে এক প্রার্থীর পক্ষে মাঠে কাজও করেন। নির্বাচনের দিন জাল ভোটদানে তিনি সহযোগিতাও করেন। মাওলানা বিলাল আহমদ ইমরান নামের একব্যক্তি ভোটার না থাকার পরও তাকে ইউসুফ খাদিমানী ব্যালট পেপার সরবরাহ করেন।
সিলেট শহরতলীর বড়শালার জামিয়া ইসলামিয়া ফরিদাবাদ মাদরাসার মুহতামিম ও সভাপতি হলেন হাফিজ মাওলানা ফখরুজ্জামান। সংবিধানের ধারা ১৬-১ এর বিধানমতে, অন্যকোন জাতীয় বোর্ডে তার পরিচালনাধীন মাদরাসা ও তিনি অন্তর্ভুক্ত হলে তিনি এদারার শুরা, আমেলা এবং কর্মকর্তা হতে পারবেন না। কিন্তু এই মাদরাসা দীর্ঘ দিন ধরে বেফাকের অন্তর্ভুক্ত। ফরিদাবাদ মাদরাসার বেফাকের রেজিষ্ট্রেশন নম্বর (ইলহাক নম্বর ) ৭/৮৯০। তিনি এদারার কর্মকর্তা হতে নানা কৌশলের আশ্রয় নেন। তিনি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং সভাপতিও। বোর্ডের রচনা কমিটির দায়িত্বে থাকাকালে রেজুলেশনকে পাশ কাটিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে নুরানী বই প্রনয়ন করেন। রচনায় ভুল হওয়ায় ছাপানোর পর ২১ টি বই বাতিল করা হয়। পরে সংশোধন করে পুনরায় নতুন করে বই ছাপানো হয়। এতে বোর্ডের প্রায় ১০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। গেল শিক্ষা বছরের ক্যালেন্ডার ও সিলেবাস বারবার ভুল ছাপিয়ে বোর্ডের সাধারণ সম্পাদকের প্রশ্রয়ে অনেক অর্থ নষ্ট করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে ।
গেল বছর দক্ষিণ সুনামগঞ্জের শাখাইতি মাদরাসার প্রতিনিধি হিসেবে মাওলানা তৈয়বুর রহমান চৌধুরী পদাধিকার বলে শুরাও পরে আমেলার সদস্য হন। চলতি বছর এই সুযোগ না পেয়ে তিনি মুরাদপুর মাদরাসার সহকারী মুহতামিম পদ নিয়ে এদারায় আবেদন করেন এবং কৌশলে পরবর্তীতে দু’কমিটিতেই নিজের স্থান করে নেন। অথচ মুরাদপুর মাদরাসার শিক্ষক হাজিরা খাতা ও ক্লাস রুটিনে তার নাম নেই। সংবিধান অনুযায়ী সহকারী মুহতামিমের কাজই হচ্ছে মুহতামিমের সহযোগিতা করা। জালিয়াতির মাধ্যমে তিনি একাজটি করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। মজলিসে শুরা কমিটি গঠনের জন্যে ১১ জনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সংবিধানের ধারা নং ১০ এর (চ) অনুযায়ী সকল উপজেলা-থানা ভিত্তিক সদস্য মনোনয়ন করা হয়। কিন্তু বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আব্দুল বছির ও তৈয়বুর রহমান চৌধুরী মিলে সুনামগঞ্জের ১০ টি অঞ্চলের মধ্যে ৭ টি অঞ্চলকে ওই কমিটি থেকে বঞ্চিত করেন।
জানা গেছে, সুনামগঞ্জ সদর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দোয়ারাবাজার, ছাতক, জগন্নাথপুর, জামালগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা উপজেলা থেকে বোর্ডের কমিটিতে প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তিতে ব্যাপক অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। সাধারণ সম্পাদক তার পুত্র মাওলানা মিসবাহ উদ্দিনকে সংবিধান বহির্ভূতভাবে কমিটিতে স্থান দেন। সংবিধান অনুযায়ী, অন্যকোন জাতীয় বোর্ডে তার পরিচালনাধীন মাদরাসা ও তিনি অন্তর্ভুক্ত হলে তিনি এদারার শুরা, আমেলা এবং কর্মকর্তা হতে পারবেন না। বোর্ডের সভাপতি মাওলানা জিয়া উদ্দিন নগরীর শিবগঞ্জ মাদরাসারও মুহতামিম। অথচ শিবগঞ্জ মাদরাসা বেফাকের অন্তর্ভুক্ত মাদরাসা। যার বেফাকের রেজিষ্ট্রেশন নম্বর (ইলহাক নম্বর) ৭/১০৬৭।
দাওরায়ে হাদীসকে মাস্টার্স ডিগ্রীর সমমান প্রদান করতে ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর সিনিয়র সচিব ড. মো.আবদুর রব হাওলাদার স্বাক্ষরিত গেজেট প্রকাশ করে সরকার। গেজেট অনুযায়ী যে ৬ টি বোর্ড নিয়ে ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামিয়া’তিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ নামক বোর্ড গঠন করা হয় তার মধ্যে ৪র্থতম হচ্ছে সিলেটের এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ। আইনটির ৬ নম্বর ক্রমিকে আল-হাইআতুলের কমিটি গঠনের ব্যাপারে (চ) বলা হয়েছে , আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ এর ২ (দুই) জন সদস্য (পদাধিকার বলে সভাপতি ও মহাসচিব অথবা বোর্ড কর্তৃক মনোনীত )। কিন্তু বোর্ডের সভাপতি বয়সের ভারে ঢাকায় আল-হাইআতুলের সভায় অংশগ্রহণ করতে পারেননা। সভাপতির পরিবর্তে সিনিয়র সহ-সভাপতি কিংবা সহ-সভাপতি এবং মহাসচিব ওই সভায় অংশগ্রহণ করবেন, নতুবা বোর্ড কর্তৃক মনোনীত ২ জন অংশগ্রহণের বিধান থাকলেও ওই সভাসমুহে বহরগ্রাম মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা এনামুল হক অংশ নেন। এর ফলে সরকারের আইনেরও সরাসরি লঙ্ঘন করা হচ্ছে। সর্বশেষ গত ৩০ আগস্ট ঢাকায় আল-হাইআতুলের সভায় ওই মাওলানা এনামুল হক অংশ গ্রহণ করেন। সভায় অংশ গ্রহণকারীদেরকে যাতায়াত ভাতা হিসেবে সম্মানী প্রদান করে আল-হাইআতুল উলয়া।
৮০ বছরের পুরনো এই শিক্ষা বোর্ডের এসকল অনিয়ম তুলে ধরে এবং অনিয়মের প্রতিকার চেয়ে স¤প্রতি লিখিত অভিযোগ করা হয়। সিলেটের মাদরাসাগুলোর পক্ষে শাহজালাল (রহ.) দরগাহ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মুফতি মুহিব্বুল হক গাছবাড়ী, কৌড়িয়া মাদরাসার মুহতামিম হাফিজ মাওলানা মুহসিন আহমদ ও সোবহানীঘাট মাদরাসার মুহতামিম হাফিজ মাওলানা আহমদ কবীর স্বাক্ষরিত অভিযোগটি দায়েরের কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বরং অনিয়মের মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই চলছে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট মাদরাসাগুলোর মুহতামিমসহ আলেমদের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। বিক্ষুদ্ধ আলেমগণ করনীয় ঠিক করতে সিলেট-সুনামগঞ্জে দফায় দফায় বৈঠক করেন। বিশেষ করে সুনামগঞ্জের প্রায় সকল কওমী মাদরাসায় এর ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ারও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
এ সকল অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে জামেয়া ক্বাসিমুল উলুম দরগাহ শাহজালাল (রহ.) এর মুহতামিম মাওলানা মুফতি মুহিব্বুল হক গাছবাড়ী বলেন, আমরা লিখিত অভিযোগ করেছিলাম বোর্ডের ঐতিহ্য ও সুনাম রক্ষায় অতীতের অনিয়মের সুরাহা করতে। কিন্তু বোর্ড কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও একগুয়েমীতার কারণে হচ্ছেনা। অভিযোগের ৫ মাস হতে চলেছে কিন্তু কোন খবর নেই। আমরা আমাদের অবস্থান থেকে সরে আসিনি।